ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শামসুর রাহমান এবং কবির সামাজিক মর্যাদা

মারুফ রায়হান  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩৭, ১৭ আগস্ট ২০২১  
শামসুর রাহমান এবং কবির সামাজিক মর্যাদা

আজ সতেরোই আগস্ট কবি শামসুর রাহমানের চোখের আড়াল হওয়ার পনেরো বছর। মাত্র দুদিন আগে পনেরোই আগস্টে বঙ্গবন্ধু স্মরণে একটি জাতীয় দৈনিকের ক্রোড়পত্রের শীর্ষ রচনা হিসেবে প্রকাশিত হলো তাঁরই কবিতা ‘গাছ, কফিন এবং নৌকা’, যেটি তিনি লিখেছিলেন তাঁর চলে যাওয়ার এক দশক আগে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। কপট বঙ্গবন্ধুপ্রেমী নিন্দুকেরা বলে থাকেন শামসুর রাহমান অনেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে নিয়ে কবিতা লিখলেও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নীরব। তাদের এই কবিতা এবং অন্তত ‘ইলেকট্রার গান’ (ইকারুসের আকাশ কাব্যের) পড়তে বলি। এ দুটি কবিতাই ঠিক সাধারণ মানুষের বোধগম্য কবিতা নয়, যেমনটা কবির স্বাধীনতা বিষয়ক অতিবিখ্যাত দুটি কবিতা। তাই বোধকরি বঙ্গবন্ধুকে আপন সত্তায় গভীর অনুভব করে লেখা এই চমৎকার দুটি কবিতা পনেরোই আগস্টে ব্যাপকভাবে পঠিত হয় না।

বিশেষ করে ঘাতকের বুলেটে ঝাঁজরা জাতির পিতার মরদেহ অবহেলায় অতিসাধারণ কফিনে রাখার ইতিহাসখচিত সত্যের এমন প্রতীকী ও ব্যঞ্জনাঋদ্ধ ‘গাছ, কফিন এবং নৌকা’ কবিতা আমাদের মাথায় তুলে রাখার কথা ছিল। একটি কফিন কীভাবে দেশব্যাপী সন্তরণশীল একটি নৌকা হয়ে ওঠে এবং তার আড়ালে জাগরূক থাকে একটি সুদীর্ঘ গাছ- তারই শিল্পিত এবং অবশ্যই শামসুর রাহমানীয় বয়ান আমরা শুনি এই কবিতায়। আমাদের দুর্ভাগ্য, আগের মতো আমাদের দেশে আর কবি ও কবিতার কদর নেই, নেই তেমন সংবেদনশীল বোদ্ধা পাঠক এবং সত্যিকারের কবিতার ব্যাখ্যাদাতা, বিশ্লেষক বা সমালোচক। তাই ‘প্রথম আলো’র পনেরোই আগস্টের আয়োজনে সেই পুরনো ‘ভোরের কাগজ’-এ প্রকাশিত এই কবিতার পুনরায় প্রকাশ আমার কাছে বিশেষ তাৎপর্যবহ। বিশেষ করে কবির প্রয়াণবার্ষিকীর মাত্র দুদিন আগে। আমরা শামসুর রাহমানকে অনানুষ্ঠানিকভাবে পোয়েট লরিয়েট অথবা প্রধান কবির মর্যাদা দিয়েছিলাম। প্রথমত কবি ও কবিতাপাঠকদের ভেতরেই ছিল এই বোধ, পরে সারস্বত সমাজে সেটি গৃহীত হয়। এমনকি যিনি যে রাজনৈতিক দলের নেতা হোন না কেন, শামসুর রাহমানের এই মাহাত্ম্য মান্য করে গেছেন।

শামসুর রাহমানের জীবদ্দশায় কি প্রধান কবি আর কেউ ছিলেন না, বা অন্য কারো কবির সেই যোগ্যতা ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। একটি সমাজে সমসময় কয়েকজন থাকতে পারেন প্রধান কবিতুল্য ব্যক্তিত্ব। এই পদ বা পদবী কোনো ভোটাভুটি কিংবা সিলেকশন বা রাষ্ট্রনির্ধারিত বিষয় তো নয়। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যেন হয়ে ওঠে, বিকশিত হতে থাকে। সমাজে না-গৃহীত হওয়ার ঝুঁকি-ঊর্ধ্ব একটি অঘোষিত সম্মান এটি। প্রায় সকল কবি শামসুর রাহমানকে প্রধান কবি হিসেবে মান্য করেছেন। এমনকি তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ মেন্টরতুল্য এক বা একাধিক কবিও। কোনো বিরূপতা ও বৈরিতার মুখোমুখি হতে হয়নি তাঁকে। তরুণ পাঠকরা মনে রাখবেন, আমি বলছি, আল মাহমুদ, সৈয়দ আলী আহসান বা ফজল শাহাবুদ্দীনের মতো কবিও আমাদের শামসুর রাহমানের কবিসত্তাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতেন, আর প্রধান কবি হিসেবে অস্বীকার করতেন না। এমনকি যে-স্বৈরশাসকের কারণে সারাজীবনের কর্মস্থল কবি ছেড়ে এসেছিলেন সেই হোসেইন মো. এরশাদও শ্রদ্ধা করতেন কবিকে।

আজকে, এই ২০২১ সালে কি বাংলাদেশে কেউ প্রধান কবি হতে পারেন না? না, সর্বসম্মতভাবে আর পারেন না। উৎকৃষ্ট কবি ঢের আছেন আমাদের সমাজে, কিন্তু এখন কবি-উপকবি-ছদ্মকবি-অকবিদের এমন দাপট, আর মিলেমিশে কিংবা বিচ্ছিন্ন থেকেও অসমর্থন প্রকাশ না করার মধ্য দিয়ে এমন একটি কবিসমাজ সক্কলে গড়ে তুলেছেন, সেখানে একটা সামান্য পুরস্কার বা পদক পেলেও একজন কবিকে বিতর্কিত করে তোলা হয়, মৃত্যুর আগেই তাঁর শবব্যবচ্ছেদের উৎসব শুরু হয়ে যায়। আর কবিতার পাঠক-ক্রেতা? শামসুর রাহমানের কালে সারা দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই ছিলেন এই বলয়ের বড় অংশ। বর্তমানে ভয়ানকভাবে সে-সূচক নিম্নগামী।

তো শামসুর রাহমানও অনুধাবনে সমর্থ হয়েছিলেন যে কবিসমাজ, সারস্বত সমাজ, সার্বিকভাবে দেশের মানুষ তাঁকেই সময়ের প্রধান কবি হিসেবে গণ্য করছেন। তাই তিনিও কাউকে বিমুখ বা হতাশ করার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি। সেইকালে কবি ও কবিতার সম্মান ছিল এই নষ্টভ্রষ্ট সমাজে; দুর্নীতিতে মহাসৃজনশীল এই রাষ্ট্রে। খবরের কাগজের যে কোনো বিশেষ দিবসের ক্রোড়পত্রে পাতাজুড়ে সাজানো থাকতো কবিতা, যার শীর্ষে জ্বলজ্বল করতো শামসুর রাহমানেরই কবিতা। তখন কালেভদ্রে কোনো কোনো কাগজের ওই পাতার একেবারে নিচের দিকে থাকতো এই নগণ্য লেখকের লেখা।

শামসুর রাহমানের বিরল একটি গুণ ছিল তিনি প্রত্যেকের কবিতা পড়তেন। আমার নিজের চোখে দেখা-  আশির দশকের একেবারে শেষদিকে ‘দৈনিক বাংলা’ ভবন পরিত্যাগের পর সাপ্তাহিক ‘মূলধারা’র প্রধান সম্পাদকের চাকরি করার সময় বিশেষ সংখ্যার জন্য কবিতা বাছাইয়ের অধিবেশনে বসতাম দুজন। তিনি নবীনতম কবির কবিতাটিও মনোযোগ সহকারে পড়তেন। কবিতা পড়ার বেলায় তিনি রুচির ধার ধারতেন না বটে কিন্তু গুরুত্ব দেবার ক্ষেত্রে তাঁর নিজের বিশেষ একটি হিসাব ছিল, যার তল আমি পাইনি। তখন ফরহাদ মজহার একদিন নিজে সবগুলো কবিতার বই তাঁকে উপহার দেবার জন্যে নিয়ে এসেছিলেন। অনেকেই আসতেন, তবু এই একটি নাম উচ্চারণ করলাম এটি বোঝাতে যে শামসুর রাহমান ছেপেছেন ফরহাদ মজহারের কবিতা, কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব দেননি কখনোই। সে যাক। শামসুর রাহমান বিদেশি কবিতাও সাগ্রহে ‘গিলতেন’। তাঁর এই স্বভাবের কথা কাছের মানুষরা জানতেন বলে কেউ দেশের বাইরে গেলে কিংবা প্রবাস থেকে কেউ এলে তাঁর জন্যে সেখান থেকে কবিতার বই সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। তাঁর ব্যক্তিগত পাঠাগারে যতো বিদেশি কবিতার বই আছে, সে সময়ে আর কোনো কবির কিংবা পণ্ডিতের সংগ্রহে ততো বই ছিল না, এটি আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি।

শামসুর রাহমান কবিতাময় ভুবনেই সার্বক্ষণিকভাবে বসবাস করতেন। অন্যের কবিতা পড়া, অন্যের কবিতা বাছাই করে ছাপতে দেয়া এবং নিজের নতুন কবিতার দিকে মন দিয়ে রাখা- এই পরিভ্রমণের ভেতরেই তিনি ছিলেন আমৃত্যু। আর কেউ কবিতা চাইলে কখনোই তাঁকে ফেরাতেন না। দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রিকার কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দারুণ চাপ থাকতো বিশেষ বিশেষ দিবসের আগে-আগে। এছাড়া সাহিত্য পত্রিকা, এমনকি ছোটকাগজের জন্যও লিখতেন তিনি। যখন নিজের খুব পছন্দমতো কবিতা আসছে না তখনও তাঁকে দেখেছি একটা লাইন লিখে উঠেছেন। আর আশ্চর্য লিখনক্ষমতায় তিনি সেই চরণটিকে সমিল চতুর্দশপদী করে তুলেছেন পঁচিশ-ত্রিশ মিনিটের মধ্যে।

আমি নিজে কোনো কোনো পত্রিকার জন্য অনেকবারই তাঁর কবিতা নিয়েছি। দেবার সময়ে প্রতিবার তিনি বলতেন, পড়ে দেখ তো মারুফ। তাঁর সামনেই পড়তাম। মন্তব্য করতাম। কখনো কখনো বলেছিও এই কবিতার শিরোনাম বদলে দিয়ে এমনটি রাখতে পারেন। প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছেন, এমনটি কখনো ঘটেনি। এই যে তিনি অজস্র ধারায় লিখে যেতেন, বা বলা ভালো প্রধান কবি এবং দেশের সবচাইতে জনপ্রিয় ও সামাজিকভাবে মর্যাদাবান কবি হওয়ার সুবাদে তাঁকে লিখতেই হতো, বিষয়টি তিনি উপভোগ করতেন। না, সম্মান কদর বা মর্যাদা উপভোগের কথা বলছি না। বলছি অজস্র ধারায় কবিতা লিখে যাওয়ার বিষয়টি- এটি তিনি উপভোগ করতেন। এত বেশি লিখতেন বলে কখনো কখনো পুনরাবৃত্তি এসে যেতো। তিনি আসতে দিতেন। বইমেলায় কখনো কখনো জোড়ায় জোড়ায় কবিতার বই বেরুতো তাঁর। কেউ কেউ মৃদু অভিযোগ তো তুলতেনই। তিনি মৃদু হাসতেন। খুব কাছের মানুষ হলে বলতেন, আমার প্রতিটি বইয়ে আট-দশটি কবিতা থাকে যা নতুন, যার কোনো ধরনের ভাব বা ছাপ আগের কোনো বইয়ে নেই। 

কিন্তু আমরা জানি প্রায় সব প্রধান কবির, অবশ্যই বাংলা ভাষায়, প্রথম কাব্যে তাঁর স্বকীয় বিবেচনায় (সম্ভবত সময়ের ও সমাজের বিবেচনায়) প্রধান কবির কোনো না কোনো ছায়াপাত ঘটে। একই বছরে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও জীবনানন্দ দাশ বুঝেছিলেন তাঁর সময়ের এবং তাঁর সমাজে সত্যিকারের প্রধান কবিকণ্ঠ হলো কাজী নজরুল ইসলাম। হয়তো সে কারণেই জীবনানন্দের প্রথম কবিতার বইয়ে কান পাতলে শোনা যাবে নজরুলের কণ্ঠস্বর। একইভাবে ১৯৬০ সালে শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্য ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’-তে আমরা প্রত্যক্ষ করি জীবনানন্দের গহন গহীন প্রতিধ্বনি। শুরুর কথাই বলছি। তারপর কী জীবনানন্দ কী শামসুর রাহমান দুজনের কারোরই কবিতায় পূর্বেকার বা সমকালীন কোনো কবি মুখ তোলেননি। উভয়েই নিজস্ব ধরন, রীতি ও স্বর প্রতিষ্ঠা করে গেছেন বাংলা কবিতায়। 

জীবদ্দশায় জীবনানন্দ প্রধান কবির মর্যাদা পাননি। শামসুর রাহমানের সৌভাগ্য ঈর্ষণীয়। তিনি সর্বশ্রেণীর মানুষের সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছেন। সমাজলগ্ন সব কবি সামাজিক মর্যাদা পান না। বিদেশি কবিদের বেলায় ভিন্ন চিত্র। সমাজ-সজ্ঞান না হয়ে কল্পিত ভুবন, বা কল্পিত স্বর্গ-নরক গড়ে তুলে তার ভেতর শতভাগ নিমজ্জিত থেকে কবিতা রচনা করে অনেক বিদেশি কবি হয়ে উঠেছেন আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত কবি। বাঙালি সমাজে মাটিতে পা রেখে সমাজ ও রাষ্ট্রের স্পন্দন নিজ হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে সমতানে রেখে কবিতা রচনাকারীদের ভেতর থেকেই সমাজ বেছে নিয়েছে তাদের প্রধান কবিকে। 

যত দিন কবি জীবিত ছিলেন, যত দিন দেশে কবি ও কবিতার প্রত্যাশিতসংখ্যক পাঠক ছিল, যত দিন কবি-ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা বজায় ছিল, অর্থাৎ কবি নিজে স্বচ্ছ, সহৃদয়, অবিতর্কিত অবয়বে সময় ও সমাজের অলৌকিক সন্তান হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন, তত দিনই আমরা শামসুর রাহমানের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশে কার্পণ্য দেখিনি। আজ তাঁর চলে যাবার দেড় দশক পেরিয়ে মনে হচ্ছে আমরা যেন পেছনে ফেলে এসেছি পুরো দেড় শতাব্দী! কবি ও কবিতার দেশে এমন পতন অবনমন অনিবার্য ছিল না।

১৭ আগস্ট ২০২১
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়