ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ছোটগল্প || পোশাক-আশাকের সৌখিন মানুষ

দিলওয়ার হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৪, ১৬ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৪:১৬, ১৬ মার্চ ২০২১
ছোটগল্প || পোশাক-আশাকের সৌখিন মানুষ

অলঙ্করণ: অপূর্ব খন্দকার

যৌবনে পোশাক-আশাকের প্রতি খুব  নেশা ছিল আমার। সকালে এক শার্ট, বিকেলে আর একটা চড়িয়ে বেলবটম প্যান্ট, চিকন বেল্ট আর  হাইহিল জুতো পরে গটগট করে ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের কাপড় সেলাই করত শহরের নামকরা দর্জি নীলু টেলরিং অ্যান্ড আউটফিট। আমাদের বন্ধুর দোকান। টাকা-পয়সায় নিতো না। ডেলিভারি দিতে দেরি করত অবশ্য। তাতে কিছু মনে করতাম না।

গতরে মাখতাম ‘অন্তরঙ্গ’ সেন্ট। তখন শার্ট-প্যান্টের হরেক রকমের ডিজাইন ছিল, কাপড়ও আসত নানান ধরনের। পারফিউম? ব্র্যান্ডের লেখাজোকা ছিল না- জেন্টেলমেন গিভেন্সি, ওপিয়াম, লাগের ফিল্ড, আরামিস, টেলেস ব্রুট, জোভান মাস্ক, রয়াল কোপেনহাগেন, ওল্ড স্পাইস, হেই ক্যারাটে, ড্রাকার। বিস্তর খরচ হতো এসবের পেছনে। আমাদের সংসারের সর্বেসর্বা ছিলেন মা। আমার এইসব ফুটানি দেখে এক সময় অসহ্য হয়ে উঠলেন। একদিন সাফ বলে দিলেন- বাবুগিরি করতে হয় তো নিজের পয়সায় কর। আমি আকাশ থেকে পড়লাম!

তখন বাম রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছি। সকালে মিছিল-মিটিং, বৈঠক ইত্যাদি করি। বিকেলে স্টাডিসার্কেল আর রাতের দিকে গ্রামে কৃষকদের সঙ্গে উঠোন-বৈঠক। রাতে তাদের বাংলাঘরে খড়ের বিছানায় ঘুমাতেও হয় মাঝে মধ্যে। সাইকেল মারতে হয় মাইলের পর মাইল। আমার এইসব কিরিচ-মারা পোশাকে জুত হয় না। নিজের ওপর ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠি।

এক রাতে একজন ভূমিহীন কৃষকের গোয়াল ঘরে শুয়ে তার সঙ্গে গল্প করছি, হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করল, ‘মে-ভাই, আপনের শরীরথে ধরেন যে গন্দ বারাচ্চে তার এক হিশির দাম কত? আমার শরিলেতো ধরেন বুটকা গন্দ, সেসব কি আপনে সইহ্য করবার পারবেন?’ বুঝুন ব্যাপারটা।

পারফিউম, উঁচু জুতো, বেলবটম ছেড়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি, ঢোলা পাজামা আর টায়ারের স্যান্ডেল ধরলাম। টায়ারের স্যান্ডেলের মতো বিস্ময়কর পাদুকা জীবনে দেখিনি। কাদা, বালু, ইটা খেত, খাদাখন্দ  কিছুই টের পেতে দিত না আমার পাকে। মনে আছে, এক জোড়া আমি পাঁচ বছর ব্যবহার করেছি। একটুও ছেড়েনি, টুটে যায়নি বা ফেটে যায়নি। তবে আরামদায়ক ছিল না।

যতদিন স্বর্ণকমলপুরে ছিলাম ওই পোশাকই  ছিল আমার সব সময়ের সঙ্গী। কখনোই অ-স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনি। আমি আবার শার্ট-প্যান্ট আর বেলবটমে ফিরে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার পর। ওখানে সাইকেল মেরে গ্রামে যাওয়া, ব্যাপক ঘোরাঘুরি, মিটিং-মিছিলের ঝক্কি ঝামেলা ছিল না তেমন একটি। মাঝেমধ্যে কলা ভবনের সামনে মিছিল বা মধুর ক্যান্টিনে মিটিংটিটিং কিছু করতে হতো বটে, কিন্তু তার জন্যে লম্বা পাঞ্জাবি বা ঢোলা পাজামার দরকার হতো না।
আমার ধারণা পোশাকের বাবুগিরির ধাচটা আমার রক্তের ভেতর শেকড় গেড়ে বসেছিল, পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে তা শুধু দমিত ছিল কিছু দিন।

এ সময় বড় দুটি কাণ্ড ঘটে- সন্ধ্যে বেলায় একটা বিদেশি রেডিওতে নিউজ প্রডিউসের খণ্ডকালীন কাজ পেয়ে যাই মোটা অঙ্কের সম্মানীতে, আর প্রেমে পড়ি। সেই মেয়েটিও ছিল পোশাকের সৌখিন। পৃথিবীতে নানা ধরনের পোশাকের অস্তিত্ব থাকলেও শাড়িই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। পুরুষদের সে দেখতে চাইত বাহারি পাঞ্জাবিতে। ফলে আমাকে আবারো পাঞ্জাবি গায় ওঠাতে হয়। তবে এই পাঞ্জাবির সঙ্গে আমার পূর্ব ব্যবহৃত পাঞ্জাবির বিস্তর অমিল ছিল। পাজামার বদলে পরতে হতো জিন্সের প্যান্ট। আরও যুক্ত হয় বহু বর্ণের টি-শার্ট আর কডের প্যান্ট। পরতে আরাম বলে কড আমার প্রিয় হয়ে ওঠে।

খণ্ডকালীন চাকরি আমাকে বিপুল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দান করে। পোশাক-আশাক বা অন্য কোনো কিছু কেনার জন্যে কারও মুখাপেক্ষী হতে হতো না। তখন থেকেই আমি পড়ার খরচ বাবদ বাবার কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ বন্ধ করে দেই। কোনো শাড়ি পছন্দ হলে অকাতরে প্রেমিকাকে কিনে দেই, কিনে দেই ছোট বোনকেও।

সে সময় এলিফ্যান্ট রোডের লিলি ভবনের তোতলায় পাশাপাশি দুটো তৈরী পোশাকের দোকান চালু হয়। একটা ‘বিড়ালের চোখ’ অন্যটা ‘শীলমাছ’। বিড়ালের চোখের শার্ট অচিরেই আমার ক্রেজ হয়ে ওঠে। ওখানকার সেলসম্যান সেলিম সাবুর সঙ্গে আমার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। শোরুমে নতুন ডিজাইনের কোনো শার্ট-প্যান্ট এলে সে আমার হলে এসে খবর দিত, কেনার সময় কর্তৃপক্ষকে বলে আমার জন্যে মোটা অঙ্কের কমিশন আদায় করে দিত। শুধু তাই নয়, নতুন পোশাক এলেই সে আমার প্রেমিকাকে ফোন করে দিত। সে একটা কিনে আমাকে উপহার দিয়ে চমক লাগাত।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আমি একটা খ্যাতনামা কর্পোরেট হাউজে যোগ দেই। যেখানে কেতা হিসেবে কেতাদুরস্ত থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল। তবে ক্যাজুয়াল পোশাক-আশাক পরবার অনুমোদন ছিল না। সেখানে যে রীতিতে বাধা পরতে হয় তার নাম হোয়াইট কলার কালচার। এ সংস্কৃতির প্রতি অনুগত আমাদের প্রতিষ্ঠান চাইত তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী বিশেষ কোনো চমকপ্রদ পোশাকে ক্লায়েন্টদের সামনে হাজির হোক যাতে তারা সহজেই তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, জাগাতে পারে সমীহ ও সম্মান। এ বাবদে পোশাকের রং ও ডিজাইনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হতো। অ্যাটেনডেন্ট, সিকিউরিটি বা ম্যাসেঞ্জারদের জন্যে শুধু বিশেষ ইউনিফর্মের ব্যবস্থা ছিল।

আমরা হালকা রঙের শার্ট, টাই আর স্যুট পরতাম। ফলে বিড়ালের চোখ বা শীলমাছের পোশাক পরার সুযোগ কমই পাওয়া যেত। দপ্তরে পরবার জন্যে জামাকাপড় তৈরির ভালো একটা দর্জিবাড়ির সন্ধান আমাকে সেলিম সাবুই দিয়েছিল যার নাম ছিল ‘চন্দ্রসূর্য’।

বিড়ালের চোখ কিংবা শীলমাছ থেকে প্রায়ই কাপড় কিনি। চন্দ্রসূর্য থেকে শার্ট-প্যান্ট বা স্যুটও বানানো হয় বিস্তর। সব পরা হয় না। একটা ওয়ার্ডরোবে জায়গা হয় না বলে আরেকটা কিনেছি। সেটাও এখন উপচে পড়ছে। আমার স্ত্রী প্রায়ই আমাকে নিবৃত্ত করতে চান; কিন্তু তার কথায় কান দিই না। বানাতেই থাকি, কিনতেই থাকি।
আমাদের শোবার ঘর ওয়ার্ডরোব আর চেস্টারড্রয়ারে ভরে ওঠে। ঘর থেকে অন্যসব আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলতে হয়। শার্ট, প্যান্ট, স্যুট, পাজামা, পাঞ্জাবি, টিশার্ট আমার চিন্তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে যে আর কিছু ভাবা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেলিম সাবু পর্যন্ত আমাকে ক্ষান্ত হতে বলে। কিন্তু আমি পরোয়াহীন। তবে বেশ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে এসব করতে।  খুব যে বড় চাকরি করি তা-ও নয়। খুব যে টাকা এমনও নয়। তাহলে? নেশাই হবে তাহলে। কোনো একটা নেশা না থাকলে নাকি জীবন পানশে হয়ে যায়। মদ, গাজা, আফিম, ভাং, হেরোইন, ইয়াবা, পান, বিড়ি, সিগারেট, জুয়ো, মেয়ে মানুষ সবই জীবনে আসে নেশার টানে। এই যে নর-নারীর এত প্রেম, এত ভালোবাসা সে-ও তো নেশাই, না হলে কেটে যায় কেন? কেনই বা বদলে যায় প্রেমিক বা প্রেমিকা? ক চলে গেলে খ আসে। খ চলে গেলে আসে গ। সেই প্রাচীন অচেনা এক পথ ধরে। আর জগতের সব চেয়ে মজার জিনিস সেক্স যা থেকে আসে আনন্দ, আমি বলি ক্ষণিকের আনন্দ- সেও তো  এক ধরনের নেশা, যদি প্রজননের ব্যাপারটাকে বাদ দেওয়া হয়।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সিকিউরিটি গার্ড, একজন অ্যাটেন্ডডানট আর একজন জুনিয়র অফিসার ছাড়া সবাই চলে গেছে। জুনিয়র অফিসার খুটখুট করে পেন্ডিং কাজ করছে কখন থেকে। তার কীবোর্ড অবিরাম খুরধ্বনি তুলছে। একাধিক মসজিদ থেকে যুগপৎ আজান ভেসে এলে কেমন একটা ক্যাওটিক শব্দধ্বনি সৃষ্টি হয়। আজকাল কার আজানে সুরমাধুর্য নেই। কেমন যেন মেকানিক্যাল। বেলালের আজানের সুরের যে শাব্দিক চিত্রকল্প ছোট বেলা থেকে মনে গেঁথে আছে তার ছিটেফোঁটাও নেই এখানে। চেয়ারটা ডাউন করে দু’পা যথাসম্ভব প্রসারিত করে হাতের পাতাগুলো মাথার নিচে দিয়ে একটা আয়েসী ভঙ্গী গড়ে তুললাম। লেবু চা খেয়ে সিগারেট ধরাতেই হঠাৎ করে একটা গল্প মনে পড়ে গেল। সম্ভবত প্রথম শুনেছিলাম বাবার মুখে, ছোটবেলায়:

পারস্যের নামজাদা কবি, চিন্তক ও পণ্ডিত শেখ সাদী প্রায়ই সম্রাট জালাল উদ্দিন শাইয়ুতির কাছ থেকে দাওয়াত পেতেন। সম্রাট তাঁর সঙ্গে নানান বিষয়ে গল্প করতেন, কখনো কখনো পরামর্শ নিতেন বিভিন্ন বিষয়ে। কবিবর সব সময় সাদামাটা পোশাকেই নিজেকে রাজদরবারে হাজির করতেন। পোশাক-আশাকের প্রতি নজর ছিল না তাঁর। একদিন সম্রাটের কাছ থেকে এমনই এক ডাক এলে কবি চললেন রাজদর্শনে; সেই চিরাচরিত সাধারণ পোশাকে। রাজপ্রাসাদ তাঁর বাড়ি থেকে অনেক দূরে। পথেই রাত নেমে এলো।

তিনি এক অভিজাত ধনীর বাড়িতে অতিথি হলেন। ধনী লোকটি সাদীকে চিনতে পারলেন না। ফলে আদর আপ্যায়ন ভালো হলো না। তাঁকে পরিবেশন করা হলো খুব সাধারণ খাবার। পরদিন ঘুম থেকে উঠেই তিনি রাজপ্রাসাদের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। সম্রাট তাঁকে পেয়ে মহাআনন্দিত। অনেক গল্প করলেন। কবি তাঁকে পড়ে শোনালেন সদ্যরচিত নিজের কবিতা। সম্রাট নিজে খুশি হলেন। খুশি হলেন সভাষদ আর আমির ওমরাগণ। তাঁকে খেতে দেওয়া হলো জাফরানি পোলাও, শেলোবা তাহদিগ, নানান পদের রুটি, গরু ও ভেড়ার মাংস, পনির আর লতাপাতার সালাদ, গ্রিল করা টমেটোর সঙ্গে পেঁয়াজকুচি, জুস, লিন্দ শেক, খোরেস্তে ঘেমিয়েহ খোরেশ।
তিন দিন থাকার পর প্রাসাদ ত্যাগ করলেন সাদী। সঙ্গে সম্রাটের দেওয়া হরেক রকম উপহার, উপঢৌকন আর মূল্যবান পোশাক। সম্রাটের লোকজন তাঁকে পরিয়ে দিলেন ঝলমলে বসন।

প্রাসাদ থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাত ঘনিয়ে এলো। সাদী আবার ওই ধনীর গৃহে আতিথ্য নিলেন। এবারও তারা তাঁকে চিনতে পারলেন না। তবে শরীরের মূল্যবান পোশাকে আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে খুব খাতিরযত্ন করতে লাগলেন সবাই। এবার তাঁকে দামি দামি খাবার পরিবেশন করা হলো। সাদী সেসব খাদ্য না-খেয়ে তাঁর জামার পকেটে চালান করে দিলেন। তা দেখে গৃহকর্তা অবাক হয়ে এর কারণ জানতে চাইলেন। সাদী মৃদু হেসে বললেন, ‘রাজদরবারে যাওয়ার পথে কদিন আগেই আমি একরাতের জন্যে আপনাদের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম। আমার পরনে তখন উত্তম পোশাক-আশাক ছিল না বলে আপনারা আমার তেমন খাতিরযত্ন করেননি। এখন যে খাতির যত্নটা আমি লাভ করছি তার প্রকৃত দাবিদার আমার গায়ের এই পোশাক, তাই এগুলো তাকেই নিবেদন করছি।’

একথা বলে সাদী নিজের পরিচয় দিলেন। তাঁর পরিচয় জেনে গৃহস্বামী খুব লজ্জা পেলেন আর কবির কাছে বারবার ক্ষমা চাইলেন।

জুনিয়র অফিসার বলল, ‘স্যার যাবেন না?’ গল্প আমাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলেছে ততক্ষণে। আমি আর একটা সিগারেট ধরিয়ে বললাম, ‘চলুন বেরুনো  যাক, রাত হয়েছে।’
রাতের রাস্তা মানুষ, রিকশা আর গাড়িতে সয়লাব। একটা ঠেলাগাড়ি আমাদের প্রায় ধাক্কা দিয়ে চলে গেল। মাল বোঝাই। আমি পেছনের চালকের দিকে তাকালাম। একটা ছেঁড়া লুঙ্গি শক্ত করে গেঁড়ো দিয়ে পরে আছে। গায়ে জামা নেই, মাথায় পুরনো রংচটা একটা গামছা বাঁধা, খালি গা। আমি লোকজনের শরীরের দিকে তাকালাম। অধিকাংশ মানুষের গায়ে জামা নেই।
পাশাপাশি হাঁটছে জুনিয়র অফিসার নাজমুল হক। প্রায় দু’বছর আমার আন্ডারে কাজ করছে, কোনো দিনও তার শরীরের দিকে তাকাইনি। আজ তাকালাম। বললাম, ‘নাজমুল আপনার সার্ট কোন ব্র্যান্ডের?’
‘তা তো বলতে পারবো না স্যার, ঢাকা কলেজের উল্টো দিকের ফুটপাত থেকে কিনি। কেন স্যার?’
‘না এমনি।’
‘আপনারটা স্যার?’
‘মৌসুমী বৃষ্টি। নামটা বেশ পোয়েটিক, তাই না?’
‘রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জসীমউদদীন এইসব সব-তাই না?’

আমি হাসি। রিকশায় একসঙ্গে নীলক্ষেত অবধি যাই। মোড় থেকে নাজমুল মিরপুরের বাস ধরে। আমি পুরনো বইয়ের দোকানের গোলকধাঁধার ভেতর ঢুকে পড়ি। মোস্তফার দোকান থেকে কুড়ি টাকা দিয়ে পোকায় কাটা জীর্ণ একটা বই কিনে গলির আরও ভেতরে ঢুকে পড়ি। মানিকের দোকানে এক কাপ লেবু চায়ের অর্ডার দিয়ে বসে থাকি। মানিক একটা গোল টিনের বাসনে ছটি গ্লাস বসিয়ে কেতলি থেকে লিকার ঢালছে। গ্লাসে চিনি দেওয়া ছিল। সে চামচে কনডেন্স মিল্ক দিয়ে গ্লাস গুলোর ভেতর টুংটাং করে জলতরঙ্গ বাজাচ্ছে। জলতরঙ্গ বেশ ক’টা পেয়ালায় পানি রেখে কাঠি দিয়ে বাজানোর বাজনা। এক সময় রেডিওতে শুনতাম। এখান আর শোনা যায় না।

মানিক লেবুচা এগিয়ে দিলে ওর দিকে তাকালাম- ময়লা একটা লুঙ্গি পরে আছে, গায়ে কোনো জামা নেই। বইটা খুললাম- লেবিরিনথস, সিলেকটেড স্টোরিজ অ্যান্ড আদার রাইটিংস, হোরহে লুইস বোরহেস, এডিটেড বাই ডোনাল্ড এ. তারপর পোকার পেটে গেছে অক্ষরগুলো। তার নিচে লেখা- প্রিফেস বাই আদ্রে মারোয়া।
‘চা জুড়াইয়া যাইতাছে স্যার, খাইয়া লন আগে।’ মানিক তাড়া দিল । তা সত্ত্বেও পড়তে লাগলাম:    
He is akin to Kafka, Poe, sometimes to Henry James and Wells, always to Valery by the abrupt projection of his paradox in what has been called " his private metaphysics."

চায়ে চুমুক দিয়ে আবার পড়তে লাগলাম:

His sources are innumerable and unexpected. Borges has read everything, and especially what nobody reads anymore : the Cabalists, the Alexandrine Greeks, mediaeval philosophers....

একটু পড়ে ক’জন বন্ধু এলো। তাৎক্ষণিকভাবে  তারা বইটার পোস্টমর্টেমে উদ্যত হলে প্রমাদ গুনলাম: এমনিতেই বইটা পেপারব্যাক, নড়বড়ে, পোকায়কাটা, পৃষ্ঠা হলুদ হয়ে গেছে। ১৯৬৪ সালের নিউ ডিরেকশন বুক এডিশন।
একজন বলল, ‘ফিকশন আছে ২৩টা, এসেজ ১০টা, প্যারাবলস ৮টা, মাত্র একখানা এলেজি। ফিকশনগুলোর নাম জানালো একজন: দ্য গার্ডেন অব ফরকিং পাথস, দ্য লটারি ইন বেবিলন, দ্য শেপ অব দ্য সোরড, ডেথ অ্যান্ড দ্য কম্পাস এবং জহির।
অন্য একজন জানালো বিখ্যাত কটি রচনা আছে। এই যেমন: দি আর্জেন্টাইন রাইটার অ্যান্ড ট্রাডিশন, ভ্যালেরি অ্যাজ সিম্বল, কাফকা অ্যান্ড হিজ প্রিকারসারস, মিরর অব এনিগমাস।
তারা জানালো বইটি গুরুত্বপূর্ণ ও আমার প্রাপ্তি নাকি বিশাল। এ জন্যে আমি তিন বন্ধুকে তিন কাপ চা ও তিনটে সিগারেট খাওয়ালাম।

ভাবলাম, এই যে এতক্ষণ ধরে এখানে যা কিছু হলো তার ভেতর পোশাক আশাক কোথায়? এখানে উপস্থিত সবাই আন্ডারওয়্যার, গেঞ্জি, সার্ট, প্যান্ট পরে আছে। তাহলে আমি কেন বিড়ালের চোখ, শীলমাছ আর  চন্দ্রসূর্য
নিয়ে এত উতলা?

তিনজনই বইটা ধার নেওয়ার জন্যে বায়না দিয়ে রাখল। আমি সেটি ব্যাগে ভরে নিউ মার্কেট কাঁচা বাজারের দিকে রওয়ানা দিলাম। বড় সাইজের জোড়া ইলিশ আর আনাজপাতি কিনে রিকশায় উঠলাম। রিকশাওয়ালার শরীরের দিকে তাকালাম। বুড়ো। কুঁচকে যাওয়া শরীর। গায়ের গেঞ্জিটা ছিঁড়ে ত্যানা ত্যানা। কাচাবাজার  থেকে রিকশা টার্ন নিয়ে মিরপুর রোডে পড়তেই দেখলাম বাম দিকে একটা কাপড়ের দোকান। হ্যাংগারে গেঞ্জি আর শার্ট ঝুলছে। রিকশা থামাতে বললাম। বুড়োকে বললাম, ‘ও চাচা মিয়া, শার্ট লইবেন না গুনজি? আপনের শরিলের ডা তো ছিঁড়া গেছে গা।’
বুড়ো বোকা বোকা হাসল। এর দাঁত নেই বেশি একটা। ফলে এর হাসিকে ফোঁকলা দাঁতের হাসি না বলে উপায় ছিল না।
‘কিনার পারুম না বাবা। ট্যাহা নাই।’
‘আপনের ট্যাকা দিওন লাগতো না। আমি কিনা দিমু। মানে খুশি হইয়া দিমু আরকি, বুঝলেন কিনা?’
এবার  ঠা ঠা হাসি। ‘কন কি? আপনে কিনা দিবেন আমারে>’
বিশ্বাসই হতে চায় না। দোকানি ছেলেটাকে বললাম, ‘চাচার  মাপের একটা ফুল শার্ট বের কর। টেকসই হওয়া চাই। দাম নিয়ে ভেবো না।’
তখন হয়তো বিশ্বাস হলো বুড়োর। কয়েকটা নেড়েচেড়ে দেখে বলল, ‘এইডা লন।’
দাম শোধ করে বুড়োকে বললাম, ‘এইবার গায়ে দেন দেহি কেমুন হইলো।’ গ্রামে গিয়ে বাবার হাতে জামা তুলে দিয়ে যে রকম বলি- গায়ে দেন দেখি আব্বা!

শার্টটা গায়ে দিয়ে সে এতো জোরে জোরে চালাতে লাগলো যে মনে হলো যে কোনো সময় উল্টে যেতে পারে রিকশা। তখন কেনো যেন মনে হলো-যাক না, যা হয় হবে।
এই বেপরোয়া ভাবনার পর একটা সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু রিকশার প্রবল গতির কারণে ম্যাচের কাঠি জ্বালাতে কয়েক বার ব্যর্থ হলাম। তখন নেশাটা চাগাড় দিয়ে উঠেছে। চিৎকার করে বললাম, ‘ চাচা মিয়া রিকশাডা থামান এট্টু।’
আমার কথা তার কানে পৌঁছুল না। মনে হলো গতি সে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বেশ একটু রাগই হলো। আবার চিৎকার করে উঠলাম। এবার অনেক জোরে। থামালো না। এক সময় দেখলাম, রিকশা পান্থপথ সিগনালে এসে থেমে গেছে।
স্বচ্ছন্দে সিগারেট ধরিয়ে বুড়োর দিকে একটা বাড়িয়ে ধরলাম- ‘নেন খান একটা।’ আবার সেই ফোঁকলা দাঁতের হাসি। সিগারেট খেতে খেতে দুজনই সুখী। আমি ধোঁয়ার রিং বানাচ্ছিলাম। বুড়ো দেখছিল। সে বোধহয় পারে না। পাশের রিকশায় একটা মেয়ে একটা ছেলেকে চুমু খাচ্ছিল। বেশ স্বচ্ছন্দে। এখানে আর কে খেয়াল করবে। করলেই বা কী?

বাসায় ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে ভাত খেলাম, ছেলেমেয়ের সঙ্গে গল্প করলাম। লেবিরিনথস থেকে ‘দ্য গার্ডেন অব ফরকিং পাথস্’  গল্পটা পড়া শেষ হলে দেখলাম একেবারে নিচে লেখা- টু বিক্তোরিয়া ওকাম্পো। নামটি শুনলে বরাবরই চমকিত হই আমি। আরহেন্তিনার লেখক ও সুর পত্রিকার নামজাদী সম্পাদক। ১৯২৫ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিজয়া’ নামের অখ্যাত এক নারীকে তাঁর ‘পূরবী’ কাব্য উৎসর্গ করেছিলেন। তখন কেউ এই নারীর পরিচয় জানতো না। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর  বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। অনেকদিন অবধি সবার ধারণা ছিল কবিগুরু ওই নারীর সঙ্গে  রহস্যময় এক প্লেটনিক প্রেমে আবদ্ধ। পরে জানা যায়, ওই প্রেম ছিল ইহজাগতিক- কামনা বাসনায় পূর্ণ। ওকাম্পো তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: কবি আমার দিকে মুখ না তুলে তাঁর হাতখানি বাড়িয়ে দিলেন- যেভাবে লোকে গাছের ডাল থেকে একটি ফল পাড়ে সেইভাবে আমার স্তনের ওপর তিনি হাত রাখলেন।... প্রায় বিদেহীভাবে আমাকে আদর জানিয়ে হাতটি অপসৃত হলো। সামান্য কয়েকটি মুহূর্তের আকস্মিক ঘটনা। দুজনের কেউই হয়তো প্রস্তুত ছিলেন না।
রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোকে তাঁর এক চিঠিতে স্পষ্টভাবেই লিখেছিলেন: আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবেসেছ। ...এই দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে অনেক বইপত্র লেখা হয়েছে। বিক্তোরিয়ার একটা বোন ছিল- সিলবিনা ওকাম্পো। তিনিও লেখক ছিলেন।

রাতে শোবার আগে ওয়ার্ডরোব ঘেঁটে আমার সবচেয়ে প্রিয় দুটি শার্ট, দুটি প্যান্ট আর একসেট স্যুট বের করে আলনায় ঝুলিয়ে রাখলাম। এখন প্রতিদিন আমি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ওই কাপড়গুলো পরি। এ ব্যাপারে কারও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখি না। সেলিম সাবু প্রায়ই আমার অফিস ও বাসায় আসে। ফোনও করে, কিন্তু একবারও কাপড় নিয়ে কোনো কথা বলে না। আমার স্ত্রী প্রায় রোজই কাজের মহিলাকে দিয়ে আমার কাপড় কাচায়, তবে পোশাক-আশাকের ব্যাপারে কোনো কথা বলে না।
রাতে আমি অফিস থেকে ফেরার পর আর সকালে অফিসে যাওয়ার আগে ওয়ার্ডরোব আর চেস্টারড্রয়ারগুলো  অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকে, তারাও কিছু বলে না।
অফিস থেকে ফিরে আমি আমি চা-টা খাই। বাচ্চাদের পড়া দেখিয়ে দেই কিংবা আইজ্যাক সিঙ্গারের ভূতের গল্প শোনাই। এখন আমি লংপ্লে রেকর্ড বাজিয়ে এম. এস. শুভলক্ষীর গান শুনি। মুগ্ধ হই। লক্ষী বিশ্বনাথনের লেখা তাঁর বিশাল জীবনীগ্রন্থ পড়ি, জানতে পারি তাঁর লম্বা নাম- মাদুরাই শানমুখভাদিভূ শুভলক্ষী। উমবেরতো একোর প্রবন্ধ পড়ে পুলক লাভ করি। তিনি লিখেছেন: আপনাদের মধ্যে যারা বয়সে ছোট, তাঁরা হয়তো জানেন যে, ভেলিনে শব্দটার মানে হলো সুন্দরী মেয়ে যারা টেলিভিশনে নাচে; আর ক্যাসিনো বলতে বোঝায় হুল্লোড়ে হট্টগোল। আমাদের বয়সীরা কিন্তু জানেন যে, ক্যাসিনো শব্দটা দিয়ে আগে বোঝানো হতো বেশ্যালয়, তারপর লক্ষণার্থে তার মানে গিয়ে দাঁড়াল: হট্টগোলের জায়গা।

আব্বাস কিয়ারোস্তামির টেস্ট অব চেরি কিংবা তারকোভস্কির নস্টালজিয়া দেখি। আব্বাস কিয়ারোস্তামির কবিতা পড়ে অবাক হয়ে যাই :
আমার নিঃসঙ্গতার
একটা বড় অংশ আমি চাই
তোমার কাছ থেকে।

এ-ভাবে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত  হওয়ার পর আমার জুনিয়র অফিসারের মাধ্যমে বসের কাছ থেকে একটা উপহারের প্যাকেট পাই। এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে সবাই চলে গেলে উপহারের প্যাকেটটা খুলি: ভেতরে একটা স্যুট পিস, দুটো শার্ট ও দুটো প্যান্টের কাপড়। সঙ্গে কিছু টাকা।
পরের দিন সকালে ফার্স্ট আওয়ারে বসের সঙ্গে দেখা করলাম। বললাম, ‘স্যার হঠাৎ এত কাপড়?’
‘না, আপনি পোশাকের সৌখিন মানুষ, হেলমুট কার্লোসের কালেকশন, নতুন এসেছে। তাই ভাবলাম...’
‘ধন্যবাদ স্যার।’

চন্দ্রসূর্য টেলরিং শপে গিয়ে অচিরেই কাপড়গুলো সেলাই করে আনলাম আর দিনের পর দিন ওগুলোই পরতে লাগলাম। আশা করছি না-ছেঁড়া পর্যন্ত আর বানাতে হবে না।... বিখ্যাত এক লেখক তাঁর এক গল্পে লিখেছেন: কোনো মানুষ একটিমাত্র শার্ট তা যতই দামি হোক, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গায়ে চড়িয়ে রেখে বোকা বা অসুখী হতে চায় না। কিন্তু আমি ওই লেখকের মতো নই। একটা মাত্র শার্ট গায়ে দিয়ে অনন্ত কাল কাটিয়ে দিতে পারি।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়