ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘এবারও ঈদের বেতন বোনাস না পাওয়ার আশঙ্কা করছি’

সুজা ফেরদৌস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৮, ১ মে ২০২১   আপডেট: ১৫:১৩, ১ মে ২০২১
‘এবারও ঈদের বেতন বোনাস না পাওয়ার আশঙ্কা করছি’

রুহুল আমিন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় অর্থ-সম্পাদক এবং গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কার্যকরী সভাপতি। আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে মে দিবস। এই দিনে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে কর্ম পরিকল্পনা, দেশের শ্রম আইনের পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজা ফেরদৌস।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের শ্রমিকরা সবসময়ই অবহেলিত, শোষিত, কিন্তু সে অনুযায়ী তারা দাবি আদায়ে সোচ্চার নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় নিপীড়ন সহ্য করেও তারা আন্দোলনে আগ্রহী হন না- কেন?

রুহুল আমিন: আমাদের দেশে অতীতে যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পখাত ছিল, সেখানে শ্রমিকরা ছিল বয়স্ক। তারা ট্রেডিশনাল একটা ট্রেড নিয়ন্ত্রণ ফর্মের মধ্য দিয়ে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এখন যে ইন্ডাস্ট্রিগুলো গড়ে উঠেছে এখানে গ্রাম থেকে উঠে আসা অল্পবয়সী শ্রমিকরা কাজ করে, যারা এখন পর্যন্ত অসংগঠিত এবং এ শিল্পখাতগুলো ট্রেডিশনাল প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পখাত নয়। শ্রমিকরাও সে ধরনের নয় এবং তাদের চাকরির স্থায়িত্ব নেই। ফলে চেতনার দিক দিয়ে তারা খুব দুর্বল। চাকরি স্থায়ী করার জন্য তারা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না। অথচ মালিকদের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু যখন তার ন্যায্য, বকেয়া পাওনাগুলো পায় না, তখন তার বেঁচে থাকার আর কোনো পথ থাকে না। তখনই সে নিরুপায় হয়ে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে আন্দোলনে নামে।

প্রশ্ন: আন্দোলনের ক্ষেত্রে আপনাদের সাংগঠনিক কোনো দুর্বলতা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে কিনা- আপনি কি মনে করেন?

রুহুল আমিন: সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আজ থেকে পনেরো বছর আগেও গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির কথাই যদি বলি- একজন শ্রমিক সে জানতো না আইন অনুযায়ী তার কী কী অধিকার আছে। অসুস্থকালীন ছুটি, বাৎসরিক ছুটি, মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা, উৎসব ভাতা, চাকুরির শেষে গ্র্যাচুয়িটি ছাড়াও তার রিজাইন দেয়ার অধিকার, মালিক তাকে চাকরি থেকে কোন কোন ধারায় বাদ দিতে পারে এসব বিষয়ে কোনো ধরনের জ্ঞান শ্রমিকদের ছিল না। বর্তমানে আমাদের শ্রমিকরা এটুকু অন্তত জানে- তার আইনগত কিছু ছুটি পাওনা আছে এবং চাকরি শেষে সে কিছু সার্ভিস বেনিফিট পাবে।

আমি বলব, এই জায়গাটায় আমরা কিছুটা সফল হতে পেরেছি। আমরা একেবারেই অসংগঠিত অবস্থা থেকে এখন তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংগঠিত। কিন্তু এটি পর্যাপ্ত নয়। আর সেজন্যই শাসকগোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ করে সুনির্দিষ্ট দাবির ভিত্তিতে একটা দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম এখনও সম্ভব হচ্ছে না। ‘৮৬ সালে প্রথম গার্মেন্টস-এ মজুরি নির্ধারণ হয়। এরপরে ১৯৯২ এবং ২০০৬ সালে। আমাদের শ্রম আইনে আছে তিন বছর পর থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে মজুরি পুণঃনির্ধারণ করতে হবে অর্থাৎ পাঁচ বছরের অধিক সময় যাবে না। তেরো বছর কোনো মজুরি নির্ধারণ হয়নি। ২০০৬ সালে আমরা যখন লাখ লাখ শ্রমিককে নিয়ে রাজপথে লড়াই করি তখন সরকার এবং মালিকরা বাধ্য হয়ে ৯৩০ টাকার মজুরি বাড়িয়ে ১৬৬২ টাকা করেছিল। এরপর ২০১০ সালে্ আবার আন্দোলনের মাধ্যমে বাধ্য করে সেই মজুরি ৩০০০ টাকা এবং ২০১৮ সালে ৮৩০০ টাকা করা হয়। এগুলো আন্দোলন এবং সংগঠনের কর্মপ্রয়াসেরই ফল। যদিও এটি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

আবার দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির ফলে টাকার অঙ্কে জীবনমান যে পরিমান উন্নত হওয়ার কথা ছিল তা হয় নি। আমাদের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে- দুই টাকার চ্যাপা শুঁটকি দিয়ে শুরু করে আমাদের এই জীবন নলা মাছে এসে ঠেকেছে। এখন আমাদের ইলিশ মাছ খাওয়ার সংগ্রাম।

 

ঈদের বেতন, বোনাস না-পাওয়া নিয়ে এবারও আশঙ্কা করছি আমরা। অনেক কারখানায় বোনাস নিয়ে ঝামেলা করবে এবং না দিলে আমরা সে কারখানায় আন্দোলন করব। শ্রম প্রতিমন্ত্রী একটি বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ১০ মে’র মধ্যে বোনাস পরিশোধ করার জন্য। ১০ তারিখ ঈদের মাত্র তিন দিন আগে। তার অন্তত ১৫ দিন আগে বলা উচিত ছিল। এর দ্বারা মালিক পক্ষকে বোনাস না দেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। আমরা দাবি করেছি ২০ রমজানের মধ্যে বোনাস দিতে হবে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে আপনার কোনো মন্তব্য আছে কি?

রুহুল আমিন: ১৮৮০ সালে প্রথম একটি আইন হয়- ভারতীয় শিল্প আইন। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইনের দাবি করা হয়েছে। ১৯২৩ সালে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ আইন, ১৯৩৬ সালে মজুরি আইন, ১৯৬৫ সালে কারখানা আইন, ১৯৬৯ সালে শিল্প সম্পর্কিত অধ্যাদেশ আইন, ১৯৭৭ সালের বিধিমালা এরকম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দাবির ভিত্তিতে আইন হয়েছে। পরে ২০০৬ সালে সমস্ত আইন ডিলিট করে একটি আইন করা হয়েছে। এটিতে মূলত মালিকদের স্বার্থ অধিকাংশে সংরক্ষণ করে শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। ২০১৩ সালে সংশোধনের নামেও তাই করা হয়েছে। এখনও ইউরোপিয় ইউনিয়ন এবং আইএলও-এর চাপেই মূলত আমাদের দাবিগুলোর বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সেখানে আমরা যে দাবি উল্লেখ করেছি তার চেয়েও বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে মালিক পক্ষ। এখনকার শ্রম আইনে মালিক পক্ষের যে সুবিধা রয়েছে তার চেয়ে অধিক সুবিধা অর্জনের জন্য তারা নানারকম ষড়যন্ত্র করছে। সরকারের পরিচালক বর্তমানে গার্মেন্টস মালিকসহ অপরাপর কিছু শিল্পপতিরা। সেই কারণে বিজিএমইএ-এর প্রেসক্রিপশনের বাইরে সরকার যেতে পারে না। আমরা বলছি বিজিএমইএ-এর প্রেসক্রিপশন অনুসারে হবে না। বাংলাদেশের সংবিধান এবং আইএলও কনভেনশন অনুসারে শ্রম আইন করতে হবে। 

প্রশ্ন: দাবি আদায়ে আপনাদের কর্মপরিকল্পনা কী?

রুহুল আমিন: আমরা শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ ইতোমধ্যে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেছি। করোনার কারণে বৈঠক এখন হচ্ছে না। করোনার পরে হবে। সেখানে আমাদের দাবি অনুসারে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে মূল চেতনা যার ভিত্তিতে আমাদের সংবিধান, সেই সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে- রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য হবে আমাদের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতী জনগণ বিশেষত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অগ্রসর করা। সমাজের শোষণ বৈষম্য দূর করা। সেই লক্ষ্য থেকে এই আইএলও কনভেনশনের ৮৭, ৯৮ এবং অপরাপর কনভেশন অনুসারে যদি শ্রম আইন না করা হয় আমাদের শ্রমিক প্রতিনিধি তারা বয়কট করবেন এবং আমরা বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের পক্ষ থেকে ধর্মঘটসহ সর্বাত্মক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ব আমরা।

প্রশ্ন: কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে দৈনিক ৯-১০ ঘণ্টা কাজ করানো হয়। একজন ফুলটাইম শ্রমিকের সপ্তাহে কয়দিন এবং দিনে কয় ঘণ্টা কাজ করা যথেষ্ট বলে মনে করেন?

রুহুল আমিন: একজন শ্রমিকের দৈনিক কর্মঘণ্টা হলো ৮ ঘণ্টা। সপ্তাহিক কর্ম ঘণ্টা হলো ৪৮ ঘণ্টা। মাসিক কর্মঘণ্টা হলো ২০৮ ঘণ্টা। এর বাইরে একজন শ্রমিকের সম্মতি থাকলে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা ওভার টাইম করতে পারে। এবং শ্রমিক, মালিক উভয়ের সম্মতি থাকলে আরেকটু বেশি করতে পারে। নারী শ্রমিকের ক্ষেত্রে কোনো ক্রমেই রাতে কাজ করানোর বিধান নেই। 

প্রশ্ন: করোনাকালীন যে দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করার কথা বলা হয় কারখানাগুলোতে সেই নিয়ম মানা হচ্ছে? আপনাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে?

রুহুল আমিন: কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না। আমাদের দিক থেকে শ্রমিকদের সচেতন করার জন্য আমরা কতগুলো কর্মসূচি পালন করেছি। সামর্থ অনুযায়ী আমরা মাস্ক, স্যানিটাইজার বিতরণ করেছি। সরকার এবং মালিক পক্ষকে আমরা এ বিষেয়ে দাবি জানিয়েছি। করোনা সংক্রমণের প্রথম দিকে তারা আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিল এবং কথা দিয়েছিল স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে। কিন্তু মালিকরা সেই কথা রাখে নি। হাতে গোনা কিছু কারখানায় সাবান পানির ব্যবস্থা আছে। 

প্রশ্ন: প্রতিবারই আমরা দেখেছি শ্রমিকরা ঈদের বেতন-বোনাসের জন্য রাস্তায় নামতে বাধ্য হন। 

রুহুল আমিন: ঈদের বেতন, বোনাস না-পাওয়া নিয়ে এবারও আশঙ্কা করছি আমরা। অনেক কারখানায় বোনাস নিয়ে ঝামেলা করবে এবং না দিলে আমরা সে কারখানায় আন্দোলন করব। শ্রম প্রতিমন্ত্রী একটি বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ১০ মে’র মধ্যে বোনাস পরিশোধ করার জন্য। ১০ তারিখ ঈদের মাত্র তিন দিন আগে। তার অন্তত ১৫ দিন আগে বলা উচিত ছিল। আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলতে চাই- এর দ্বারা মালিক পক্ষকে বোনাস না দেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। আমরা দাবি করেছি ২০ রমজানের মধ্যে বোনাস দিতে হবে। এটি একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে এবং ২১ রমজান থেকে বিভিন্ন কারখানায় আমরা এই দাবি করতে থাকব। এটিই আমাদের বর্তমান পরিকল্পনা।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়