ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

শেষের কবিতা, শিলং এবং রবীন্দ্রনাথ 

সুমন্ত গুপ্ত   || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৫১, ১৮ মে ২০২১   আপডেট: ১৯:০৩, ১৮ মে ২০২১
শেষের কবিতা, শিলং এবং রবীন্দ্রনাথ 

বাড়ি ফিরেই নোট বুক খুলল অমিত রায়। খসখস করে লিখল ‘পথ আজ হঠাৎ এ কী পাগলামি করলে! দু’জনকে দু’ জায়গা থেকে ছিঁড়ে এনে এক রাস্তায় চালান করে দিলে।’

শিলংয়ের পাহাড়ি পথের চড়াই-উৎরাই মাঝেমধ্যে পাগলামি করে বইকি! পথের কোথাও কোথাও পাকদণ্ডী দেখলে গা শিউরে ওঠে! গাড়ি ধাক্কা খেলে মৃত্যু অনিবার্য। অনেক সময় মোটর গাড়ির মুখোমুখি ধাক্কা এ পথে অস্বাভাবিক নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯, ১৯২৩ ও ১৯২৭ সালে তিন দফায় ভারতের মেঘালয়ের শিলং আসেন। শিলং থাকাকালে তিনি বেশ কিছু সাহিত্য রচনা করেন। ‘শেষের কবিতা'র প্রেক্ষাপটও শিলং। আমি আর মা আছি সেই শিলং-এ; মেঘালয়ের কন্যার আশ্রয়ে। 

শিলং শহর পরিভ্রমণের আজ দ্বিতীয় প্রভাত। সূর্যদেব চোখ মেলে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুম থেকে উঠে হোটেলের রুমের জানালা দিয়ে শহরের রূপ দেখছিলাম। একদম শান্ত নিরিবিলি। নেই কোনো শব্দ দূষণ। সকাল হতেই যে যার মতো কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। শিলং শহরে আবার আমাদের দেশের মতো রিকশা চলে না। সবার কম-বেশি প্রাইভেট কার আছে, নতুবা একটু পরপর বাস ছেড়ে যায় বিভিন্ন গন্তব্যে। এর মাঝে আমাদের শিলং শহরে ভ্রমণের সহযাত্রী বাপ্পিদার ফোন- দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। আজ নিয়ে যাবো নতুন আরেক গন্তব্যে।

আমি আর কালক্ষেপণ না করে তৈরি হয়ে নিলেম। মাকে তাড়া দিতে লাগলাম তৈরি হবার জন্য। চার চাকার যান আসতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গাড়িতে উঠতেই বাপ্পিদার প্রশ্ন- পেটে কি কিছু দানাপানি দিতে হবে নাকি পরে দিলেও চলবে? আমি ভাবলাম সকালে কিছু খেয়ে নিলেই ভালো হয়। পেটে তো গত রাত থেকে কিছু পরেনি। আমি বাপ্পিদার কথায় রাজি হয়ে গেলাম। বাপ্পিদাকে বললাম, কোথায় নিয়ে যাবেন দাদা খেতে? দাদা বলল, আগে চলোই না, আশাকরি খারাপ লাগবে না। কিছু সময়ের মধ্যে আমরা উপস্থিত হলাম খাবারের হোটেলে।

সাইনবোর্ডের দিকে তাকাতেই দেখলাম লেখা ‘হোটেল সুরুচি’। হোটেলে ঢুকে তো চোখ মাথায় ওঠার যোগার! মানুষ আর মানুষ! কিন্তু এখন ঘড়ির কাঁটায় সময় সকাল সাতটা। এতো সকালে এতো মানুষ এখানে কী করছে? কিছু সময় দাঁড়ানোর পর আমরা বসার জায়গা পেলাম। হাসি মুখে একজন এসে উপস্থিত হয়ে জানতে চাইলো, কী লাগবে? আমি বললাম, সকালের খাবারের জন্য কী আছে? বলতেই এক লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দিলেন তিনি। এতো সব আইটেমের নাম দেখে কোনটা রেখে কোনটা খাবো ভবছিলাম। শেষ পর্যন্ত লুচি, আলুর দম, আলুর চপ, পাঁপড় আর পরমান্নর অর্ডার দিলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই টেবিলে খাবার চলে এলো।

আমি খাবারের জন্য অপেক্ষার সময় চারদিকে চোখ বুলাচ্ছিলাম। খুব সুন্দর পরিবেশ! অথচ নেই কোনো দামি চেয়ার-টেবিল যা সাধারণত আমরা দেখি। কিন্তু তারপরও লোকে লোকারণ্য। অবশ্য খাবার মুখে দিতেই বুঝলাম কেন এতো লোক সমাগম। যাই হোক, পেট পূজা শেষ করেই আমরা সোজা গাড়িতে উঠে বসলাম।  আমাদের নতুন গন্তব্য পানে নিয়ে চললেন বাপ্পিদা। গাড়িতেই বাপ্পিদা বললেন, আজ আমারা যাবো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত রিলবংয়ের জিৎভূমিতে। যেখানে বসে কবিগুরু শেষের কবিতা লিখেছিলেন। শুনেই মনটা নেচে উঠল।

শিলংয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার যে বাড়িতে ছিলেন, তার নাম জিৎভূমি। তবে এখন সেটা আর অক্ষত নেই। মালিকানা বদলে গেছে। সেখানে নতুন টিনের সেমি-পাকা বাড়ি আর দেয়াল উঠেছে। বাড়ির মালিক নিশ্চয়ই জানেন, এখানে একদিন রবীন্দ্রনাথ থেকেছেন। সেই স্মারক তিনি পাথরে খোদাই করে রেখেছেন বটে কিন্তু বাড়ির নাম খানিকটা বদলে রেখেছেন- ‘জিৎভূমি’। বাগানঘেরা এ জিৎভূমিতে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ 'একটি ছাউনি, একটি দিন' লিখেছেন। কিছু অনুবাদও করেন এখানে বসে। শেষের কবিতায় অনেক বর্ণনাও আছে এ বাড়ির। সামনে সর্পিল রাস্তা, দুধারে পাইন, ইউক্যালিপটাস আর দেবদারু। দূর থেকেই দেখতে পেলাম বিরাট স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। বাপ্পিদা বললেন, গাড়িবারান্দায় ঘেরা থামওয়ালা বাড়ি, মাথায় ঢালু ছাদ, এদেশে যাকে বলে অসম টাইপ বাড়ি।

বাড়িটি এখন কেন্দ্রীয় সরকারের সংগ্রহশালা। যদিও খানকতক ছবি, আসবাব ছাড়া তেমন কিছু নেই। তবুও মনে হয়, পর্দার ফাঁকে উঁকি দিলেই দেখা যাবে সোফায় লম্বা হয়ে আছেন বাবার সঙ্গে শিলংয়ে আসা রথীন্দ্রনাথ। ফায়ার প্লেসের ধারে কি যেন করছেন প্রতিমা দেবী; আর কবি ব্যস্ত তাঁর জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে স্মৃতিচারণায়।

গ্যালারির ভেতরে প্রবেশের পরেই এক অন্যরকম অনুভূতি হতে লাগলো। বাপ্পিদার কথামত দেখা পেলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খাট, বিছানা, ব্যবহার করা চেয়ার-টেবিল, ফায়ারপ্লেসসহ বহু নিদর্শন। বাংলোর সামনে শোভা পাচ্ছে ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ ব্রোঞ্জ মূর্তি। তবে মূল রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে বাংলোয় ঢোকার রাস্তায় পাইন গাছের সারি ‘শেষের কবিতা’-র শিলং-কে মনে করিয়ে দেয়। গেটের স্মৃতিফলকে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো,/ এ নহে মোর প্রার্থনা,/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’ 

শিলংয়ে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত আরেকটি বাড়ি লাইতুমখারার আপল্যান্ডস-এ সলোমন ভিলা বা সিধলি প্যালেস। কয়েক বছর আগেই এ প্যালেস ভেঙে ফেলা হয়েছে বললেন বাপ্পিদা। আমরা আর সেদিক গেলাম না। ব্রুকসাইডের দেবদারু গাছের তলে কবিগুরুর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। 

প্রয়োজনীয় তথ্য 

শিলং যাওয়ার জন্য মেঘালয়ের ডাউকি বর্ডার সহজ মাধ্যম। সিলেটের তামাবিল বর্ডার পার হলেই ডাউকি বর্ডার। ডাউকি থেকে ট্যাক্সি পাওয়া যায় শিলংয়ের ভাড়া নেবে ৩০০ রুপি। রিজার্ভ নিলে ২২০০ থেকে ২৫০০ রুপি। ট্যাক্সি করে  শিলং বা আশপাশে যেতে পারবেন। ট্যাক্সিতে ৪ জন ঘুরতে পারবেন। অথবা মেঘালয় ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেডের বাসেও ঘুরতে পারবেন দর্শনীয় স্থান। থাকার জন্য শিলং পুলিশ বাজারে অনেক হোটেল আছে। হোটেলে থাকার জন্য পাসপোর্টের ফটোকপি ও ছবির প্রয়োজন হবে। ভাড়া ডবল রুম ১০০০ থেকে ৫০০০ রুপি পর্যন্ত। সিঙ্গেল বা ডবল রুমে চাইলে আলাদা ম্যাট নিয়ে বাড়তি লোকও থাকতে পারবেন। ম্যাটের জন্য আলাদা কিছু রুপি দিতে হবে।

শিলং যেতে চাইলে ভিসার আবেদনে ডাউকি বর্ডার উল্লেখ করুন। যাওয়ার আগে সোনালী ব্যাংকে ৫০০ টাকা ভ্রমণ কর দিয়ে নিন। এ ছাড়া কমলাপুর থেকে শিলংয়ের উদ্দেশে বিআরটিসি-শ্যামলী বাস যায়। তাদের মাধ্যমেও যেতে পারেন। খাওয়ার জন্য পুলিশ বাজারে অনেক বাঙালি খাবারের হোটেল আছে। ১০০ রুপি থেকে ৩০০ রুপিতে ভাত-মাছ-মাংস-রুটি সবই পাবেন। এর মধ্যে সুরুচি, বাবা টুরিস্ট লজ, লেপুন এর খাবার বেশ জনপ্রিয়। 
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়