ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ঐতিহ্যবাহী ‘রূপলাল হাউজ’ এখন মসলার আড়ৎ

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:২৬, ৭ জুন ২০২১   আপডেট: ১৮:৫২, ৮ জুন ২০২১
ঐতিহ্যবাহী ‘রূপলাল হাউজ’ এখন মসলার আড়ৎ

চারদিকে পিঁয়াজ, আদাসহ নানারকম মসলার বস্তা, কুলির হাঁকডাক, ক্রেতার দরদাম, বিক্রেতার ব্যবসা সামলানো- সব মিলিয়ে তুমুল ব্যস্ত পরিবেশ। বাইরে আরো সরগরম! একে তো পুরনো ঢাকার ব্যস্ত পথ, তার ওপর সারিবদ্ধ ট্রাক লোড-আনলোড হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। এই সব কিছুর মধ্যেই যেন চাপা পড়ে গেছে এক সময়ের বিখ্যাত ‘রূপলাল হাউজ’।

দেখে চেনার জো নেই- এই ভবনটি ছিল এক সময়ের জৌলুসপূর্ণ বাড়ি। এই বাড়িতেই বসতো নিয়মিত গানের আসর। সেই আসর মাতিয়ে দিতেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ,  ওস্তাদ ওয়ালীউল্লাহ খাঁ কিংবা লক্ষ্মী দেবীরা। এই বাড়ি কবি কাজী নজরুল ইসলামেরও স্মৃতিধন্য। কবি এখানে পা রেখেছেন বেশ কয়েকবার। সেই বাড়ি এখন পরিণত হয়েছে মসলার আড়তে। বাড়ির ভেতরে গড়ে উঠেছে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ বাড়ির ঘরগুলোকে দোকানে পরিণত করা হয়েছে। কোনো কোনো ঘর ব্যবহার হচ্ছে মালামাল রাখার গোডাউন হিসেবে।  

শ্যামবাজারের পাশেই রূপলাল হাউজ। হাউজের নিচতলা পুরোপুরি চলে গেছে ব্যবসায়ীদের দখলে। সদর দরজা দিয়ে ঢোকার পরেই উপরে ওঠার কাঠের সিঁড়ি। জায়গাটি সবসময়ই অন্ধকার থাকে। তবে বাড়ির মাঝখানের উঠানে রোদের আলো এখনও খেলা করে। এটি মূলত চতুষ্কোণ একটি বাড়ি। তবে এখন আর তা চেনার উপায় নেই। ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গে  বর্তমান রূপলাল হাউজের আকাশ-পাতাল ব্যবধান। দেয়ালগুলো বিবর্ণ, চুন সুড়কির আবরণ খসে পড়ছে। ভবনের অনেকটা অংশ ভাঙা। দেয়ালে গজিয়েছে বটগাছ। উপরে ওঠার সিঁড়িগুলোও ভাঙা। এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় সেখানে বাস করছে বেশ কিছু পরিবার। কিন্তু, ভবনটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। 

রূপলাল হাউজ দেখতে আসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নোমান আল আব্দুল্লাহ বলেন, বাড়িটি খুঁজে বের করতে আমার যথেষ্ট কষ্ট হয়েছে। আসলে রূপলাল হাউজ এখন আর কেউ চেনে না। অবহেলা-অনাদরে বাড়ির যে শ্রী হয়েছে তাতে কারো বোঝার সাধ্য নেই এই বাড়িটিই পুরনো ঢাকার ইতিহাসের একটি অংশ।’ 
বাড়িটি এখন ধ্বংসের মুখোমুখি। যদিও এর ভেতরে যাওয়া সহজ নয়। কারণ অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় দখলদারদের। ক্যামেরা দেখলে তো কথাই নেই। বাড়ির বর্তমান বাসিন্দারাও বাইরের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান না। অথচ স্থানীয়দের অভিমত- সরকার নজর দিলে বাড়িটি জাদুঘর হতে পারতো।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন লিখিত ‘পুরান ঢাকার ঘরবাড়ি’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রূপলাল হাউজ ১৮২৫ সালে আরমেনিয়ান জমিদার আরাতুন প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৮৩৫ সালে রূপলাল দাস এবং তার ভাই রঘুনাথ দাস বাড়িটি কিনে নেন। এরপর থেকে বাড়ির নাম হয় রূপলাল হাউজ। তখনকার যুগের অত্যন্ত ব্যয়বহুল স্থাপত্য এই বাড়ি। এর নকশা করে কলকাতার মার্টিন কোম্পানি। দ্বিতল এই ভবনের স্থাপত্যশৈলী অভিনব। এটি ‘উ’ আকৃতির ভবন। রূপলাল দাস ছিলেন ব্যবসায়ী। সামাজিক কর্মকাণ্ডে উদার ছিলেন। ছিলেন সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। রূপলাল হাউজে নিয়মিত সংগীতের আসর বসতো। গাইতো দেশ-বিদেশের বিখ্যাত গায়করা। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৪৮ সালে বাড়িটি সরকারি সম্পত্তি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সিদ্দিক জামাল নামে একজন দাবি করেন, তিনি দাস পরিবার থেকে ১৯৭১ সালে রঘুনাথের অংশটি কিনে নিয়েছেন। সেই সুবাদে তিনি দ্বিতীয় তলায় বসবাস শুরু করেন। তারা ভারত চলে গেলে নুরজাহান এবং তার স্বামী দাবি করেন, এই অংশটি তাদের। তারাই বাড়িটির দখলে আছেন ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে। 

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) রাখী রায় বলেন, ‘রূপলাল হাউজ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। ১৯৪৭ সালে রূপলাল হাউজের লোকেরা তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে চলে গেছে। তখন থেকেই এটা পেঁয়াজ মরিচের ব্যবসার আড়ৎ। আড়ৎ উঠিয়ে দেয়ার জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। এখনও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি ভবনটি নিজেদের আওতায় আনতে। পরবর্তীতে আমরা এটা সংরক্ষণ করবো।’ 

এদিকে রূপলাল হাউজের বর্তমান অবস্থা জানতে কথা বলতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘যেহেতু এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সম্পদ, সেহেতু এই ভবন নিয়ে আমরা কিছুই বলতে পারবো না।’
 

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়