ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মিয়ানমার পরিস্থিতি কি গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে?

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৪, ১০ এপ্রিল ২০২১  
মিয়ানমার পরিস্থিতি কি গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে?

গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে নারকীয় পরিবেশ বিরাজ করছে। প্রতিদিন বহু মানুষ সামরিক জান্তার গুলিতে মারা যাচ্ছে, আহত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। অরাজকতা আতঙ্কে আছে দেশটির সাধারণ মানুষ।

গত ৩ দশক ধরে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসিকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। কারণ তারা মনে করে তাদের প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে সিভিল প্রশাসন একটি গণতান্ত্রিক কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতে তাদের ক্ষমতা এবং প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা হুমকির মুখে পড়তে পারে। ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে নিজেদের হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই সামরিক বাহিনী অচমকা অভ্যুত্থানের পথ বেছে নেয়।

মিয়ানমারে যেদিন নতুন জাতীয় পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করা হয়, সেদিনই তাতমাদাউ নামে পরিচিত সামরিক বাহিনী নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে ক্ষমতা দখল করার ঘোষণা দেয়। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে স্টেট কাউন্সিলর তথা দেশটির ডি ফ্যাক্টো লিডার সু চি এবং অন্যান্য সিনিয়র নেতা ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্বদের গ্রেফতার করে। সামরিক বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এই সংকট সৃষ্টি করেছে যাতে তারা পুনরায় নিজেদের ‘সংবিধান ও দেশের ত্রাণকর্তা’ দাবি করতে পারে।

মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর হাতে অফুরন্ত ক্ষমতা সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা আছে। স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং সীমান্ত মন্ত্রণালয় তাদের নিয়ন্ত্রণে। জাতীয় ও আঞ্চলিক পরিষদের ২৫ শতাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। সংবিধানের প্রধান মূলনীতি সংশোধনীর ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।

নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সু চিসহ বন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে মিয়ানমারের রাজপথে এখন  লাখ লাখ মানুষ বিক্ষোভ করছে। এই পরিস্থিতির জন্য সেনাবাহিনী মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। কারণ তারা গত ৫ দশক ধরে দেশের হর্তকর্তার দায়িত্ব নিয়েছে কিন্তু কখনোই এভাবে মানুষকে রাস্তায় নামতে দেখেনি এবং গুলি ও মেশিনগানের সামনে বুক পাততে দেখেনি। তারা যদিও এক বছর পর নতুন নির্বাচন দেওয়ার কথা বলছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করছে না। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভে সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গুলিবর্ষণ করছে। বুলেট ছোড়ার আগে কোনো রকম হুঁশিয়ারি কিংবা সতর্কবার্তাও তারা দিচ্ছে না।

বিক্ষোভকারীরা বলছে, সেনারা যদি আমাদের পেছনে ঠেলতে চায়, আমরা আরও জেগে উঠব। তারা যদি আমাদের আক্রমণ করে, আমরা আত্মরক্ষা করব। সামরিক বুটের সামনে আমরা কখনো মাথা নত করব না। এ অবস্থায় কাচিন আর্মি, টাঙ লিবারেশন আর্মি এবং আরাকান আর্মি মিলে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে একটা জোট করে ইতোমধ্যে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা জানিয়েছে তারা। এ ছাড়াও মিয়ানমারে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র ২০টির মতো সংগঠন আছে। তার অন্তত চারটি ( ওয়া আর্মি, কারেন ইউনিয়ন, আরাকান আর্মি ও কাচিন আর্মি) দেশের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। এরা কেউই ক্যুর পক্ষে নয়। ফলে দেশটি যে ক্রমেই গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে- এটা স্পষ্ট। মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ইতোমধ্যে দেশটিতে গৃহযুদ্ধের শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশ্ববাসীকে। তিনি বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদ দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য।

মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব পড়বে সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে। সেখানে মিয়ানমারের শরণার্থী আছে। গৃহযুদ্ধ শুরু হলে পুরোনোদের সঙ্গে নতুন করে কত গুণ শরণার্থী যুক্ত হবে, সেটা অনুমান করা সহজ নয়। মিয়ানমারের পরিস্থিতি হতে পারে সিরিয়ার চেয়েও ভয়াবহ। কারণ এখানে বহু গেরিলা গ্রুপের হাতে অনেক আগে থেকেই বিপুল অস্ত্র আছে। আছে ঐতিহাসিক জাতিগত রেষারেষি যা যুদ্ধের রসদ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

এরই মধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গত ২৭ মার্চ বার্ষিক সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালন করেছে। জাতির সঙ্গে এটি তামাশা ছাড়া কিছু নয়। এর আগে তারা বলেছিল, সেদিন যদি কেউ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে তাহলে তাদের মাথায় ও পেছনে গুলি করা হবে। অথচ মিয়ানমারের মানুষ মনে করে, সেনাবাহিনীর কাজ হলো বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশ রক্ষা করা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে দেশের মানুষের সেবা করা। অথচ তারা দেশের মানুষের বুকেই গুলি চালাচ্ছে।

দেশের মানুষকে মারার জন্য শুধু পুলিশ আর সেনাবাহিনীই ব্যবহার করছে না সামরিক জান্তা। বিমানবাহিনীও ব্যবহার করছে। বিমান থেকে গুলি ও বোমা ফেলা হাচ্ছে। এভাবে পুরো দেশ নরকে পরিণত হয়েছে। গৃহযুদ্ধ শুরু হলে মিয়ানমারের মানুষের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। কাজেই এখনই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। বিশ্ব শরণার্থীদের ভার আর বইতে পারছে না। বর্তমানে তুরস্ক থেকে ব্রাজিল পর্যন্ত অন্তত ২৫টি দেশে সিরিয়ার শরণার্থী আছে। লাখের ওপরে আছে অন্তত ৮টি দেশে। তুরস্ক একাই সামলাচ্ছে ৩৫ লাখ শরণার্থী। ফলে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের শঙ্কা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও ভয় বাড়ছে। অথচ কেউ বলতে পারছে না পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে শেষ হবে।  

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়