ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কতটা ঝুঁকি নিয়ে আসছে আগামীর প্রকৃতি? 

শেখ আনোয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১৬, ১৫ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৫:৫৫, ১৫ জানুয়ারি ২০২১
কতটা ঝুঁকি নিয়ে আসছে আগামীর প্রকৃতি? 

মুক্ত চনমনে নিঃশ্বাসপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আবহাওয়ায় বাস করতে কার না ভালো লাগে? কিন্তু তা কি আর সহজে পাওয়া যায়? কারণ, বেড়েছে তাপমাত্রা। পরিবর্তন ঘটছে প্রাকৃতিক পরিবেশের। বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে আবহাওয়ার ভয়াবহ বৈরিতা।

গত ১০০ বছরে পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, গত দশ বছরে বিশ্বে যত বন্যা, ঝড় ও দাবানল হয়েছে তার সবই এই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণেই হয়েছে। বৃক্ষনিধন, শিল্প-কারখানা স্থাপন, দূষণ ও নগরায়নের ফলে আবহাওয়ায় এই দীর্ঘস্থায়ী বৈরিতা সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জনবসতির ওপর প্রতিনিয়ত নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ইত্যাদি আঘাত হেনেছে। বাংলাদেশেও স্বাভাবিক কারণেই আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে। অসময়ে বৃষ্টিপাত, যখন বৃষ্টির মৌসুম তখন খরা, এক এলাকায় বৃষ্টি, তো অন্য এলাকায় নেই। শীত কালেও শীত নেই। আবার গরম কালে তীব্র গরম, বন্যা, টর্নেডো, ঝড় ও সাইক্লোনের মাত্রা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে চলেছে। বিজ্ঞানী ও গবেষকদের আশঙ্কা, আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ শতাংশ ভূমি বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে যাবে। প্রাকৃতিক বৈরিতার ফলে অন্যান্য জীবের সঙ্গে মানুষের জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন। আগামী দিনে এই পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য থাকতে পারবে কি, পারবে না, এটিই এখন বড় উদ্বেগের বিষয়!

‘কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাড়ার কারণেই পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে’- সুইডিশ বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস প্রথম এই মন্তব্য করেছিলেন সেই ১৮৯৮ সালে। তারপর বিশ্ব বায়ুমণ্ডল নিয়ে গত শতাব্দীর সত্তর দশকে কোনো বিজ্ঞানী আর ততোটা মাথা ঘামাননি। তবে শতাব্দীর শেষ ভাগে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞানীদের টনক নড়ে। রিওডি জেনেরিওর সম্মেলনের পর নীতি প্রণেতারা আবহাওয়ার বৈরিতা নিয়ে সজাগ হন। আবহাওয়ার পরিবর্তন সম্পর্কে জনসাধারণকে স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার জন্য জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) এবং বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত উপাত্ত সংগ্রহ এবং সম্ভাব্য প্রতিবিধানের দিক নির্দেশনা প্রদানের উদ্দেশ্যে গঠন করেছে আন্তঃমহাদেশীয় প্যানেল- আইপিসিসিআই।

আবহাওয়া পরিবর্তনের পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে সম্প্রতি যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তা হলো: ‘মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যাই পৃথিবীর উষ্ণতার জন্য দায়ী। গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়া, ওজন স্তর ক্ষয় এসবই মানুষের কারণে সৃষ্ট। এসব কারণেই আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে।’ মানুষ নির্গমন করছে ক্ষতিকর গ্যাস, যেমন কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, সিএফসি বা ক্লোরোফ্লোরো কার্বনসহ মিথাইল ক্লোরোফর্ম ইত্যাদি। এছাড়া জীবাশ্মকে জ্বালানি হিসেবে পুড়িয়ে তাতে উৎপাদন করা হচ্ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড। এই বাড়তি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে গাছ। কিন্তু বন কেটে ফেলার কারণে বিরূপ প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষিশিল্পে আধুনিকায়নের ফলে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড বেশি পরিমাণে নির্গত হচ্ছে। এর ফলে বায়ুমণ্ডল তাপ আটকে রাখছে।

প্রতিনিয়ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও মিথেনের মতো গ্রিনহাউজ গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ব্যাপক হারে জমা হচ্ছে। এ ধরনের মারাত্মক ক্ষতিকর গ্যাস মজুদ হয়ে গ্রিনহাউস প্রভাব সৃষ্টি করছে। ক্লোরোফ্লোরো কার্বন বা সিএফসি এবং অন্যান্য গ্যাস বায়ুমণ্ডলের বাইরের দিকে যে ওজন গ্যাসের আবরণ রয়েছে, তা ক্রমেই ক্ষয় করে দিচ্ছে। ওজন স্তরের ক্ষয়ের ফলে আগে যেভাবে পৃথিবীতে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির আগমন বাধাগ্রস্ত হতো, এখন তার প্রবেশ সেই পরিমাণে আটকানো যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক এই অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা জানান, আগামী দিনে বিশ্বের পরিবেশের ওপর বায়ুমণ্ডলের এই পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক। এ কারণে আগামী পাঁচ দশকে বিশ্বের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী থেকে ৩.৩ ডিগ্রী পর্যন্ত বাড়তে পারে।

এভাবে বায়ুমণ্ডলের যত দ্রুত পরিবর্তন ঘটবে, ক্ষতিও বাড়বে ততো দ্রুত। বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সাগর পৃষ্টের উচ্চতা ১৫ থেকে ৯৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়বে। দেখা দেবে নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আবহাওয়া হয়ে উঠবে আরও শুষ্ক, আরও উত্তপ্ত কিংবা কঠিন বরফশীতল। ফলে বিলুপ্ত হবে বিশেষ প্রজাতির জীব। মানবসমাজও নতুন নতুন রোগ, ঝুঁকি ও দুর্যোগের সন্মুখীন হবে। অবশ্য বর্তমান বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকি কবলিত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও কোনো কোনো অঞ্চল খাদ্য ঘাটতির শিকার হতে পারে। বাষ্পীভবনের ধরন পরিবর্তনের ফলে জলজ সস্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে সাগরের উঞ্চতা বাড়ার কারণে ভৌত অবকাঠামো বিনষ্ট হবে। আবহাওয়া পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। বিগত শতাব্দীর শেষ দশকের উপাত্ত থেকে অনুমান করা যাচ্ছে, চলতি দশকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন বাড়বে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো পরিবেশ সংকটের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।

আবহাওয়ার এই বিপর্যয়ের ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবন দারুণভাবে বিপর্যস্ত হবে এবং এটি প্রকৃতির জন্যও ভীষণ হুমকিস্বরূপ। প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট ঝুঁকিগুলো চূড়ান্ত পর্যায়ে ভূমিক্ষয়, ভূমিকম্প, পানি এবং ভূমির লবণাক্ততা, দূষণ এবং আর্সেনিক দূষণ নিয়ে আসছে। ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন নিয়ে আসছে। ভূমির পাললিক শিলার ভীষণ ক্ষতি করছে। উপকূলীয় এলাকায় ভূগর্ভস্থ গভীর নলকূপের পানি হয়ে উঠেছে বর্তমান একমাত্র পানীয় জলের উৎস। কিন্তু এই পানির অতিরিক্ত উত্তোলন প্রকৃতিতে প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে আসছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে গলে যাচ্ছে পর্বত শিখরের বরফ আর মেরু অঞ্চলের হিমবাহ। ফলে সমুদ্রের পানির স্তর আরও উপরে উঠে আসতে শুরু করেছে। এক সময় সমুদ্রের লোনা পানি প্লাবিত করবে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। যার প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়ে জনজীবনে।

১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আবহাওয়া সংক্রান্ত দুর্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতির পরিমাণ ৯৪৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। চীনের ক্ষতি হয়েছে ৪৯২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, জাপানের ৩৭৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ভারতের ক্ষতি হয়েছে ৭৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। গত ২০ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্বের সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৯০৮ বিলিয়ন ডলার। যা মোট ক্ষতির ৭৭ শতাংশ। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চরম আবহাওয়ার প্রভাব নিয়ে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

আসন্ন দুর্যোগ বিবেচনা করে বাংলাদেশ নানা উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা থেকে শুরু করে নিম্নমাত্রার কার্বন ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি নিরূপণে বাংলাদেশকে এ পর্যন্ত ৫০ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনার বড় ধরনের সাফল্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে দেশের আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা। এর কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষ দুর্যোগের আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ ও সময় পাচ্ছে। আবহাওয়া পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশের মোট ব্যয়ের ৭০ শতাংশেরও বেশি সংগ্রহ করা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে। বাকিটা দিচ্ছে উন্নয়ন সহযোগীরা। তবে সমুদ্রস্তর বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ যেখানে বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সেখানে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আরো বড় ধরনের উদ্যোগ হাতে নিতে হবে। আবহাওয়ার বৈরিতার সঙ্গে সঙ্গতি বিধানের জন্য আর্থ-সামাজিক ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থা অবলম্বন করা দরকার।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ। আবহমান কাল থেকেই এমন ভৌগলিক ও আবহাওয়া বৈরিতার সঙ্গে যুদ্ধ করে বসবাস করে আসছে বাংলার মানুষ। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও ডিজিটাল প্রযুক্তির অগ্রগতি হওয়ায় দুর্যোগ পূর্বাভাসে সক্ষমতা বেড়েছে। মহাকাশে উড়ছে জয়বাংলা খচিত ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’। সেখান থেকে দুর্যোগকালীন সুবিধা নেওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও অত্যাধুনিক নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সঠিক ও সময়োচিত সকল আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের পূর্বাভাস দিয়ে জনসাধারণকে সচেতন করার কাজে সদা তৎপর বাংলাদেশের আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা। আগে থেকে বাংলাদেশে আবহাওয়া দফতরের নিখুত পূর্বাভাসের কারণে প্রস্তুতি গ্রহণের সময় পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর। পূর্বাভাসের মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন ও সতর্ক করায় জীবন ও সম্পদ হানির পরিমাণ আগের চেয়ে বহুলাংশে কমে গেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাতেও রোল মডেলের সম্মান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তবুও আমাদের নিজেদের আরও সচেতন হতে হবে। শুধু নিজের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নয়। আমাদের ভাবী প্রজন্মকে সুস্থভাবে বাঁচানোর জন্য। ‘এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি’ এটাই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়