ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একমাত্র ভরসা কার্ফ্যু বা কঠোর লকডাউন

শেখ আনোয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩১, ৯ এপ্রিল ২০২১  
একমাত্র ভরসা কার্ফ্যু বা কঠোর লকডাউন

বিশ্বের একাধিক দেশে আছড়ে পড়েছে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ। করোনার দাপটে কার্যত বেসামাল অনেক রাষ্ট্র। বছর ঘুরে গ্রীষ্মের শুরুতে বাংলাদেশেও ফিরে এসেছে বিভীষিকাময় দিনগুলো! শীত মৌসুমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায় বাংলাদেশে ভ্যাকসিন আসায় খানিকটা বাগে এলেও নতুন করে সংক্রমণ ক্রমশ বাড়ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।

বাংলাদেশে রোগসংক্রমণ শনাক্ত হওয়া এবং মৃতের সংখ্যা বাড়ার তথ্যই বলছে- করোনাগ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে পরীক্ষা বিবেচনায় আক্রান্তের হার ২ শতাংশের কাছাকাছি নেমে এলেও এই হার এখন প্রায় ২৩ শতাংশের ঊর্ধ্বে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন- এটি মহামারি ভাইরাসের নতুন ঢেউয়ের ইঙ্গিত। এই মুহূর্তে যেসব স্থান থেকে করোনা সৃষ্টি হচ্ছে সেসব স্থান চিহ্নিত করে করোনার উৎপত্তির উৎস ঠেকাতে না পারলে দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে পরিস্থিতি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রূপ বদলানো করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন। বাংলাদেশে করোনার ব্রিটেন স্ট্রেইনের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেইনও শনাক্ত করা গেছে। যেগুলোর সংক্রমণক্ষমতা ও মৃত্যুহার দুটোই অনেক বেশি। এর দাপটে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভাইরাসের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা খুবই কঠিন। সে বারবার চেঞ্জ করে তার চরিত্র। যখনই সে বাধা পায়, তখনই সে তার রূপ চেঞ্জ করে। গতবারের করোনাভাইরাস (চীন ভ্যারিয়েন্ট) আর এবারেরটা আফ্রিকা ও ব্রিটেন ভ্যারিয়েন্ট এক নয়। বর্তমানেরটাকে আটকানো বেশ জটিল। কারণ এটি অ্যান্টিবডিকে বাইপাস বা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে অতিক্রম করা শিখে গেছে। প্রতিনিয়ত মিউটেশন পরিবর্তন করে অভ্যস্থ হয়েছে। একবার সে ইমিউন সিস্টেম ভেঙেছে, সুতরাং সামনে আবার যখন ডিফেন্স সিস্টেম পাবে তখনই ভাঙবে। অর্থাৎ যতো বেশি অ্যান্টিবডি আসবে, ততো বেশি চেঞ্জ করবে। অ্যান্টিবডির প্রতিরোধে বেশিরভাগ ভাইরাস মারা যাবে এটাও সত্যি। কিন্তু যে দু-একটা বেঁচে থাকবে তারা রূপ পরিবর্তন করবে এবং পুনরায় ছড়িয়ে পড়বে- এটাই বাস্তবতা।

গত এক বছরে বাংলাদেশের অনেকের হার্ড ইমিউনিটি বেড়েছে। ব্রিটেনে ৩ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৯ শতাংশ, সুইডেনে ৫ শতাংশ, ভারতে ৪৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ৫০ শতাংশের মতো ইমিউনিটি বেড়েছে। এখন যদি বিশাল জনসংখ্যার যাদের মধ্যে ইমিউনিটি রয়েছে, এর মধ্যে যদি ভাইরাস টিকে থাকতে পারে, তাহলে কিন্তু চিন্তার বিষয় রয়েছে। কারণ ভাইরাস একটা সাইক্লোনের মতো এসে ধীরে ধীরে কমে গেছে। কিন্তু এখন যে ভাইরাস বাংলাদেশে এসেছে বা অন্য দেশে হচ্ছে, এই ভাইরাসটি প্রতিরোধ ক্ষমতার বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার মতো শক্তি সঞ্চয় করে ফেলেছে। এই শক্তি সঞ্চয় করায় তার গতিপথ আর সরল নেই। এ কারণেই এটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা বলা দুষ্কর। 

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখনো উপলব্ধি করতে পারছে না যে, আমরা ক্রমেই কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আমরা করোনাভাইরাস সংক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায়ের মুখোমুখি। এই অবস্থায় আতঙ্কিত মানুষজন ছুটছেন ভ্যাকসিন নিতে। প্রথম ডোজ শেষের দিকে, তাই দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ করেই পরিস্থিতি সামলানো হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন পরিস্থিতিতে ঘরে থাকা, লকডাউনের মতো চূড়ান্ত পদক্ষেপই অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কারণ টিকা প্রদানের হার অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপের অনেক দেশেই ভাইরাসের এসব ধরন সামাল দেওয়া যায়নি। এখনই বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নাই অবস্থা। করোনা রোগীদের জন্য অত্যন্ত জরুরি আইসিইউ চিকিৎসাসেবা নাগালের বাইরে চলে গেছে। সংক্রমণ এভাবে বাড়তে থাকলে রীতিমতো বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার মতো অবস্থা হবে। সারা বিশ্বেই চাহিদা অনুযায়ী টিকার সরবরাহ নেই। অনেক দেশ এখনো টিকা প্রদান কর্মসূচি শুরুই করতে পারেনি। এ অবস্থায় বাংলাদেশ যে চাহিদা অনুযায়ী টিকা পাবে তারও কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। আর টিকা দিলেই যে করোনায় আক্রান্ত হবে না, এমনও নয়। তাই টিকা নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। তাই বাংলাদেশের জরুরি হলো, যার যার ব্যক্তিগত সুরক্ষা। যাতে তিনি রোগটায় আক্রান্ত না হন। তিনি এবং তার পরিবার আক্রান্ত হলে ক্ষতিটা তারই হবে- এই সহজ সত্যটুকু সবার বুঝতে হবে।

এই অবস্থায় করোনা পরীক্ষায় কোনও শৈথিল্য দেখালে চলবে না। সামান্য জ্বর-সর্দির সমস্যা থাকলেও সরকারি হাসপাতালে বিনা খরচায় লালারস পরীক্ষা করতে হবে। বর্তমানে যে পরীক্ষা হচ্ছে, তা কম। অবিলম্বে করোনা পরীক্ষার সংখ্যা আরো অনেক বাড়াতে হবে। কেবল রোগীকে নয়, কেউ সংক্রমিত হলে তার সংস্পর্শে যারা এসেছেন, তাদের সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে এবং অবশিষ্ট সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনের ব্যবস্থা আরো অনেক কঠোরভাবে বাড়াতে হবে। করোনার ওষুধ ও অক্সিজেনের মজুত বাড়াতে হবে। আইসিইউ ব্যবস্থাসহ সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সুযোগ আরো অনেক বাড়াতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসার মান নিশ্চিত করার পাশাপাশি সেবামূল্য যৌক্তিক করতে হবে। যেসব স্বাস্থ্যকর্মী চিকিৎসক ও নার্স বিগত বছরে বেশি সময় কোভিড ওয়ার্ডে কাজ করেছেন, তাদের আবার কাজে ফিরিয়ে এনে অন্য নার্সদের ফের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞদের ফের নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। পরিকল্পনাগুলো অবশ্যই স্মার্ট, বাস্তবসম্মত ও বিজ্ঞানভিত্তিক হতে হবে এবং সবার আগে স্বাস্থ্য খাতে নজর দিতে হবে। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে উৎপাদন চালু ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা হিসাবে আবারও প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।

আগামী দিনে বিভিন্ন সময়ে যেসব সরকারি সতর্কবার্তা দেয়া হবে, তা যথাযথ মেনে চলতে হবে। তাতে যদি নিজেদের অনেকটা বদলেও নিতে হয় তা হলেও মেনে নিতে হবে। আমাদের জীবন ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পরিবর্তন অবশ্যই ঘটাতে হবে। কার্ফ্যু শব্দটা রাজনৈতিক বাঙালির সংস্কৃতি। সংকটকালীন আস্থার এক শব্দ। উন্নত দেশে লকডাউন মানে কার্ফ্যুর আরেক নাম। আমাদের জনবহুল বাংলাদেশে গতানুগতিক লকডাউনে মোটেও কাজ হবে না। ভাইরাস জীবন্ত কোষ ছাড়া বাঁচে না। সুতরাং কঠোর লকডাউনে মানুষকে ঘরে আটকে রেখে জীবন্ত কোষের বাইরে ১৪ দিন রাখা যায়, তাহলে মারা যায় ভাইরাস। এভাবে করোনাকে হোমলেস (গৃহহীন) করতে হবে। হোমলেস করার এখন একটাই পথ- করোনা হোক বা না হোক কিংবা টিকা নেয়া হোক বা না হোক, সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। এখন একমাত্র ভরসা কার্ফ্যু বা কঠোর লকডাউনের মাধ্যমে মানুষকে ঘরে রাখা। জনগণের জীবন রক্ষার্থে কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।  

এখন কতোদিন এবং কতোটা সতর্ক হয়ে কার্ফ্যু লড়াই টিকিয়ে রাখতে পারবে বাংলাদেশ? তার উপর নির্ধারিত হবে আমাদের ভবিষ্যৎ। হয়তো ‘আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবার ভবিষ্যদ্বাণী’ ব্যর্থ করে দেবার কাজটাও শুরু হবে কার্ফ্যু লড়াই লকডাউন থেকেই। আমরা এখনই যদি কার্ফ্যু দিয়ে মানুষকে ঘরে আটকাতে না পারি, করোনাভাইরাসের রাশ টেনে ধরতে না পারি, তাহলে আমাদের অনেক জীবন দিয়ে, অর্থ দিয়ে, স্বাস্থ্য, ভোগান্তি দিয়ে এবং জাতীয় অর্থনীতির বহু ক্ষতি দিয়ে আমাদের সেই দায় শোধ করতে হবে।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়