ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের গল্প || কিরণবালার অন্তিমযাত্রা

রুমা মোদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩০, ২৬ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৩:৪০, ২৬ মার্চ ২০২১
মুক্তিযুদ্ধের গল্প || কিরণবালার অন্তিমযাত্রা

অলঙ্করণ: অপূর্ব খন্দকার

তিনি বিধবা হলেন না। সত্যি শেষ পর্যন্ত তিনি  বিধবা হলেন না। এয়োতি নারীর সৌভাগ্যের শাঁখ ভাঙতে পারলো না পাড়ার নারীরা। সিঁথির সিঁদুরও মুছে দিতে পারলো না কেউ। বরং আরো লেপ্টে দিলো কপালজুড়ে। পা-জোড়া রাঙিয়ে দিলো গাঢ় রক্ত রঙের আলতায়। তিনি হরিদাসী নন। তিনি কিরণবালা। তার সিঁথির সিঁদুর মোছা গেলো না। একাত্তরেও নয়। এখনো নয়।

দায়িত্ব আর কৌতূহলের চিনির দানায় জমাট বাঁধা পিঁপড়ার মতো জমে ওঠা উঠান ভর্তি মানুষ।  পাড়ার বৌ-ঝি, বয়স্ক, আনকোরারা বলাবলি করে সেই কথা। নয়মাস ক্যাম্পে শাঁখা সিঁদুর খোলেনি কিরণবালা, শেষ পর্যন্ত তা পরেই চিতায় যাচ্ছে সে। বুঝি তার এই মিথের মতো সৌভাগ্যে গোপন দীর্ঘশ্বাসের মতো বেদনা হয়ে মিশে যায়, মিশে যায় একটা ভিন্নরকম গল্প বাতাসে মিশে যাওয়ার অনিবার্যতায়।

গায়ের মলিন ছাপা শাড়ি বদলে তার গায়ে ওঠে দুধের মতো সাদা জমিনে সূর্যের মতো লালাভ আভার পাড়ের শাড়ি। তাকে দেখতে লাগে এক অপার্থিব পরির মতো। পাড়ার বউ-ঝিরা তাই বলাবলি করে তখন। মৃত মানুষকে এতো সুন্দর দেখায়- এর আগে কখনো দেখেনি তারা! কিরণবালা যখন বউ হয়ে এসেছিলেন, সবাই কপাল কুঁচকে তাকিয়েছিল একে অপরের দিকে। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা আর একটা বাইসাইকেলের বিনিময়ে এমন গাঢ় বাদামী মেয়েকে কেউ বউ করে আনে!  পাউডার স্নোতেও যার রং ফেরে না।

কিরণবালার বিয়ের সময় বরযাত্রী সব রাগ করে রাতেই ফিরে এসেছিল বিয়ে বাড়ি থেকে। বর-কনের সাত পাক না দেখে।  তখন লেটার প্রিন্টে ছাপানো বিয়ের প্রোগ্রাম, তাতে আত্মীয় পরিজন সবার হৃদয় ঢেলে দেয়া বার্তা, সাত পাক দেখতে কলাগাছে রঙিন কাগজের শিকলে সাজানো কুঞ্জ ভেঙে হুমড়ি খেয়ে পড়া ভিড়ের যুগ, অথচ
কিছুই ঘটেনি কিরণবালার বিয়েতে। ঘটনা সামান্য।  কলাপাতায় দুধ খেতে দিয়েছিল কনেপক্ষ। গভীর রাতে হ্যাজাকের গ্যাসও তখন ফুরিয়ে এসেছিল। ঘুমে ঢুলছিল বাজনাদারেরা। সাত পাকের সময় তালে বেতালে পিটাচ্ছিল ঢাক। পিতলের সানাইয়ে বাজছিল- তু গঙ্গা সে পানি মে যমুনাকা ধারা... অদূরে শেয়ালের দল ভয় পায়নি মোটেই সেই তাল কেটে যাওয়া বাদ্যিতে। বরং অন্যদিনের মতোই কোরাসে সামান্য অবহেলা ছিল না তাদের। শুধু বিয়ে বাড়িটা সুনসান করে ফিরে গিয়েছিল বরযাত্রীর দল।

নিজেকে অপরাধী লাগে নাজনীনের। কিন্তু কিই-বা উপায় ছিল তার! আটকে পড়া মানুষটাকে কিভাবে বাঁচাতো সে। বেঁচে থাকলে না জাত, ধর্ম। হয়তো অজানা, অচেনা বেওয়ারিশ হয়ে পঁচে গলে পড়ে থাকতো রাস্তায়। তখন কে নিষ্প্রাণ দেহ উল্টেপাল্টে দেখতো সে হিন্দু না মুসলিম!

বিয়ের রাতটা মনে পড়ে নাজনীনেরও। যুদ্ধবিধ্বস্ত রাত। থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। দূরে মানুষ আর শেয়ালের অস্পষ্ট শোরগোল ছিল সেদিনও। শরগোল ছিল আর্তনাদের মতো ভয়ার্ত। দুপুরে ঠিক মাগরিবে, চারদিক যখন মধ্যরাতের মতো সুনসান, আব্বা এক ফাঁকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। জয়তুন বস্ত্রালয়ের ঝাঁপ খুলিয়ে নিয়ে এলেন একটা গোলাপি কেরোলিন শাড়ি আর একটা সিল্কের পাঞ্জাবি। দূরে কোথাও আগুনের ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে, অনিশ্চিত আগামীর বুকে, পুড়ে যাচ্ছে হাজার মানুষের যত্নের ওমে গড়া মায়ার সংসার আর আব্বাজান তাদের কবুল পড়াচ্ছেন। সবচেয়ে বড় মুরগিটার রোস্ট রেঁধেছিলেন আম্মা। বিহারী পরিবারটির কাছে শিখেছিলেন তিনি, একেবারে মোগলাই স্বাদের রান্না। পাঁচ ভাইবোন, আব্বা-আম্মা চারজন মিলে গভীর রাতে চাটাই বিছিয়ে পেট পুরে পোলাও রোস্ট খেয়েছিলেন। আর সবশেষে ঘরপালা গরুর দুধে ফিরনি। চারদিকে মৃত্যুর মতো আতঙ্ক, অতর্কিত আক্রমণের সর্বগ্রাসী ভয়, হৃৎপিণ্ডে হাতুড়ির বাড়ির মতো অস্বস্তির সাথে বসবাস। এক উসিলায় এই খাওয়ার আয়োজন যেনো জোর করে সব অস্বীকার আর ভুলে থাকার চেষ্টা। 

কিরণবালাকে কেউ সাজাচ্ছিল ফুলে-মালায়, কেউ পরাচ্ছিল নতুন শাড়ি, কেউ কপালে আঁকছিল তিলক। দুটো যাত্রায় কি বিশাল বিপুল পার্থক্য! একদিন তিলক ফুলের মালায় সাজানো হয় দুজনকেই। আরেকদিন কেবল একজনকে। অরুণ বাবু মৃত্যুকে ভয় পেতেন, শিশু যেমন ভয় পায় অদেখা ভূত, ভয়ে সিঁটিয়ে অন্ধকারে মায়ের আঁচল ধরে নিরাপদ করে নিজেকে, অরুণ বাবুও প্রায় তেমনি। কারো মৃত্যুর খবর নিয়ে ডাকপিয়ন এলে সেই চিঠি বাইরে ছিঁড়ে ফেলে হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকতেন। কারো মৃত চেহারা দেখতেন না। কারো সৎকারে যেতেন না, মৃতের উদ্দেশ্যে যে ভুঁড়িভোজ তাতেও না। মৃত্যুকে এড়াতে চাইতেন প্রানপণে, বুঝি মৃত্যু কোনো আত্মীয় বাড়ির নিমন্ত্রণ, চাইলেই এড়ানো যায়।

যুদ্ধের আগে সাত বছরের সংসার কিরণবালার। সব মনে আছে। মনেপ্রাণে প্রার্থনা করতেন, যেন অরুণ বাবুর মৃত্যু দেখতে না হয় তাকে। তিনি যেনো শাঁখা সিঁদুরে যাত্রা করতে পারেন শ্মশানে। স্বাধীনতার পর দেশে এসে শুনেছেন বারবার মৃত্যু অরুণ বাবুর কান ঘেঁষে চলে গেছে। তিনি বেঁচে গেছেন। আগরতলা ক্যাম্পে তিনি বেলা-অবেলায় নদীর ধার ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন শেষ ট্রেন মিস করা যাত্রীর মতো। দেশে আটকা পড়েছিলেন অরুণ বাবু। প্রতিদিন শিবিরমুখী হাজার মানুষের সারি, প্রিয়জন সাথে আনা, প্রিয়জন রেখে আসা মানুষ। কোনো সারিতেই অরুণ বাবু নেই, এমনকি অরুণ বাবুর খোঁজও দিতে পারে না কেউ। লাগোয়া ঘরের নিয়তি মাসিমা মাসের এমাথা-ওমাথা তাগাদা দেয়। বউয়ের শাঁখাগুলা ভেঙে দেই। আর অপেক্ষা করে কী হবে? মাসিমারই বা কি দোষ! অরুণ বাবুর খবর কেউ না দিতে পারলেও প্রতিদিন খবর আসছে ম্যাসাকার চলছে শহরে। 

মানুষ মরে পড়ে আছে রাস্তায়। কেউ বেঁচে নেই। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব। কেউ নেই। কেউ বেঁচে নেই। অরুণ বাবু কোন ছাড়! ক্যাম্পের মহিলারা সমবেদনা জানাতে জড়ো হলেই, শাশুড়ি তাদের ভাগিয়ে দিতেন। ছেলের খবর সঠিক না জেনে বউয়ের হাতের শাঁখ খুলবেন না তিনি, সিঁদুরও মুছবেন না। তবু রাত করে ঘুমালেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসতেন কিরণবালা।  জোর করে তার হাতের শাঁখ খুলে নিচ্ছে নিয়তি মাসীমা, সুষমা কাকীমা...। সকালে ঘুম ভাঙলে জানতেন এ স্বপ্ন। সত্যি নয়। সর্বদা শাঁখা সিঁদুর হারানোর ভয় তাড়া করে ফিরতো তাকে। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তার, এই শাঁখা সিঁদুরের গুণেই পাকিস্তানি নির্দয় হার্মাদের হাত থেকে বেঁচে ফিরবে তার স্বামী।

ডিসেম্বরের সতেরো তারিখ ট্রাক থেকে নেমে হাইস্কুলে চিড়া গুড় খেয়ে বাড়ির ধ্বংসস্তূপে ফিরে কিরণবালা পাগলের মতো খুঁজছিলেন অরুণ বাবুকে। চিহ্নমাত্র না-পেয়ে তিনি ধপাস করে জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলেন মাটিতে। তারপর প্রতিদিন একটু একটু করে মাথা গোজার খুঁটি বাঁধতে গেলে বেঁচে থাকা পড়শিরা দেখাতো এই খুঁটিতে বেঁধেছিল অরুণ বাবুকে মেরে ফেলার জন্য। কামরুল সাহেব টাকার বাক্স এনে দিলে রাইফেল নামিয়ে চলে গিয়েছিল পাকিস্তানিরা।

পুকুরে নাইতে নামলে দুয়েকজন পড়শী হাত তুলে দেখাতো মাঘের হিমে এখানে গলা পানিতে দাঁড় করিয়ে রেখে পাশের বিহারী বাড়িতে বিরিয়ানি খেতে গিয়েছিল পাকিস্তানিরা। বিহারী মেয়ে দুটোর  গজলের সুমিষ্ট সুর অন্ধকার ভেদ করে কম্পন জাগাতো বিধ্বস্ত পাড়ায় পাড়ায়। অরুণ বাবু সেই ফাঁকে সাঁতরে নদী পার হয়ে লুকিয়ে যেতেন ঝোঁপের আড়ালে। ভরপেট খেয়ে গানের সুরে কিংবা আরো কিছুতে মাতাল সৈনিকেরা ভুলে যেতো পুকুরে কাউকে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিল তারা। জিপের ধুলো উড়িয়ে চলে যেতো ক্যাম্পে।

পরেরটুকু নাজনীন নিজেই বলে, এইভাবে কয়বার? সেই মাঘের শীতে পুস্কনির পানিতে দাঁড়াইয়া সে কি জ্বর,  পাঞ্জাবির গুলিতে যে দম যায় নাই, সেই দম বুঝি এবার কাশতে কাশতে যায়। তিন গাঁ খুঁজে ডাক্তার আনিয়েছে আব্বা। ডাক্তার তো বলেই খালাস। ওষুধ খাওয়ায় কে, পথ্যি বা কে এগিয়ে দেয়! শেষে আব্বা কালেমা শিখাইয়া নিকাহ পড়াইয়া দিছেন।

পড়শীদের কাছেও শোনে বাকিটুকু কিরণবালা। পাঞ্জাবিদের হাত থেকে বারকয়েক অরুণ বাবু ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও শেষ রক্ষা করেছে নাজনীনের বাপই, নাজনীনের জামাইকে এরপর আর দাঁড়াতে হয়নি রাইফেলের সামনে। টুপি পরা, কালেমা জানা লোকটির দিকে আর তাকায়নি পাঞ্জাবীরা। স্বাধীনতার পর বিহারী পরিবারটি নিখোঁজ হয়ে গেলে নাজনীন আর আব্দুল হাদিকে সেই বাড়িতে নিজের হাতে উঠিয়ে দেয় নাজনীনের আব্বা। সিন্দুক ভর্তি চিনামাটির বাসন কোসন, নকশা করা খাট আলনা, কাঁচের দেরাজ ভর্তি কাপড় চোপড়, এমনকি রান্নাঘরে হলুদ মরিচের সাথে জায়ফল জয়ত্রি আর হামানদিস্তা। কিরণবালার সর্বস্ব গেছে আর নাজনীনের সব জুটেছে। 

নাজনীন আর অরুণ বাবুর সংসারের খবর পেতো সে ঘরে বসেই। ছোট্ট থানা শহর। সবার হাঁড়ির খবর সবাই জানে। নাম বদলে অরুণ বাবু তখন আব্দুল হাদি। মাঝেমাঝেই বিকাল বিকাল কিরণবালা যেতো নাজনীনের বাড়ি। সে তো বিয়ের আগের অভ্যাস। নতুন টকি কিংবা শেখ মুজিবের গল্প, কিছুই বাদ পড়তো না। নাজনীন জোর দিয়ে বলতো, আব্বায় কইছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মিথ্যা না। একদম হাছা। তর্কে ক্ষেমা দিতো কিরণবালা, সেও তো মিছা জানে অরুণ বাবুর কথাতেই। কে যে সত্য কয় আর কে যে মিথ্যা কয়- কেমনে বুঝে!

নাজনীন  পিঁড়া পেতে বারান্দায় বসতো পানের বাটা নিয়ে। কতো যে রাজ্যির গল্প জমে আছে দুজনের। কিরণবালা বলতো শরণার্থী শিবিরে পাতলা ডাল আর লাবড়া খেয়ে কলেরায় কতো মৃত্যু যে দেখেছে চোখের সামনে। দুই বছরের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধ। দুচোখে গড়াতো তার বেঁচে থাকার আনন্দাশ্রু। সে তো বেঁচে আছে বলতে গেলে না খেয়ে। খেলে সেও মারা পরতো কলেরায়। নাজনীন সেই অসহনীয় দুর্ভোগের গল্প শুনতে শুনতে শেষমেশ হাত ধরে বলতো,  কিরণদি তুমি আরেকটা বিয়ে করো। 
ধুর তাই কি হয়? আমি শাঁখা সিঁদুরে আছি। সেই গুণে ভালো থাকুক সে। এই এক কথার উত্তরের ঝাঁঝ অতিক্রম করে আর কিছু বলার সাহস করতো না নাজনীন। বলতেও পারতো না- অরুণদারে ফিরাইয়া নাও। হিঁদু ধর্মে নাকি ফিরে যাওয়ার রীতি নাই।  তাছাড়া লোকটার উপর যে মায়া পড়ে গেছে তাই বা অস্বীকার করে কোন লাজে? 
মানুষটার আসার সময় টের পেলেই তড়িঘড়ি পালাতো কিরণবালা। কোনদিন মুখোমুখি হতো না তার। কিন্তু লোকটার উপর মায়া এই কিরণবালারই বা কম কিসে ছিল?  ঠিক পাঁচফোড়ন দেওয়া এঁচোড়ের দোলমা আর মোচার ঘন্ট দিয়ে যেতো মনে করে। জন্মদিনে চিনিগুড়া চালের পায়েস দিতে এতোগুলো বছরে একবারও ভুল করেনি কিরণবালা। শাঁখ সিঁদুরে এয়োতি নারীর বেশে ঘুরে বেড়াতে কোনো কুণ্ঠা নেই তার। শুনেছে বেঁচে থাকতে অরুণের মা অনেকবার বিয়ে দিতে চেয়েছেন কিরণবালাকে। রাজি করাতে পারেননি।

নিজেকে অপরাধী লাগে নাজনীনের। কিন্তু কিই-বা উপায় ছিল তার! আটকে পড়া মানুষটাকে কিভাবে বাঁচাতো সে। বেঁচে থাকলে না জাত, ধর্ম। হয়তো অজানা, অচেনা বেওয়ারিশ হয়ে পঁচে গলে পড়ে থাকতো রাস্তায়। তখন কে নিষ্প্রাণ দেহ উল্টেপাল্টে দেখতো সে হিন্দু না মুসলিম! পাশাপাশি বাড়িতে দৌড়ে ঝাঁপিয়ে, গোল্লাছুট, বৌচি খেলে, এক পুকুরে একসাথে বড় হওয়ার দায় ছিল যে নাজনীনের। অরুণ বাবুকে বাঁচানোর দায় ছিল। না কবুল পড়ার দায় ছিল না কোনোকালেই। নেহায়েত স্বামী তালাক দিলে সে অনাহুত বসে ছিল বাপ ভাইয়ের সংসারে। হায় এক যুদ্ধ কতো হিসাব-নিকাশ বদলে দেয় মানুষের।

নাজনীন জোর দিয়ে বলতো, আব্বায় কইছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মিথ্যা না। একদম হাছা। তর্কে ক্ষেমা দিতো কিরণবালা, সেও তো মিছা জানে অরুণ বাবুর কথাতেই। কে যে সত্য কয় আর কে যে মিথ্যা কয়- কেমনে বুঝে!

মানুষটাকে এতো বছরেও পুরোপুরি চিনে উঠতে পারেনি নাজনীন। কোনোদিন শোনেনি ভুল করেও কিরণবালার বাড়ি, যা তার নিজেরও বাপের ভিটা, সে পথ মাড়িয়েছে সে। এঁচোড়ের তরকারি, মোঁচার ঘন্ট দিয়ে কি তৃপ্তি নিয়ে খায় সে। ঠিক জানে এর উৎস কী! তবু কোনোদিন একটু বাড়তি আগ্রহ নেই, প্রশ্ন নেই, কৌতূহল নেই। এমনই অচেনা এক ধোঁয়ায় আড়াল দাম্পত্য তার; এতো বছরের। কতোদিন ইচ্ছের কাছে নতি স্বীকার করে, বুকে কৌতূহল আর ঈর্ষার পাথর চেপে লোকটাকে  জিজ্ঞেসই করে ফেলেছে সে- কিরণবালারে একবারও দেখতে মন চায় না আপনের? একবারও না? নিশ্চুপ, নির্বিকার লোকটা ছাতা আর গামছা কাঁধে হেঁটে চলে গেছে বাজারমুখী।

নাজনীন ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নেয়- বাড়ি ফিরলে লোকটাকে আজ শেষ দেখা দেখতেই পাঠাবে সে। সবই তো শেষ হয়ে গেছে আজ। এই শহরে যুদ্ধের সবচেয়ে জীবন্ত গল্পটা, সব গল্প ছাপিয়ে যার বিস্তার ছুঁয়ে গেছে ঘরে ঘরে বিষণ্ন বিকাল, নির্জন দুপুর। যে গল্প এই শহরের কাউকে একাত্তর ভুলতে দেয়নি। আজ হুয়তো কিরণবালার চিতায় ওঠার সাথে সাথেই ফুরিয়ে যাবে তা। কিংবা কে জানে হয়তো যুদ্ধের সৌধের মতো টিকেও থাকবে কিরণবালার গল্প।

ঘড়ির কাঁটা আগায় নিজস্ব গতিতে। লোকটার আগমনের সময় পার হয়ে যায়। সে আসে না। বাজার থেকে ফিরতে এতো দেরি করে না তো কোনো দিন। দূর থেকে শ্মশানযাত্রার হরিনাম শোনা যায়। একলা দাওয়ায় বসে কয়েক ঘণ্টা সময় কেটে যায় কয়েক মুহূর্তের মতো। একসময় শেষকৃত্য সেরে ফিরে আসা দলের হরিনামও কানে আসে নাজনীনের। তখন কি পায়ের শব্দ শোনা যায় আব্দুল হাদিরও? সেও কি তবে যাত্রী হয়েছিল কিরণবালার শেষ যাত্রার?   
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়