ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

লাইসেন্স-ফার্মাসিস্ট ছাড়াই চলছে দেড় লাখ ফার্মেসি

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ২৪ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ২০:৫২, ২৪ জানুয়ারি ২০২১
লাইসেন্স-ফার্মাসিস্ট ছাড়াই চলছে দেড় লাখ ফার্মেসি

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত ফার্মেসি ১ লাখ ৫১ হাজার। গত দুই বছরে নিবন্ধন পেয়েছে ৩২ হাজার ৫৩৫টি। এ সময়ে আরও ৪৩৬টি মডেল ফার্মেসির অনুমোদন দিয়েছে অধিদপ্তর। তবে, নিবন্ধন ছাড়া কতগুলো ফার্মেসি আছে, তার সঠিক হিসাব দিতে পারেননি তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সারা দেশে প্রায় দেড় লাখ ফার্মেসি চলছে লাইসেন্স ছাড়া। এর মধ্যে প্রায় ৫৫ হাজার দোকান আছে, যেগুলো খুবই নিম্নমানের। করোনা মহামারিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ওষুধের দোকান। স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জামসহ বিভিন্ন ওষুধের চাহিদা বাড়ায় এসব দোকানের ব্যবসাও জমজমাট। করোনার কারণে তদারকি কম থাকায় নকল, মানহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জাম বিক্রি হচ্ছে এসব দোকানে। তবে এসব ফার্মেসিতে ওষুধ মজুদ, প্রদর্শন ও বিক্রয় ১৯৪৬ সালের ড্রাগস রুলস অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘দেশের সব ওষুধের দোকানে তদারকি বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেসব ফার্মেসির লাইসেন্স হালনাগাদ নেই, তাদের রিনিউ করার সময় দেওয়া হবে। আর যাদের লাইসেন্স নেই, কিন্তু দোকানের মান ভালো, তাদের লাইসেন্সের আওতায় আনা হবে। যাদের অবস্থা একেবারেই খারাপ, সেসব ফার্মেসি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক পরিচালক জাকির হোসেন রনি বলেন, ‘সারা দেশে লাইসেন্সধারী ফার্মেসি আছে প্রায় দেড় লাখ। আর লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসি আছে আরও প্রায় দেড় লাখ। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির দুর্বলতার কারণে লাইসেন্স ছাড়া এবং মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছে অনেক ফার্মেসি। এসব ফার্মেসির যেগুলো একেবারেই মানসম্পন্ন নয়, সেগুলো বন্ধ করতে হবে। তবে মানসম্পন্ন ফার্মেসিগুলোকে শর্ত শিথিল করে হলেও দ্রুত লাইসেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে।’

রাজধানীর মগবাজার, গ্রিন রোড, চান খাঁর পুল, মিরপুর রোড, বাড্ডা এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব এলাকায় অনেকগুলো হাসপাতাল থাকায় প্রচুর ফার্মেসি গড়ে উঠেছে। এগুলোর ওষুধ সংরক্ষণ ব‌্যবস্থাসহ সার্বিক অবস্থা মানসম্পন্ন নয়।

গ্রিন রোডের এক ওষুধের দোকানি বলেন, ‘করোনার সময় হুজুগে ব্যবসায়ী হিসেবে যেসব ওষুধের দোকান গড়ে উঠেছে, সেগুলোর বেশিরভাগেরই লাইসেন্স নেই। এমনকি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নিয়মনীতি না মেনে ফার্মাসিস্ট ছাড়াই চলছে এসব দোকান।’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষদিকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নির্দেশে দেশের সব জেলার ড্রাগ সুপার, সিভিল সার্জন, উপজেলায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজ নিজ এলাকার ওষুধের দোকানের তথ্য জানাতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কতটি ফার্মেসি আছে, কতগুলোর লাইসেন্স আছে আর কতগুলোর লাইসেন্স নেই ইত্যাদি তথ্য জানাতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে।

জানা গেছে, একটি খুচরা বা পাইকারি দোকানের ড্রাগ লাইসেন্স নেওয়ার পর প্রতি দুই বছর অন্তর নবায়নের বাধ্যবাধকতা আছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নবায়ন না হলে বিলম্ব ফি দিয়ে নবায়নের সুযোগ আছে। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও লাইসেন্স নবায়ন করছেন না অনেক ব্যবসায়ী। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলেও মেয়াদোত্তীর্ণ এসব লাইসেন্স বাতিলে কোনো উদ্যোগই নেয় না ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

সূত্র জানিয়েছে, খুচরা ওষুধ বিক্রির জন্য দুই ক্যাটাগরির লাইসেন্স দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর—মডেল ফার্মেসি ও মেডিসিন শপ।

ড্রাগ লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক থেকে তিন মাসের মধ্যে ২০০ টাকা ফি দিয়ে পাইকারি, ১০০ টাকা দিয়ে খুচরা দোকানের লাইসেন্স নবায়ন করা যায়। মেয়াদোত্তীর্ণের পর তিন থেকে বারো মাস পর্যন্ত পাইকারি ব্যবসায়ীরা ৫০০, খুচরা ব্যবসায়ীরা ২০০ টাকা ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করতে পারেন। মেয়াদোত্তীর্ণের ১২ মাসের ঊর্ধ্বে বা পরবর্তী বছরের জন্য পাইকারি দোকান ১ হাজার ও খুচরা দোকানের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়নের সুযোগ আছে। এত সুযোগের পরও সারা দেশে প্রায় দেড় লাখ ওষুধের দোকানের লাইসেন্স নেই। এদের অনেকে একেবারেই নিবন্ধন নেয়নি। কেউ কেউ নিবন্ধন নিলেও পরে আর নবায়ন করেননি।

ফার্মেসি চালু করার জন্য বাধ্যতামূলক হচ্ছে, ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে ড্রাগ লাইসেন্স নেওয়া এবং প্রত্যেক ফার্মেসিতে একজন সনদপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট থাকা। অথচ বেশিরভাগ ফার্মেসিতেই নেই ড্রাগ লাইসেন্স আর সনদপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট। এদের অনেকের বিরুদ্ধে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন রোগের স্পর্শকাতর ওষুধ বিক্রিরও অভিযোগ আছে।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মনজুর রহমান (গালিব) বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই যে কেউ যেকোনো ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে পারে। এসব বেশি বিক্রি করে লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসিগুলো। প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর ওষুধ সেবনের ফলে রোগীদের মধ্যে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে।‘ মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান না চালিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে নিয়মিত অভিযান চালানোর পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।

বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির উত্তরা শাখার সভাপতি রাসেদুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘লাইসেন্স ছাড়াই বিভিন্ন এলাকায় ফার্মেসি দিয়ে মানুষজন অবৈধভাবে ব্যবসা করছে। এসব ফার্মেসির পরিবেশ, মান ভালো না। এছাড়া, এরা কোনো ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই বিক্রি করছে অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন জটিল রোগের ওষুধ। সহজলভ্য হওয়ায় অনেকে সাধারণ অসুস্থতাতেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। একসময় এসব মানুষদের শরীরে আর অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে না। তখন সামান্য অসুখেই মৃত্যুঝুঁকিতে পড়বেন এরা। এ ব্যাপারে ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নজরদারি আরও বাড়ানো উচিত।’

ঢাকা/মেসবাহ/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়