ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হাফিজুরের পর ইশরাত, কেন এত শিক্ষার্থীর অপমৃত্যু

আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৪, ৬ জুন ২০২১   আপডেট: ১৬:৫২, ৬ জুন ২০২১
হাফিজুরের পর ইশরাত, কেন এত শিক্ষার্থীর অপমৃত্যু

হাফিজুর রহমান ও ইসরাত জাহান তুষ্টি (ফাইল ফটো)

করোনাভাইরাসের কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ এ ছুটিতে ঘরবন্দি জীবন, পারিবারিক সংকট, সম্পর্কের টানাপোড়েন ও একাকিত্বের মতো নানা মানসিক সমস্যায় ভুগছে অসংখ্য শিক্ষার্থী। গত এক বছরে অপমৃত্যুর শিকার হয়েছে প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, এর মাঝে একের পর এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলে এমনটা হতো না। আর কত শিক্ষার্থী মারা গেলে প্রতিষ্ঠানের টনক নড়বে।

৬ জুন, রোববার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান তুষ্টির মৃত্যু ও সম্প্রতি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও বিজ্ঞান গবেষণা বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজুরের মৃত্যুর পর নানা প্রশ্ন সামনে আসছে। কেন এত অপমৃত্য? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানীরা তাদের নানা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।

যেভাবে মারা গেলেন ইশরাত:
রোববার সকালে রাজধানীর আজিমপুর সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারের বাথরুমের দরজা ভেঙে মরদেহ উদ্ধার করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান তুষ্টির। তুষ্টিকে বাসা থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সাফায়েত আহমেদ।

সাফায়েত জানান, তুষ্টির আগে থেকেই অ্যাজমা (হাঁপানি) ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল। শনিবার বিকেলে দোকানে যাওয়ার সময় সে বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল। বৃষ্টিতে ভিজে শরীর খারাপ লাগায় শনিবার আর বাসা থেকে বের হয়নি। পরে রাতে কখন উঠে সে বাথরুমে যায় তা রুমের অন্যরা বলতে পারছে না। ভোরের দিকে রুমমেটরা সাড়াশব্দ পায়, কিন্তু বাথরুমটি ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।

তিনি বলেন, ইসরাতের রুমমেট ও সহপাঠী রাহনুমা তাবাসসুম রাফি তাকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানালে তিনি সেখানে যান। পরে ৯৯৯-এ ফোন দিলে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এসে সাতটার দিকে অজ্ঞান অবস্থায় তুষ্টিকে বাথরুম থেকে বের করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

শিক্ষার্থীরা যা বলছেন:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহিল বাকি বলেন, মেয়েটির হাত মুষ্টিবদ্ধ করা ছিলো। শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ইনহেলার ব্যবহার  করতো সে। স্টাফ কোয়ার্টারে খোঁজ নেয়ার মতো তেমন কেউ থাকে না। ঢাবির হলের অবস্থাতো জানেন সবাই, কারো সামান্য জ্বর হলেও সবাই মিলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতো কিংবা সেবা যতœ করতো। মেয়েটি হলেই থাকতো, ১ম বর্ষ থেকেই।  হল বন্ধ, শিক্ষার্থীরা বাইরে মেস বাসা ভাড়া করে থাকে।

জোনায়েদ নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, হল খোলা থাকলে অন্তত চিকিৎসকের কাছে নেয়া সম্ভব হতো। মেসে বা স্টাফ কোয়ার্টারে তো তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। লুবনা নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, এই শ্বাসকষ্ট নিয়ে মরে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছিল আমারও। রুমমেট আর বান্ধবীরা না থাকলে কি যে হতো, হাসপাতালে তারাই নিয়ে গেছে, ম্যাডামদের খবর দিছে। মেসে থেকে কপালে যে কি আছে আল্লাহ মাবুদ জানে। এই ঘটনা দেখে এখন নিজেও টেনশনে থাকবো সাথে বাবা মা’ও চিন্তায় থাকবে। রোকাইয়া নামের এক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হল বন্ধ করে রাখা কোন সমস্যার সমাধান নয়।

সহপাঠীরা যা বলছেন:

অপমৃত্যুর শিকার ইশরাত জাহান তুষ্টির হলের রুমমেইট আসমা আক্তার লিয়া বলেন, সে কখনো রাতে একা একা ওয়াশরুমে যায়নি। ভয় পেতো। আমাকে বেশির ভাগ সময় আমাকে নয়তো অন্য কাউকে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখতো! আজ সেই বাথরুমের আবদ্ধ ঘরে একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য কত কষ্টই না করেছে!

সতীর্থ নওশীন চৌধুরী বলেন, মেনে নিতে পারছি না। তুষ্টির মত মানুষ এত্ত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।

তুষ্টির প্রতিবেশি রাশিদাতুল রোশনি জানান, ও আমার পাশের রুমে থাকতো। ওর ঠান্ডার সমস্যা ছিল। ২ দিন আগে নাকি বৃষ্টিতে ভিজছে। মেনে নিতে পারছি না। এস এন মুক্তা বলেন, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না তুষ্টি আর আমাদের মাঝে নেই। সেই চঞ্চল মেয়েটা আর আমাদের মাঝে নেই।

মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা যা বলছেন:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আজিজুর রহমান বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা তাদের বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে মেলামেশা করতে পারছে না। তাদের সুখ দুঃখ সহ নানাবিধ বিষয় শেয়ার করতে পারছে না। একাকিত্ব তাদের গ্রাস করেছে। আত্মহত্যাসহ নানাবিধ অপমৃত্যুর পেছনে এটি বড় একটি কারণ।

এছাড়া, আমাদের যে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা সেটিই অনেকটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। মানুষের মানুষের মধ্যে বিশ্বাস আস্থাবোধ উঠে গেছে। হিংস্রতা বেড়ে গেছে। যার ফলে মানুষ নানাভাবে মৃত্যুর পথ বেছে নিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের একের পর এক এমন অপমৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, আমাদের সোশ্যাল ট্রান্সফরমেশনের দিকে যাচ্ছি আমরা। আমরা আধুনিকতায় পা রাখছি। এর মাধ্যমে ট্রানজিশনাল পিরিয়ডে সমাজে অস্থিরতা হয়। এর অন্যতম কারণ সমাজের ট্রাডিশনাল অনুশাসনগুলো আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় কাজ করছে না। যেহেতু আমরা বিশ্বায়নের মধ্যে প্রবেশ করেছি টেকনোলজিক্যাল এডভান্সমেন্ট আসছে। ছাত্র ছাত্রী, ইয়ং জেনারেশন এগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। একই সাথে যতই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছি, আমাদের অনেক টাকা-পয়সা চলে আসছে। অনেকে এগুলোর মাধ্যমে নেগেটিভ কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। 

তিনি বলেন,মধ্যবিত্ত ও মোটামুটি আপার ক্লাসের দ্রুত পরিবর্তন, নগরায়নের কারণে আমাদের কালচার এক্টিভিটিসে বড় বদল আসছে। এখন পরিবারের সাথে অ্যাটাচমেন্ট নেই। ভালো কাজে সম্পৃক্ততা গেছে। আগের মতো শিক্ষকরা এখন আর শাসন করছে না। অনুশাসন কমে গেছে। এগুলো আধুনিক ব্যবস্থার সাথে কন্ট্রাডিক্ট করছে। বাবা মা দুজনেই কাজ করছেন। সন্তানকে সেভাবে সময় দিতে পারছে না। এছাড়া ইয়ং জেনারেশনের রিক্রিয়েশনাল একটি ব্যাপার আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রিক্রিয়েশনের জায়গায় যৌনতা ও মাদক ঢুকে পড়েছে। আধুনিকায়নের ফলশ্রুতিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচক দিকে ছেলেমেয়েরা ঝুঁকছে। যতক্ষণ না বিকল্প কিছু তৈরি হবে, ততক্ষণ তারা এ দিকে ঝুঁকবে। এর জন্য সরকার, প্রতিষ্ঠান, আইন শৃঙখলা বাহিনী, পরিবার সবাইকেই সচেতন হতে হবে।

ঢাকা/ইয়ামিন/এমএম

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়