ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

সৌরবিদ্যুৎ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আশার আলো

শানু মোস্তাফিজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২২, ২০ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৫:২৩, ২০ জানুয়ারি ২০২১
সৌরবিদ্যুৎ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আশার আলো

কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ি পেরোলেই সারাডবচর। সন্ধ্যা হলে সেখানকার ঘরে ঘরে মিটমিট করে আলো জ্বলে। লোকজন ভিড় জমায় দোকানে টেলিভিশনে খবর দেখার জন্য। রাস্তায় টর্চের আলোর বদলে সড়কবাতিও জ্বলে।

চরের গনগনে উত্তাপে নদীতে সময় নিয়ে গোসল করে না আজকাল কেউ। ঘরে পাখার বাতাসে আরাম করে বসে থাকে। মুঠোফোনে চার্জ দেওয়ার জন্য নদী পেরিয়ে এখন আর কাউকে অসময়ে বাজারে যেতে হয় না। জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য এখন আর তাদের ডিজেল বইতে হয় না। চরবাসী বলছেন, ‘এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে সৌরবিদ্যুতের কল্যাণে। দুর্গম এ চরে কখনো বিদ্যুতের মতো আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ পাব, তা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি। মনে হচ্ছে এবার আমাদের দিন বদল হবে। বহু কষ্টের পর আমরা আরাম পাচ্ছি, আমাদের আরও উন্নতি হবে।’

গ্রামবাসী ঠিকই বলেছেন। দুর্গম চরাঞ্চল কিংবা প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় সৌরবিদ্যুৎ সত্যিই আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ। এতে তাদের বহু সমস্যা কেটে যায়, আশা জাগায় মনে।

সৌরবিদ্যুৎ কী? সৌরবিদ্যুৎ সাধারণত খোলা জায়গায় আকাশের দিকে তাক করে রেখে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্দিষ্ট প্যানেলে তৈরি হয়। সূর্যের কিরণে যে শক্তি আছে, সেই শক্তি প্যানেলে রাখা পলিক্রিস্টাল বা মনোক্রিস্টাল দিয়ে তৈরি ছোটো ছোটো সেলগুলো ফটো ভোরটেক্স পদ্ধতিতে চার্জ হয়ে তা বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তর হয়। সহজ কথায়, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদিত হয় সৌরবিদ্যুৎ। এটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবেও পরিচিত। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম লক্ষ্য হলো- গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এবং ডিজেলের ওপর নির্ভরতা কমানো। ফলে কমবে কার্বন নিঃসরণ এবং সরকারি ভর্তুকি।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) জনসংযোগ পরিচালক সাইফুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে ২০১৯ সালে গড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল এবং আমরা তা মেটাতে পেরেছি। চলতি বছর ২০২০ সালে চাহিদা ১৪ হাজার মেগাওয়াট। এ বছরও সেটা আমরা আশা করছি পূরণ করতে পারব। বিদ্যুতের এই চাহিদা মেটাতে আমরা সরকারিভাবে এবং বেসরকারিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। কিছু বিদ্যুৎ ভারত থেকে আমদানি করছি।’

প্রধানমন্ত্রীর ১০ উদ্যোগের একটি ‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’, যার অর্থ প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে এই কর্মসূচি শতভাগ কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এমনকি চরাঞ্চলেও বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি কিংবা সৌরবিদ্যুৎকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। সরকারের পরিকল্পনা বিদ্যুৎ চাহিদার শতকরা ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থেকে আসবে। এজন্য বেসরকারিভাবে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ থেকেও বিদ্যুৎ কিনছে সরকার। ২০১৭ সালে জামালপুরের সরিষাবাড়ির শিমলাবাজারে আট একর জমির ওপর গড়ে তোলা সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেশের প্রথম সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, যেখান থেকে তিন মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যাচ্ছে। এই সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে ‘এনগ্রিন সোলার প্ল্যান্ট লিমিটেড’।

দেশে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি ও সৌরবিদ্যুতের ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তাদেরকে সরকারের দুটি প্রতিষ্ঠান সরাসরি সহায়তা করছে। এক. সাসটেইনেবল অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (স্রেড) এবং দুই. ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল)।

স্রেডের সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে কাজ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানের সহকারী (সোলার-২) পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার পাভেল মাহমুদ বলেন, ‘মানুষ কীভাবে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করবে, এ বিষয়ে আমরা একটি গাইডলাইন তৈরি করেছি। নীতিমালা তৈরি এবং প্রমোশনাল বিষয়গুলো যেমন- সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে উদ্ভাবিত নতুন নতুন প্রযুক্তিও স্রেডের আওতাভুক্ত।

ইডকল সরকারের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সোলার প্ল্যান্ট স্থাপনে ইডকল ঋণ দিয়ে থাকে এবং তাদের পার্টনার অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে কাজ করে। ইডকলের করপোরেট অ্যাফেয়ার্সের ইউনিট প্রধান নাজমুল হক ফয়সাল বলেন, ‘ইডকল সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে কাজ করছে। আমরা বিভিন্ন গার্মেন্ট, শিল্পকারখানা ও বাসাবাড়িতে সোলার স্থাপন করেছি। এছাড়া সেচকাজ এবং চরাঞ্চলেও সৌরবিদ্যুৎ ছড়িয়ে দিয়েছি। ইডকল দেশে ১৮ মিলিয়ন মানুষের কাছে সৌরবিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ১২ ভাগ। ইডকল গ্রাহকদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে একটি কল সেন্টার (১৬৬৫৩) চালু করেছে। এখানে যে কেউ ফোন করে তার সোলার প্ল্যান্ট নিয়ে সুবিধা-অসুবিধার কথা জানাতে পারেন।’

নাজমুল হক ফয়সাল আরও বলেন, ‘সৌরবিদ্যুৎকে মানুষের কাছে সহজলভ্য করার জন্য আমরা নানা উপায়ে চেষ্টা করছি। এমনকি হিমাগারগুলোয়ও সৌরবিদ্যুৎকে জনপ্রিয় করে তুলেছি। সেখানে দিনের বেলা সৌরবিদ্যুৎ এবং রাতে স্বাভাবিক বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়।

সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের স্থান নির্ধারণের ডিজাইন ও প্ল্যান্ট স্থাপন ইত্যাদি কাজ করার জন্য কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ‘সোলারএন বাংলাদেশ লিমিটেড’ এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান। তারা বাংলাদেশের যে কোনো জায়গায় সোলার সিস্টেম নিয়ে কাজ করে। যে কোনো বাসা, অফিস বা ফ্যাক্টরিতে তারা সোলার সিস্টেম করে দেয়। প্রতিষ্ঠানটির টেকনিক্যাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার শাহীন আজাদ বলেন, ‘কেউ সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করতে চাইলে জায়গা নির্ধারণ এবং সুযোগ-সুবিধা বুঝে ডিজাইন করে সোলার প্যানেল কেনা থেকে শুরু করে তা সেট করে দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটা আমরা করে থাকি। সৌরবিদ্যুতের সুবিধা হলো খুবই কম খরচে বিদ্যুতের ব্যবহার। অসুবিধা হলো- যেখানে প্যানেল লাগানো হয়, সেখানে যদি দীর্ঘদিন ছায়া থাকে তাহলে প্যানেলগুলো নষ্ট হতে পারে। মনে রাখতে হবে, প্যানেলগুলো যেন পরিষ্কার থাকে। এগুলো যত বেশি পরিষ্কার থাকবে, তত বেশি শক্তি পাবে। এজন্য প্রত্যেক সপ্তাহে একবার প্যানেলগুলো পরিষ্কার করতে হয়। প্যানেলগুলো এমনভাবে তৈরি যে এগুলো ২৫-৩০ বছর ভালো থাকবে। এছাড়া তেমন কোনো সমস্যা হয় না।’

সৌরবিদ্যুৎ শুধু বাসাবাড়ি বা অফিস, কারখানায়, নানা ক্ষেত্রে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। সোলার ইরিগেশন, সোলার ওয়াটার হিটার, সোলার ড্রিংকিং ওয়াটার সিস্টেম, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, ইমপ্রুভড কুক স্টোভ, সোলার স্ট্রিট লাইট, সোলার টেলিকম টাওয়ার হিসেবেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে। চরাঞ্চলে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার এসব প্রান্তিক মানুষের জীবনকে সহজ করে তুলেছে। তারা হয়ে উঠেছেন জীবনের প্রতি আশাবাদী।

সৌরবিদ্যুতের এত ব্যাপক ব্যবহার মানুষকে আরও আশাবাদী করে তুলেছে। ঢাকা শহরে যেভাবে দূষণ বাড়ছে, তাতে এ শহরে বাস করা দিন দিন অনেক কঠিন হয়ে উঠছে। আর এজন্যই কথা উঠেছে ঢাকা শহরের এ দূষণ কমাতে কিংবা পরিবেশ রক্ষার জন্য গাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করার বিষয়টি। গাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করার বিষয়ে স্রেড ও ইডকল জানায়, বিশ্বের অনেক দেশেই ইলেকট্রিক গাড়ি আছে। সেগুলো ব্যয়বহুল, তবে এতে দূষণ কম হয়। ইডকল বলছে, তারা নৌকা ও ভ্যানে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করার কথা ভাবছে। এ বিষয়ে পরীক্ষামূলক কাজও হচ্ছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে। তারা ব্র্যাকের অ্যাম্বুলেন্সেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। তবে গাড়ির বিষয়টি নিয়েও ভাবতে চায় তারা। স্রেড বলছে, গাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ সরাসরি ব্যবহার করা যাবে না। সৌরবিদ্যুৎচালিত চার্জ স্টেশন থাকতে পারে। সেখানে গাড়ি চার্জ নিতে পারে। যদিও অটোরিকশাগুলো সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে ব্যাটারিতে চার্জ নিয়ে অনেক জায়গায় চলছে। স্রেড আরও জানায়, গাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে তারা গাইডলাইনও তৈরি করছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং বায়ুদূষণ গবেষক অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম বলেন, ‘এটি হলে ভালো হতো। উন্নত দেশগুলোয় বহু আগে থেকেই জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ হয়েছে। ফলে সেখানে দূষণ কম হয়। গাড়ি ব্যাটারিচালিত বিদ্যুৎ হোক বা সৌরবিদ্যুৎ থেকে চার্জ নিয়ে হোক- বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হলে দূষণ অনেক কমে যাবে।’
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়