ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ফকির আলমগীর: গণ-মানুষের কণ্ঠস্বর

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৮, ২৬ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৭:৩০, ২৬ জুলাই ২০২১
ফকির আলমগীর: গণ-মানুষের কণ্ঠস্বর

ফকির আলমগীর (১৯৫০-২০২১)

কেন জানি— সময়ে-দুঃসময়ে, ক্রান্তিতে, ক্লান্তিতে, ক্লেশে, করুণায়, বেদনায়— আমার রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে। ২৩ জুলাই, মধ্যরাতেও তিনি স্মরণে এলেন— নিদারুণ শক্তি হয়ে... তাঁর গান অনেক দুঃসময় ভুলিয়ে দেয় আমাকে। আজো দিলো, মনে পড়ল তাঁর গান— ‘আরো আরো প্রভু, আরো আরো।/ এমনি করে আমায় মারো।/ লুকিয়ে থাকি আমি পালিয়ে বেড়াই,/ ধরা পড়ে গেছি আর কি এড়াই?/ যা কিছু আছে সব কাড়ো কাড়ো।/ এবার যা করবার তা সারো সারো।/ আমি হারি কিম্বা তুমিই হারো!/ হাটে ঘাটে বাটে করি মেলা,/ কেবল হেসে খেলে গেছে বেলা,/ দেখি কেমনে কাঁদাতে পারো।’

এই দুঃসময়ে কাছের মানুষ, যারা হারিয়ে যাচ্ছেন দূরে, সুদূরের সীমানায়— তাদের হারানোর বেদনা বুক থেকে সরানো যেন এক পাথর সরানো! ফকির আলমগীরকে হারিয়েও পাথর সরানোর চেষ্টা করছি। কত বার দেখা, কত কথা, কত স্মৃতি কেবল ভেসে উঠছে এখন। শাহবাগ, জাদুঘর, টেলিভিশন, টিএসসি, গোপালগঞ্জ সার্কিট হাউস, বাইগার তীরের পুণ্যভূমি টুঙ্গিপাড়া— আহা! কত কত স্থানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, আড্ডা হয়েছে— একটানা কত কথা যে তিনি বলতে পারতেন! তাঁর কথায় থাকত—তথ্য, তত্ত্ব, রাজনীতি, সমাজ, গান আর মানুষ। যে মানুষগুলো তাঁর গানের প্রধান চরিত্র সেইসব মানুষের কথাই বেশি। এ রকম লিজেন্ডদের কথা শুনতে আমার ভালোই লাগে। তাই মনে মনে ঠিক করলাম, আমি তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেবো। আর সেই আয়োজন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে। সেদিন ছিল ২৬ জুন ২০১৯, পড়ন্ত বিকেলে মুখোমুখি হলাম জাদুঘরের স্টুডিওতে। কালো টি-শার্ট, ঝাকরা কালো চুল, কালো জিন্সের প্যান্ট পরিহিত এ দেশের জনমানুষের কণ্ঠযোদ্ধা ফকির আলমগীরের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা একটানা কথা হলো। বললেন তাঁর জীবনের ভাষ্য। বললেন বাংলাদেশ, বাঙালি, বাংলা সংস্কৃতি ও তাঁর শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র গণ-সংগীত নিয়ে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ভুপেন হাজারিকার কথা। কথায় কথায় তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন অনেক অজানা অধ্যায়ে। আমি সমৃদ্ধ হলাম।

এই তো সেদিনও তিনি এলেন আমার কর্মস্থল জাদুঘরে। এলেন তাঁর ৭১-তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে। আমার অফিস কক্ষে ঢুকেই বললেন, শিহাব আমার প্রিয় ছোট ভাই— কফি খাওয়াও। এরপর বললেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে আর আমার বয়সও একাত্তর। শোনো, অনেক নামি-দামী মানুষও একাত্তর বছর বাঁচে না, সেখানে আমি বেঁচে আছি, এটি বড় অহঙ্কারের কথা। আমি যেমন একাত্তরের সন্তান, তেমনি ২০২১ সালেরও; বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আমার দেশ, সুতরাং আমি পৃথিবীর একজন গর্বিত মানুষ।

তাঁর লেখা কয়েকটি প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকার আমাকে দেখিয়ে আবারও বললেন, দেখো শিহাব আমি অনেক কাজ করছি; কাজেই মানুষের তৃপ্তি। আমার কোনো দুঃখ নেই। কারণ গণ-সংগীত করি, মানুষের কথা বলি, জীবনের কথা বলি, বাংলাদেশ ও বিশ্বের নিপীড়িত মানুষদের নিয়ে যারা সংগ্রাম করছেন, সেইসব মহান অবিসংবাদিত নেতাদের কথা বলি। বঙ্গবন্ধু, মওলানা ভাসানী, আফ্রিকার নির্যাতিত মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর নেলসন মেন্ডেলা আমার আদর্শিক চেতনা। আমি ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের গণ-যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র, আমি মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক, আমি গণমানুষকে মনে রেখে এগোচ্ছি সুন্দরের দিকে। যে সুন্দরের অন্বেষা করা দরকার পৃথিবীর দেশে দেশে, প্রতিটি দেশের প্রতিটি মানুষের। এই বলে উঠে গেলেন তাঁর জন্ম-উৎসবের মঞ্চের দিকে। এটিই শেষ দেখা... আহা!

নজরুলের মতো ঝাকরা চুলের তাঁকে দেখলেই আমার মনে হতো, গানের আর গণ-মানুষের এক লড়াকু সৈনিক তিনি। নিরন্ন-নিপীড়িত মানুষের এক দরদি কণ্ঠযোদ্ধা। অসাধরণ গায়কি দিয়ে এ দেশের মানুষের অন্তরে গেঁথে দিয়েছেন জাগরণী গান। তিনি যখনই তাঁর দৃপ্ত কণ্ঠে গাইতেন— ‘ও সখিনা, গেছস কিনা ভুইল্যা আমারে...’ বা ‘কালো কালো মানুষের দেশে’ কিম্বা ‘দেহেরও ভিতরে ডাইলে চাইলে’, অথবা ‘আহারে কালু মাদবর’, বা ‘ঘর করলাম না আমি’, কিম্বা ‘হঠাৎ কোন পথে’, অথবা ‘কামিলেরা কাম করিয়া’ বা ‘সান্তাহার জংশনে দেখা’,  কিম্বা ‘বনমালী তুমি’—তখন আপনার, আমার কী মনে পড়ে না ভুপেন হাজারিকার কথা— যিনি গেয়েছিলেন, ‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে...’। এই যে বিরলপ্রজ জনমানুষের শিল্পী; যারা নিজেরাই নিজেদের অবদানের জন্য বেঁচে থাকেন পৃথিবীর সীমানাজুড়ে। ভুপেন হাজারিকা চলে গেছেন, আজ চলে গেলেন ফকির আলমগীর।

স্টেজে গান গাইছেন ফকির আলমগীর

১৯৮২ সাল, তখন আমি কলেজে পড়ি, বয়স কত হবে বিশ বা একুশ। বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়া কোনো টিভি চ্যানেল তখন ছিল না। সন্ধ্যা হলেই সাদা-কালো টিভি সেটের সামনে বসে পড়তাম দল বেঁধে। আর বিটিভি’র ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠান। সেই তো এক বিনোদনের এক ঘণ্টার রসালো খাবার। সেই ঈদের আনন্দমেলায় ফকির আলমগীর তাঁর নিজের সুর করা গান যখন গাইলেন— ‘ও সখিনা, গেছস কিনা ভুইল্যা আমারে.../ আমি অহন রিশকা চালাই ঢাহা শহরে.../ সেবার বানে সোনাফলা মাঠ হইলো ছারখার,/ দেশ-গেরামে শেষে নামে আকাল, হাহাকার,/ সেবার বানে সোনাফলা মাঠ হইলো ছারখার,/ দেশ-গেরামে শেষে নামে আকাল, হাহাকার,/ আমরা মরি কী আসে যায় মহাজনের পাওনা টাকায়,/ বেবাক ফসল তুইলা দিলাম আমরা তাগোর খামারে...’। তখন সেই গ্রামের অভাবতাড়িত মানুষটি রিকশাওয়ালা ও সখিনাকে বাস্তবে দেখার জন্য আমাদের মন উসখুস করে উঠল। কে এই অভাবী নামবিহীন রিকশাওয়ালা আর তার দূর গ্রামে ফেলে আসা সখিনা? যেমন সুনীলের কবিতার নীরাকে দেখার বারবার ইচ্ছে হয়, তেমনি! 

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, নীরা শব্দের অক্ষর দুটিকে বদলে দিলে যা দাঁড়ায়, সেই নীরা অর্থাৎ নারী। এই নারী একজন নন— অসংখ্য নারী। তেমনি নিশ্চয়ই ফকির আলমগীর যে রিকশা চালকের কথা গানে তুলে ধরেছেন আর যে সখিনাকে বেদনার কথা বলছেন তিনি সুরে সুরে ও ছন্দে ছন্দে— তারা নির্দিষ্ট একজন কোনো রিকশাওয়ালা বা সখিনা নন, বাংলাদেশ তো বটেই পৃথিবীর হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ নিরন্ন, পরিশ্রমী, রক্ত-মাংসের মানুষই এই গানের চরিত্র। অর্থাৎ সুনীলের যেমন কমন শব্দ নারী, ফকিরের তেমনি কমন শব্দ মানুষ। বানে ভাসা বা অভাবের তাড়নায় ঘরছাড়া মানুষ শহর ঢাকায় এসে কী নিদারুণ কষ্ট করে! ফকির বলছেন, ‘হাজার ঠ্যাটায় গরিব ঠকায়, তাকায় রাঙা চোখে মিডা কথা কয় না তো কেউ আমরা ছোডলোকে, লক্ষ মশার উৎপাতে রাত কাটে না ফুটপাতে, লয় মনে আজ বদলা লমু, উইড়া যামু তোর ধারে...।’

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘সখিনা আবহমান বাংলার প্রেমিকা ও বধূ। কারও কাছে দুঃখিনী পল্লিবালা, আবার কারও কাছে আহ্লাদি বোন। কারও কাছে সে বন্যায় ভেসে যাওয়া বিক্ষুব্ধ চিৎকার। এই সখিনা কখনো রিকশাওয়ালার প্রিয়তমা স্ত্রী। কখনো কারখানার শ্রমজীবী নারী, কখনোবা ফুটপাতের ইটভাঙা শ্রমিক। সখিনা আমার গানের একটি কালজয়ী চরিত্র। প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের সুখ, দুঃখ, ব্যথা, বেদনা, বিরহ, মিলন, সংঘাত, অতৃপ্তি সবকিছু যেন ধরা পড়েছে ‘সখিনা’ নামক একটি শব্দে। সখিনা একটি প্রতীকী সত্তা, যার মাধ্যমে আমি একটি জনপদের জয়-পরাজয়, প্রেম, ভালোবাসা, সংগ্রাম, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আশা, আকাঙ্ক্ষা আর বিজয় প্রকাশ করতে চাই। তাই তো আমার সংগীতভুবনে পৃথিবীর সব দুঃখী নারী একটি নারী হিসেবে ধরা পড়ে, তার নাম ‘সখিনা’।’

তাঁর ‘এক ধার দুধের দাম’ গানটির কথাই ধরুন। কী যে দরদ দিয়ে, কী যে আকুলতায়, কী যে আবেগ দিয়ে গেয়েছেন; শুনলেই আমাদের ভেতর নড়ে ওঠে। এই গানের নেপথ্যের গল্পটি তিনি নিজেই বলেছেন, ‘১৯৭৭ সালের ঘটনা। মাকে নিয়ে গাড়িতে ফরিদপুর যাচ্ছি। আরিচা ঘাটে আমাদের গাড়ি থামে। ফেরি পার হতে হবে। এই সময় এক অন্ধ বাউলের সঙ্গে দেখা। বাউলটি দেহতত্ত্বের গান গাইছেন। গানটি শুনেই আমার কানে লেগে যায়। সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ডার বের করে গানটি রেকর্ড করি। আমার মা-ও গানটি মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন। বাড়ি যাওয়ার পথে গাড়িতে বসেই বারবার ভাবি গানটি কীভাবে নিজে গাইব। গানটি শুনে খুব আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। ঢাকা ফিরে নিজের মতো করে গানটি তৈরি করি। এরপর বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে গানটি পরিবেশন করি। পরে অজিত রায় গানটি নতুন করে রেকর্ড করান। এটি নব্বই দশকের কথা। মাঝেমধ্যে গানটি গাইতে গিয়ে মাকে খুব মনে পড়ে। গানটির কথায় এত দরদ যে অনেক সময় আমি কেঁদে ফেলি।’

এবার আসতে চাই, তাঁর আরেকটি কালজয়ী গানের কথায়—‘কালো কালো মানুষের দেশে’। এই গানটিরও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ও গল্প আছে। ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষদের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজত-জয়ন্তী উপলক্ষ্যে ঢাকা এসেছিলেন। এ সময় তাঁকে ‘কালো কালো মানুষের দেশে’ গানটি শুনিয়েছিলেন তিনি। সেজান মাহমুদের লেখা এই গানটি সম্পর্কে তাঁর নিজের কথা—‘তখনকার প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে টেলিফোন করে হোটেল শেরাটনে আসতে বলেন। আমার স্ত্রীকেও নিয়ে আসতে বলেছিলেন। কারণ, নিজের হোটেল কক্ষে নেলসন ম্যান্ডেলা আমার সঙ্গে দেখা করবে। তখন দ্রুত ছুটে গেলাম শেরাটনে। আমার স্ত্রীও ছিল সঙ্গে। অনেকেই দেখা করবে বলে লবিতে অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমাকে সরাসরি তাঁর রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি তখন বঙ্গভবনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। আমাকে নিয়ে নিচে নেমে এলেন এবং নেমেই বললেন, গানটা গাও। আমি যখন গানটা ধরেছি, তিনি আমার সঙ্গে আফ্রিকান ধরনে নাচতে শুরু করলেন, সেটা এখনো আমার চোখে লেগে আছে। আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।’

বাংলা কবিতায় যেমন পঞ্চপাণ্ডব কবি রয়েছেন, তেমনি বাংলা গানেও রয়েছেন পঞ্চপাণ্ডব শিল্পী। পাশ্চাত্য আধুনিক কবিতার ঊর্বর ক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, অমিয়, সুধীন ও বিষ্ণু দে যেভাবে রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা কবিতাকে ঊর্বর করেছেন, তেমনি বাংলাদেশের গানেও নতুন মাত্রা যুক্ত করেন এই পঞ্চ শিল্পী। এঁরা হলে— ফকির আলমগীর, আজম খান, পিলু মমতাজ, ফেরদৌস ওয়াহিদ ও ফিরোজ সাঁই। এঁদের একজন এখন বেঁচে থাকলেন—ফেরদৌস ওয়াহিদ। এঁরা বাংলাদেশে প্রচলন করলেন, পপ-সংগীত ও গণ মানুষের লোকসংগীত।

দীর্ঘ দিন এই বৃত্তে থেকে ফকির আলমগীর সংগীতের শুদ্ধ চর্চা করেছেন। সেই ষাটের দশকেই ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’ ও ‘গণশিল্পীগোষ্ঠী’র সদস্য হিসেবে ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে এবং ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে গণসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। গণ-অভ্যুথান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ৯০-এর সামরিক শাসনবিরোধী গণ-আন্দোলনে তিনি শামিল হয়ে ছিলেন তাঁর গান দিয়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধ তাঁর চেতনাকে প্রবলভাবে নাড়িয়েছে। সেকারণে সরাসরি কণ্ঠযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেশজ সংগীতের সাথে পাশ্চাত্য সংগীতের মেল-বন্ধন ঘটিয়ে পপ গানের সূচনা করলেন। এবং এই সময়ের উল্লিখিত সেরা গানগুলোই তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছে। তাঁর নিজের কথায় জানা যায়, তিনি প্রায় এক হাজার গান করেছেন। গান করার পাশাপাশি স্বাধীনতা-উত্তরকালে তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠন ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন, বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি হন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহসভাপতি হন, জনসংযোগ সমিতির সদস্যসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মযজ্ঞের জন্য পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা—যেমন, ‘একুশে পদক’, ‘শেরেবাংলা পদক’, ‘ভাসানী পদক’, ‘সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ড অব অনার’, ‘তর্কবাগীশ স্বর্ণপদক’, ‘জসীমউদ্দীন স্বর্ণপদক’, ‘কান্তকবি পদক’, ‘গণনাট্য পুরস্কার’, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক মহাসম্মাননা’, ‘ত্রিপুরা সংস্কৃতি সমন্বয় পুরস্কার’, ‘ঢালিউড অ্যাওয়ার্ড যুক্তরাষ্ট্র’, ‘জনসংযোগ সমিতি বিশেষ সম্মাননা’, ‘চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড বিশেষ সম্মাননা’ ও ‘বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ’।

ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফকির আলমগীর, পিলু মমতাজ, ফিরোজ সাঁই ও আজম খান

তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হলো—‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও বিজয়ের গান’, ‘গণসংগীতের অতীত ও বর্তমান’, ‘আমার কথা’, ‘যাঁরা আছেন হৃদয়পটে’। হৃদয়বান ও সদা স্বতঃস্ফূর্ত মানুষ ফকির আলমগীরের জন্ম ১৯৫০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি। তিনি কী তখন জানতে তাঁর জন্মদিনই হবে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস? কিন্তু তাঁর জন্মের দুই বছর পর সেই একুশের দিনে ঢাকার রাজপথে বাঙালি তাজা তরুণরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন মাতৃভাষা বাংলা। ফকির কী পরর্তীতে রক্ত-রঞ্জিত ভাষার চেতনা ধারণ করেছিলেন? নিশ্চয়ই। কারণ বাঙালির ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতির মূল চেতনাকেই তিনি ধারণ করেছেন, ধাতস্থ করেছেন এবং প্রতিফলন ঘটিয়েছেন সমাজে। এ জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বলিষ্ঠ শব্দসৈনিক হিসেবে দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধ করেছেন। একজন ত্যাগী মানুষের ব্রত ছিল তাঁর। বঙ্গবন্ধুর পুণ্যভূমি, নদী মধুমতীর তীরের জেলা ফরিদপুরে জন্ম বলেই নয়, ফকির তাঁর ভালোবাসার গভীরে রেখে দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যে ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে তাঁর জন্ম— পদ্মা সেতুর বদৌলতে সেই গ্রাম এখন আলোকিত ও আধুনিক ছোঁয়ায় হয়ে উঠছে উজ্জ্বল। অথচ সেই আলোর ছোঁয়া পেলেন না, দেখে যেতে পারলেন না, যে তাঁর গ্রামের ঐ রিকশাওয়ালাকে; যিনি ঢাকা থেকে ফিরে গেছেন কালামৃধাতে, ফিরে গেছেন প্রিয়তম সখিনার কাছে, আহা!

বাঙালির পহেলা বৈশাখ মানেই রমনার বটমূলে ছায়ানটের গান আর অনতি দূরেই সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের (যেখানে জিয়াউর রহমান শিশু পার্ক বানিয়েছেন) কোণায় গান করতেন আপনি, সঙ্গে থাকত আপনার ঋষিজ-এর শিল্পীরা। কত কত পহেলা বৈশাখে সকালের কড়া রোদে দাঁড়িয়ে আপনার গান শুনেছি। মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে এখন কী আর শুনবো না আপনার গান। আপনি কী আর আসবেন না জাদুঘরে? ২১ শে ফেব্রুয়ারি সামনেই— আমরা আপনার উপস্থিতিতে পালন করতে চাই, আপনার বাহাত্তরতম জন্মদিন। সেদিনের মতো আমার অফিস কক্ষে ঢুকে, আয়নায় দেখে নেবেন না আপনার ঝাকরা চুলের চেহারা? এসে বলবেন না, শিহাব ছোটভাই এক কফি দাও। ঠিক আছে— না এলেন, আপনার গান তো আছে। সখিনা, নদী, মানুষ তো আছে? আছে আপনার কালামৃধা থেকে ঢাকা— এই ভৌগলিক সীমানা। মনে করি, যতদিন নদী পদ্মা আর মধুমতী আর বুড়িগঙ্গার জলতরঙ্গ থাকবে, যতদিন যুগে যুগে সখিনারা থাকবে, যতদিন অমূল্য থাকবে মায়ের দুধের দাম, কিম্বা পৃথিবীজুড়ে থাকবে কালো কালো মানুষেরা ততদিন ফকির আলমগীর আপনিও থাকবেন তাদের অন্তরে। হে অনন্তের অভিযাত্রী, অভিনন্দন আপনাকে, ভালো থাকুন সুদূরে।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়