ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই সময়ে কেন স্মরণ করবো? 

অলাত এহ্সান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৩, ১৯ মে ২০২১  
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই সময়ে কেন স্মরণ করবো? 

বিজ্ঞাপনী বাণিজ্যের যুগে বই-ও প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। মূলত বিক্রির সংখ্যাই নির্ধারণ করেছে বইয়ের ‘মান’। ‘জনপ্রিয় ধারা’ শব্দটি আগেও ছিল। এখন বেস্ট সেলার, দু’চারটি সংস্করণের তকমার প্রবল প্রতাপ। বহুল প্রচার আর ফেইসবুকে লেখকের মুহুর্মুহু মুখ দেখানো তো আছেই। মুহূর্তেই অনলাইন জরিপে এপাশ-ওপাশ হয়ে যেতে পারে যে কোনো হিসাব। এমনকি লেখালেখি হয়ে গেছে প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাগত সুবিধা আদায়ের মাধ্যম। এই সময়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কী করে স্মরণ করা যায়?

এই সময়ে কেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণ করা হবে— এর উত্তর আছে ‘এই সময়’ শব্দের ভেতরেই। ঐতিহাসিক নিরিখে প্রসঙ্গটা দেখে এর তল খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং ‘এই সময়’ শব্দের নিরিখে এর উত্তর খোঁজা জরুরি। বর্তমান লেখকদের নানা দ্বন্দ্ব ও ভাষ্যের ভেতর দিয়ে তাঁকে বুঝতে হবে। ‘এই সময়’ ও সাহিত্যকে আমরা কীভাবে দেখি তার ওপর তৈরি হবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা। তাঁর বয়ানেই ওসব প্রসঙ্গ খোলাসা করা সম্ভব। এ জন্য আমাদের বারবার ফিরে আসতে হবে তাঁর ‘সাহিত্য করার আগে’ প্রবন্ধের কাছে। এটা সম্ভবত তাঁর শেষে দিকের লেখা। ফলে এতে তাঁর সাহিত্য সমালোচনা ও অভিজ্ঞতা দুই-ই যোগ হয়েছে।

মজার ব্যাপার হলো, আমাদের পাঠ্যপুস্তকে যে-সব সাহিত্যিককে স্থান দেওয়া হয়, তারাই কীভাবে বিলুপ্ত হয়ে যান! শিক্ষার্থীদের কাছে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যান। চিরায়ত মর্যাদায় তাঁরা যেন এই সময়ের উপযোগিতা হারিয়েছেন। এর মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম আছে। অথচ তিনি প্রবলভাবে বেঁচে আছেন বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের বাইরে। বলতে গেলে, একাডেমিক বাধ্যবাধকতার বাইরের পাঠকরাই তাঁর সাহিত্যের যথার্থ পাঠোদ্ধার করেছেন। এর কারণ কী?

এর কারণ, আমরা যে সমাজ কাঠামোয় বাস করছি, যে শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ নিচ্ছি, মানিকের সাহিত্য এর থেকে মুক্ত। সেই মুক্তিমুখীন চিন্তায় অভ্যস্ত না হলে তাঁকে ঠিক বোঝা যায় না। মানিককে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়েই কথা বলতে হয়। এ জন্য একটু ইতিহাসে ফেরা যাক।

গত শতাব্দীর ত্রিশ–চল্লিশের দশক বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে যেমন, সাহিত্যের ইতিহাসেও তেমনি ঘটনাবহুল ও অবিস্মরণীয় কাল। এ সময় বাংলা কবিতায় যেমন ‘আধুনিক’ ধারা সূচিত হয়, কথাসাহিত্যে ঈপ্সিত আধুনিকতা আবির্ভূত হয় একইসঙ্গে। তবে কবিতায় অনুবাদ ‘নির্ভর’ আধুনিকতার তুলনায় কথাসাহিত্য অনেক বেশি স্বয়ম্ভর, এবং অবশ্যই প্রাচুর্যময় ছিল। কথাসাহিত্যে এর প্রকাশ ঘটে যৌনজীবন, নিষিদ্ধ সম্পর্ক, মনস্তাত্ত্বিক না বিষয়-আশয়ে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় ‘মধ্যবিত্ত তারুণ্যের বিক্ষোভ’। এর প্রায় সবই ছিল ভাব-নির্ভর।

সেই ত্রিশের দশকেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জানতেন, ‘বাংলা সাহিত্যে এই আধুনিকতা একটা বিপ্লবের তোড়জোড় বেঁধেই এসেছিল, কিন্তু বিপ্লব হয়নি, হওয়া সম্ভবও ছিল না– সাহিত্যের চলতি সংস্কার ও প্রথার বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত তারুণ্যের বিক্ষোভ বিপ্লব এনে দিতে পারে না।’ নিজের সময় এভাবে খুলে দেখতে না পারলে, তার সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করতে না পারলে বদল সম্ভব নয়। যে কারণে, রবীন্দ্রনাথের ভাব নির্ভরতার বিপরীতে মানুষের বহির্জীবন ও অন্তর্জীবনের বৈচিত্র্য এবং সংগ্রাম ফুটিয়ে তোলার ক্ষীণ চেষ্টা চলছিল, সেখানেই সফল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

১৯০৮ সালের ১৯ মে তাঁর জন্ম; মৃত্যু ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর। মাঝে মাত্র ৪৮ বছরের সংক্ষিপ্ত আয়ুষ্কাল। এর মধ্যে ৩৭টি উপন্যাস, দুই শতাধিক গল্প, কিছু প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এগুলো বিশ্বের যে কোনো সৃষ্টিবহুল লেখকের সমৃদ্ধ সম্ভারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মাত্র কুড়ি বছর বয়সের মধ্যেই তিনি লিখে ফেলেছেন তাঁর গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস: জননী (১৯৩৫), দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬)।

তথ্যের বিচারে এ কথা সত্য যে, কলেজে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে প্রথম গল্প ‘অতসী মামি’ লেখেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সত্যি কি হঠাৎ করে লেখকের জন্ম হয়? ‘সাহিত্য করার আগে’ প্রবন্ধে তিনি লিখেন, ‘আমি বলবো, না; এ রকম হঠাৎ কোনো লেখকই গজান না। রাতারাতি লেখক পরিণত হওয়ার ম্যাজিকে আমি বিশ্বাস করি না। অনেক কাল আগে থেকেই প্রস্তুতি চলে। লেখক হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসলেই কেবল একজনের পক্ষে হঠাৎ একদিন লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব।’

এই সময়ের লেখকদের গুরুতর সংকট–প্রস্তুতির অভাব। তাদের স্মরণ রাখা ভালো, মানিকের ভাষ্য, ‘নেহাত শখের খাতির, নামকরা লেখক হবার লোভে সাহিত্য করতে নামিনি, সেটা বলাবাহুল্য। এটুকু সম্বল করে নামলে সাহিত্যিকের বেশি দিন হালে পানি পাবার সাধ্য থাকে না।’ সমসাময়িক লেখকদের মনে রাখা দরকার, মানিকের ভাষায়, ‘সাহিত্যের জোরালো প্রভাব ছাড়া সাহিত্যের জন্ম হয় না।’ 

নিজের লেখক প্রস্তুতি নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘জীবনকে বোঝার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়তাম গল্প-উপন্যাস। গল্প-উপন্যাস পড়ে নাড়া খেতাম গভীর ভাবে। গল্প-উপন্যাসের জীবনকে বুঝবার জন্য ব্যাকুল হয়ে তল্লাশ করতাম বাস্তব জীবন।’ অন্যদের জন্য তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ‘সাহিত্যিক হতে হলে বাস্তব জীবনের মতো সাহিত্যকেও অবলম্বন করতে হয়। সাহিত্য না ঘেঁটে, নিজের জানা জীবন সাহিত্যে কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে নিজে যাচাই করে না জেনে এবং প্রতিফলনের কায়দা-কানুন আয়ত্ত না করে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। সাহিত্য-সমালোচক হওয়া যায় কি না তাতেও আমার ঘোর সন্দেহ আছে।’

আগেই উল্লেখ করেছি, গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক সাহিত্যর মতো ভারতবর্ষে রাজনীতিরও উত্থান–পতনের সময়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যও তাঁর সমসাময়িক ইতিহাস ও সমাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। সমাজের তল খুঁজতে গিয়ে তাঁর রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া ছিল প্রায় অবধারিত। সরাসরি পার্টি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। এর একটা উত্তর পাওয়া যাবে তাঁর ‘সাহিত্য করার আগে’ প্রবন্ধে। তিনি লেখেন, ‘মার্ক্সবাদ যেটুকু বুঝেছি তাতেই আমার কাছে ধরা পড়ে গিয়েছে যে, আমার সৃষ্টিতে কত মিথ্যা, বিভ্রান্তি আর আবর্জনা আমি আমদানি করেছি– জীবন ও সাহিত্য এগিয়ে নেবার উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও।’ 

লেখকদের এই রাজনৈতিক সক্রিয়তা নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে। আজকের দিনে রাষ্ট্রের বিরাজনীতিকরণ প্রকল্প কিংবা রাজনীতিবিমুখ নৈনাগরিক সময়ে দাঁড়িয়ে এটা বোঝা খানিকটা কঠিন। আসলে রাজনীতির থেকে লেখা তো নয়ই, লেখককেও বিযুক্ত করা যায় না; প্রয়োজন উল্টো। তথাকথিত ‘রাজনীতি বিযুক্ত’ লেখকের লেখার কি হাল তা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। বলা যায়, রাজনীতিহীনতার রাজনীতিতে আক্রান্ত হয়ে তারা অপরাজনীতিকেই বরং পুষ্ট করছেন। আসলে লেখকের একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি-চাহিদা লেখাটির মধ্যে অন্তর্লীন না থাকলে, লেখা টানে না, জোলো হয়ে যায়। ফলে রাজনৈতিক সংস্রব তাঁর সাহিত্যের মান কমিয়েছে, নিন্দুকের এমন প্রচার সত্য নয় বলেই মনে হয়। 

লেখকের জন্য খুব জরুরি প্রশ্ন– তিনি কেন লিখেন– এর উত্তর জানা। ‘কেন লিখি’ প্রবন্ধে লিখেন, ‘জীবনকে আমি যেভাবে ও যতভাবে উপলব্ধি করেছি অন্যকে তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ভাগ দেওয়ার তাগিদে আমি লিখি। আমি যা জেনেছি এ জগতে কেউ তা জানে না (জল পড়ে পাতা নড়ে জানা নয়)। কিন্তু সকলের সে আমার জানার এক শব্দার্থক ব্যাপক সমভিত্তি আছে। তাকে আশ্রয় করে আমার খানিকটা উপলব্ধি অন্যকে দান করি।’ 

অস্বীকার করার সুযোগ নেই, ‘এই সময়’ প্রতিটি মানুষই প্রচণ্ড মানসিক দ্বন্দ্বের ভেতর বাস করেন। ‘এই সময়’ বাজার সংস্কৃতির প্রভাব, পুঁজির প্রবল চাপ, রাষ্ট্রের দুঃশাসন, বৈষম্যের ক্ষমতা চর্চা, প্রতিষ্ঠার ইঁদুর দৌড়, পণ্যের ভিড়ে বিপন্ন জীবন, মিডিয়ার প্রচারে স্বস্তির কোনো সুযোগ নেই। সমাজের উচ্চকোটি থেকে নিম্নকোটির সবার ভেতর এই অস্বস্তি আছে। ভেতরে-ভেতরে সবাই পুড়ে খাক হয়ে গেলেও প্রকাশ্যে শ্রেণিবৈষম্য বাড়ছে। মানুষের নির্বুদ্ধিতা, শঠতা, প্রতারণা, লোভে খোদ মানুষই আজ বিপন্ন। যাদের সঙ্গে মিশছে, থাকছে তাকেও মানুষ বিশ্বাস করতে পারে না। 

বিষয়টির চমৎকার তাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়েছেন ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তার ‘ধ্রুপদি যুগে উন্মাদনার ইতিহাস’ বইয়ে। বইটির আলোচনায় অমল বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘আমরা যাকে প্রাতিস্বিকতা বলতে অভ্যস্ত, যাকে আমরা ধরে নিই মানুষের অনড়, ধ্রুব চরিত্র বলে, সেটি মূলত কিছু সামাজিক ও নৈতিক বিধিনিষেধের প্রত্যাদেশে আমাদের ওপর আরোপিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে, একজন সামাজিক প্রাণী তার নিজের কাছে বিদেশি ও বিচ্ছিন্ন।’ 
সেই পথ ধরে মিশেল ফুকো রীতিমতো ঘোষণা করেছেন, ‘মানুষ একটি আবিষ্কার, যার জন্মতারিখ- যে আমাদের চিন্তার প্রশ্নতত্ত্ব সহজেই দেখায়-সাম্প্রতিক। এবং সম্ভবত তার সম্ভাব্য সমাপ্তি আসন্ন।’ 

এই বাস্তবতায় আমাদের তথাকথিত ‘বেস্ট সেলার’ সাহিত্য কী দিচ্ছে? এই বাস্তবতা কি ধরতে পারছেন জনপ্রিয় লেখকরা? মনে হয় না। এর কিছুই তারা ব্যাখ্যা করার সাধ্য রাখে না। তারা বিদ্যমান বাস্তবতাকে উদযাপন করছে। আরও সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে চিন্তা। সংস্করণ ফুরানোর নামে তথাকথিত জনপ্রিয়দের কাছে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। আর এখানেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্ব। তিনি এই ব্যবস্থা ও বাস্তবতা ব্যাখ্যা করেন। 

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন, ‘ভদ্র জীবনকে ভালোবাসি, ভদ্র আপনজনদেরই আপন হতে চাই, বন্ধুত্ব করি ভদ্র ঘরের ছেলেদের সঙ্গেই, এই জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নকে নিজস্ব করে রাখি, অথচ এই জীবনের সংকীর্ণতা, কৃত্রিমতা, যান্ত্রিকতা, প্রকাশ্য ও মুখোশ পরা হীনতা, স্বার্থপরতা ইত্যাদি মনটাকে বিষিয়ে তুলেছে। 
এই জীবন আমার আপন অথচ এই জীবন থেকেই মাঝে মাঝে পালিয়ে ছোটলোক চাষা-ভূষাদের মধ্যে গিয়ে যেন নিশ্বাস ফেলে বাঁচি। আবার ওই ছোটলোকদের অমার্জিত রিক্ত জীবনের রুক্ষ কঠোর নগ্ন বাস্তবতার চাপে অস্থির হয়ে নিজের জীবনে ফিরে এসে হাঁফ ছাড়ি।’ এই সব হাঁফ ছাড়া জীবন বোঝার জন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জরুরি। সাহিত্যের কাজ যে নিছক আনন্দ দেওয়া নয়, বরং মননে সমৃদ্ধ করা, চিন্তায় জাগ্রত করা, সেই কাজ করে মানিকের সাহিত্য।

এই করোনা প্রভাবিত দুই বছর বাদ দিলে, শেষে দুই দশক প্রতিবছর শুধু অমর একুশের গ্রন্থমেলায় কয়েক হাজার বই প্রকাশ হয়। এর মধ্যে কতজন লেখকপ্রস্তুতি নিয়ে লিখছেন– প্রশ্ন থেকেই যায়। তারপরও কেন এত বই প্রকাশ? এর সহজ উত্তর, দেশে এই মুহূর্তের লেখালেখির সবচেয়ে চাউর দিক– নাম কামানো। ফলে দেশে বই প্রকাশকের মতো বুদ্ধিবৃত্তিক পেশাজীবী হয়ে গেছেন নিতান্তই বই বিক্রেতা, আর লেখক হয়েছেন বিজ্ঞাপন দাতা। একে তুঙ্গে তুলতে শুরু হয়েছে লেখকদের দলবাজি-তোলাবাজি। বিগলিত প্রশংসায় ভেসে যায় পরস্পর। পরচর্চায় কেটে যায় তাদের সাহিত্যের আসর। কেউ প্রশ্ন তোলেন না- এতে সাহিত্যের কী হচ্ছে? এই সংকট মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়ও ছিল।

তিনি লেখেন, ‘তখনই আমি জানতাম যে, সমাজে যেমন সাহিত্যেও তেমনি বড় আলোড়ন দেখা দিলে সেই সুযোগে কতকগুলি চ্যাংড়া কিছু ফাজলামি জুড়বেই— আসল আন্দোলনটা যদি ঠিক থাকে এই সব হালকা ছ্যাবলামির জন্য বিশেষ কিছু আসবে যাবে না।’ আরেকটু ব্যাখ্যা করে বললে, ‘বন্ধু-বান্ধবেরা খ্যাতি দিয়ে কি কোনো কবি বা সাহিত্যিককে খ্যাতনামা করতে পারে! খ্যাতনামা কবি বা সাহিত্যিক মানেই জনসাধারণ সমগ্র বা আংশিক, স্থায়ীভাবে অথবা সাময়িকভাবে যাকে তারিফ করছে। এদের ভূমিসাৎ করে কাব্যসাহিত্যের মোড় ঘুরানো যাবে না। কাব্য সাহিত্যর মোড় ঘুরিয়েই এদের ভূমিসাৎ করতে হবে।’ 

এ সময়ের বাংলা সাহিত্যে কিছু লোক ঠকানো শব্দ ঢুকে গেছে। জাদুবাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, পৈশাচিক কল্পকথা, করুণ হাস্যরস ইত্যাদি। বই পরিচিতির নামে এই সব শব্দ (অবশ্যই ইংরেজিতে) জুড়ে দিয়ে প্রশস্তি গাওয়া হয়। অথচ লেখাটা আদৌ কোনো সাহিত্য মান বহন করে কিনা, তার উত্তর নেই কোথাও। এই সাহিত্য থেকে জীবন বোঝার কোনো উপায় নেই। তা ছাড়া আমাদের সাহিত্য এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে মধ্যবিত্তীয় সংকটে। যে কারণে গল্পে চরিত্রগুলো আবর্তিত হয় পলাতক ধরনের কল্পকথায়।
ত্রিশের দশকের সাহিত্যের যে সংকট মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চিহ্নিত করেছিলেন, তা এই একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসেও রয়ে গেছে। ‘(সাহিত্যে) বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে এই বাস্তব সংঘাত আসেনি। বস্তিজীবন এসেছে কিন্তু বস্তিজীবনের বাস্তবতা আসেনি—বস্তির মানুষ ও পরিবেশকে আশ্রয় করে রূপ নিয়েছে মধ্যবিত্তেরই রোমান্টিক ভাবাবেগ।’

লক্ষ্য করার বিষয়, আজকের দিনের প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, লাখো পোশাক শ্রমিকের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় রাষ্ট্র চললেও তাদের নিয়ে প্রামাণিক সাহিত্য নেই। এখনো বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী সময়ের মতো সাহিত্যে ধর্মীয় আবহ তৈরি, ত্রিশের দশকের আধুনিকতার মতো সাহিত্যে যৌন জীবনকে আনাই সাহিত্যের বড় প্রাপ্তি হয়ে আছে। 
বিশ্ব যখন জ্ঞান, ইতিহাস, দর্শনে সমৃদ্ধ সাহিত্য লিখছে; আমরা তখনো আছি নিতান্তই অলস মনের ভাবালুতায় ভরা হাত–বানানো সাহিত্যে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘জীবনকে তো জানতেই হবে, এ বিষয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু জীবনকে জানাই যথেষ্ট নয়। সাহিত্য কি এবং কেন সে তত্ত্ব শেখাও যথেষ্ট নয়। যে জীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছি, বুঝেছি সেই জীবনটাই সাহিত্যে কীভাবে কতখানি রূপায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে, সেটাও সাহিত্যিককে স্পষ্টভাবে জানতে ও বুঝতে হবে। নইলে নতুন সৃষ্টির প্রেরণাও জাগবে না, পথও মুক্ত হবে না।’

ভাবালুতায় বিরুদ্ধে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদ্রোহ খুঁজে পাওয়া যাবে তার নামের ভেতর। সাহিত্যের ভাষা যাকে বলে— কলমি নাম। যার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে গেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, “শৈশব থেকে সারা বাংলার গ্রামে শহরে ঘুরে যে জীবন দেখেছি, নিজের জীবনের বিরোধ ও সংঘাতের কঠোর চাপে ভাবালুতার আবরণ ছিঁড়ে ছিঁড়ে জীবনের যে কঠোর নগ্ন বাস্তব রূপ দেখেছি— সাহিত্যে কি তা আসেব না? এই বাস্তব জীবন যাদের— সেই সাধারণ বাস্তব মানুষ? অথচ প্রথম গল্পই আমি লিখি ‘অতসী মামি’— রোমাঞ্চে ঠাসা অবাস্তব কাহিনি। কিন্তু এ গল্প সাহিত্য করার জন্য লিখিনি— লিখেছিলাম বিখ্যাত মাসিকে গল্প ছাপানোর নিয়ে তর্কে জিতবার জন্য। এ গল্পে তাই নিজের আসল নাম দেইনি, ডাক নাম ‘মানিক’ দিয়েছিলাম।’’

তথ্য সূত্র: 
লেখকের কথা ও প্রগতি সাহিত্যের আত্মকথা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সংহতি প্রকাশন, ঢাকা
উত্তর আধুনিক চিন্তা ও কয়েকজন ফরাসি ভাবুক, অমল বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং মুশায়েরা, কলকাতf
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাজ জিজ্ঞাসা, ড. নিতাই বসু, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা

লেখক: গল্পকার, সাহিত্য সমালোচক। একটি দৈনিকে কর্মরত। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: অনভ্যাসের দিনে (প্রকৃতি/’ ১৮)

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়