ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পাকি সিরিয়ালে রবীন্দ্রসংগীত: বাংলা গানে শত্রুজয়

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৫, ১০ জুন ২০২১   আপডেট: ১২:০৭, ১০ জুন ২০২১
পাকি সিরিয়ালে রবীন্দ্রসংগীত: বাংলা গানে শত্রুজয়

পাকিস্তানেও হানা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সম্প্রতি পাকিস্তানের এক টিভি সিরিয়ালে আমার পরাণ যাহা চায় গানটি গীত হতেই ভাইরাল হয়ে গেছে। এক সময় পকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ দিন পর সেই পাকিস্তানেরই জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালে ব্যবহৃত হলো রবীন্দ্রসংগীত। এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের এক টিভি সিরিয়ালে পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণে গাওয়া হয়েছে ‘আমার পরাণ যাহা চায়’। দেখে উচ্ছ্বসিত আপামর বাঙালি দর্শক।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওটি শেয়ার করেছিলেন পাকিস্তানি পরিচালক মেহরিন জাব্বার। তিনি আবার তাতে ইনস্টাগ্রাম লিংকও সংযুক্ত করে দেন। যাতে দেখা যায় পুরোনো একটি ভিডিওই নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে। মেহরিন জাব্বার পরিচালিত ‘দিল কেয়া করে’ ধারাবাহিকে ব্যবহার করা হয়েছিল গানটি। ক্যাপশনে মেহরিন জানিয়েছেন, গানটি গেয়েছিলেন শর্বরী দেশপাণ্ডে। পুরনো এই ভিডিওটি আদিল হোসেন নামে একজন বাঙালির চোখে পড়ে। তিনি সেটি আবার বৃহস্পতিবার (৩ জুন) টুইটারে শেয়ার করেছেন।

২০১৯ সালে পাকিস্তানের জিও টিভিতে সম্প্রচারিত হয় ‘দিল কেয়া করে’ ধারাবাহিকটি। মেহরিন জাব্বার-এর পরিচালনায় সিরিজের সংগীত পরিচালনায় ছিলেন পাকিস্তানের জনপ্রিয় সংগীত তারকা শাদাত আলী। ধারাবাহিকটির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফিরোজ খান, ইয়ুমনা জাইদি ও মির্জা জাইন বাগ।

এই পরিবর্তন বা পরিবর্তনের বাঁক ইতিহাস কীভাবে নেবে? আমরা বাংলাদেশীরা পাকিদের রবীন্দ্র-বিরোধিতার সবচেয়ে বড় শিকার। আইয়ুব খানের রোষাণলে পড়ে বঙ্গদেশে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন কবিগুরু। বাঙালি নামে পরিচিত কিছু মীরজাফর বাংলার দুশমন ছিল এই প্রক্রিয়ার হোতা। আজ যদি আমরা পেছনে ফিরে তাকাই লজ্জিত হবার বিকল্প থাকে না। স্বাধীনতার গান বা দেশপ্রেমের গান গেয়ে নামধাম করা গায়ক থেকে শুরু করে বিনোদন জগতের নায়িকা গায়িকা লেখক বুদ্ধিজীবী কতো জন যে এ নিষিদ্ধকরণের জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিলেন তার তালিকা রীতিমত ভয়ঙ্কর। এখন এদের উত্তরসূরী কিংবা পরিবার পরিজন হয় এসব কথা এড়িয়ে চলেন, নয়তো খোঁড়া যুক্তি দেন- সরকারের চাপে বা তখনকার বাস্তবতায় এমন করতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁদের পূর্বসূরীরা। আসলে কী তাই?

মূলত এ ছিল সাম্প্রদায়িক বাংলা ও বাঙালি নির্মাণের অনিবার্য প্রক্রিয়া। যেসব মহারথীরা রবীন্দ্র-বিরোধিতার জন্য মাঠে নেমেছিলেন তাদের ছানাপোনাদের অনেকে এখন আবার সুযোগ বুঝে কবিগুরু বিরোধিতায় কসুর করে না। এবার তাদের ভাষা বা আক্রমণের ধারা ভিন্ন। তারা জানে নিষি্দ্ধ করা অসম্ভব। তাছাড়া তারা এও জানে, আনন্দ বেদনা কষ্ট সুখে তাঁর গান তাঁর সৃষ্টিতেই আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে হয়। তাই এখন তাদের আক্রমণ বা টার্গেট রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত ভূমিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কবির বিরোধিতার প্রমাণহীন সব যুক্তি তর্ক এখন এদের হাতিয়ার। মূল বিষয় একটাই, যেন-তেন প্রকারে রবীন্দ্রনাথকে অপমান। বলাবাহুল্য এদের অপকৌশলের ভরসা পাকিস্তান। পাক-প্রীতি আর সাম্প্রদায়িকতাই এখানে পুঁজি। 

বলা উচিৎ, স্মরণ করা উচিৎ সেসব বাঙালিদের যাঁরা সরকারের আক্রোশ আর পাকিদের হামলা-মামলার তোয়াক্কা না করেই বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন কবির গান। ছায়ানট থেকে শুরু করে যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি লড়াইয়ে ছিলেন তাঁদের সহযোগী হয়েছিল তখনকার রাজনীতি। আওয়ামী লীগেরও নানা রূপ আছে। তখনকার রূপটি বাঙালি হবার সংগ্রাম। আর সে আন্দোলনের রূপকার এবং নেতা স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। তিনি তাঁর কথার বরখেলাপ করেন নি কখনো। দেশ স্বাধীন করে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে বেছে নেন জাতীয় সংগীত হিসেবে। তা নিয়েও কতো কথা, কতো ষড়যন্ত্র- এখনো সে অপকৌশল চলছে! মাঝখানে বিএনপি ও জামাত জোটের সরকার এমন এক আবহ তৈরী করে ফেলেছিল; মনে হতো অচিরেই বদলে যাবে আমাদের জাতীয় সংগীত। শেখ হাসিনার শাসনকালে বর্তমানে তা আর সম্ভব না। তবে সময় সুযোগে থাবা বিস্তার করার দুর্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আমাদের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের নিষিদ্ধকরণ ছিল পাকিস্তান পতনের শুরু। আজকের বাংলাদেশে যারা নানা অজুহাতে তাঁর বিরোধিতা করেন তাদের কোনো ধারণা নেই কতোটা গভীরে আছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ উপমহাদেশে দুটি দেশ বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীত রচয়িতা। সরাসরি না হলেও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতও তাঁর অবদানে ভাস্বর। তাঁকে মূর্খ দালাল ও রাজাকারের দল ছাড়া সবাই ভালোবাসেন। নতুন যেসব বুদ্ধিজীবী লাইনে আছেন তাদের বলি পাকিস্তানের দিকে তাকান। পাকিস্তানের নামে দিল ব্যাকুল আর যারা পাকিস্তান বলতেই নাক সিঁটকান সবাই জেনে রাখুন সেখানকার নতুন প্রজন্ম বদলেছে। বদলে গেছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে আর পরাজিতদের মনোভাব বুঝতে পাকিস্তান গিয়েছিলেন মুনতাসীর মামুন এবং মহিউদ্দীন আহমেদ। তারা পৌঁছে গিয়েছিলেন আত্মসমর্পণকারী পাকসেনা প্রধান নিয়াজীর বাড়িতে। জেনারেল নিয়াজীর দুই কন্যা তাদের বারবার অনুরোধ জানাচ্ছিল যেন ভারতকে বন্ধু মনে না করা হয়। তারা এই উপদেশ দিতেও ভোলে নি দরকার হলে ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলেও ভারতের সঙ্গে নয়। মুনতাসীর মামুন লিখেছেন: তিনি কন্যাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন দেয়ালের ছবিতে যেখানে অজয় দেবগন, কাজল আর শাহরুখের পোস্টার সেঁটে আছে। একটুও বিচলিত না হয়ে নিয়াজীর কন্যারা বলেছিল- সিনেমা গান বাজনার জন্য ভারত জায়েজ। এটাই পাকিস্তান।

তারা বিরোধিতা করার বেলায়ও অন্ধ। আজকাল সে দেয়াল ভাঙ্গছে। নবীন প্রজন্ম আমাদের বাংলায় ক্রমাগত পিছু হটলেও অন্য সবদেশে তারা অন্ধত্ব মুক্ত। আমি সিডনিতে দেখেছি ভারত আর পাকিস্তানের ছাত্রদের গলায় গলায় ভাব। মনে রাখতে হবে তাদের ভাষা পোশাক দৈহিক গড়ন এক। আমরা খামোখাই একদলকে সমর্থন করে আরেকদলের বিরোধিতা করি। কিন্তু এই ঘটনা এই সীমানা ডিঙানো মানুষটি বাঙালি। যিনি আমাদের আত্মার আত্মীয়।

রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে যদি ভারত পাকিস্তান বা বাংলাদেশ তাঁর গানের মালা গলায় জড়িয়ে বন্ধু হতে পারে তবে তার চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। মনে যাই থাক পাকিস্তানের টিভি সিরিয়ালে খাঁটি বাংলায় ‘আমার পরাণ যাহা চায় তুমি তাই’ মূলত বাংলার বাঙালির পাকিস্তানবিজয়। উড়ুক এই জয়পতাকা। 

লেখক: প্রাবন্ধিক
সিডনি থেকে, ৯ জুন, ২১

 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়