ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাংলাদেশ পড়ে আছে বুক খোলা লাশের মতো: মুর্তজা বশীর

অলাত এহ্‌সান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৫, ২০ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১৮:১৭, ৫ মার্চ ২০২৪
বাংলাদেশ পড়ে আছে বুক খোলা লাশের মতো: মুর্তজা বশীর

আলোকচিত্র: মোহাম্মদ আসাদ

ছয় দশকের অধিক সময় চিত্রকলায় সক্রিয় ছিলেন মুর্তজা বশীর। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন। বিভিন্ন সময় তার আঁকা সিরিজ— ওয়াল, উইংস, এপিটাফ ফর দ্যা মার্ডারস, ওমেন, কালেমা তৈয়বা, কোলাজ ইত্যাদি জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু তিনি জনপ্রিয়তায় আটকে থাকেননি। ক্রমাগত বদলেছেন বিষয় ও প্রকরণ। চিত্রকলায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছেন। গত ১৭ আগস্ট ছিল মুর্তজা বশীরের জন্মদিন। তাঁকে স্মরণ করে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো। ২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট বর্ষিয়ান এই চিত্রশিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ গল্পকার অলাত এহ্‌সান 

অলাত এহ্‌সান: আপনি নন-ফিগার বা অ্যাবস্ট্রাক্ট খুব কম এঁকেছেন। ফিগারই অধিকাংশ। সেখানে আমাদের দেখা ফিগারের ভেতর আপনি চিন্তা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। আপনার ‘আমার জীবন ও অন্যান্য’ বইয়েও লিখেছেন: ‘আমি নন-ফিগার থেকে ফিগারিটিভে ফিরে এলাম।’ এই যে ফিগারে ফিরে আসা— এটা কেন?

মুর্তজা বশীর: ব্যাপার হলো কি, যে কোনো শিল্পীকে যদি জিজ্ঞেস করা যায়, তার ছবি আঁকার প্রেরণা কবে থেকে? এই আকাঙ্ক্ষা কবে থেকে? সবাই এক বাক্যে বলবে যে, ছোটবেলা থেকে শখ ছিল তারা ছবি আঁকবে, আর্টিস্ট হবে। (আপনার তো তা কখনোই ছিল না—অলাত এহ্‌সান)। না, আমার তা কখনোই ছিল না। আমি আর্টিস্ট হবো এরকম কোনোদিন বাসনা ছিল না। তখন ছবি দেখতে আমার ভালো লাগতো। আমার বাবার লাইব্রেরিতে আমি যখন ঢুকতাম, সেখানে ‘ভারতবর্ষ’, ‘বিচিত্রা’, ‘বঙ্গশ্রী’, ‘মর্ডান রিভিউ’, ‘প্রবাসী’ ইত্যাদি পত্রিকায় তখনকার বাঙালি যারা প্রধান শিল্পী তাদের রঙিন ছবি ছাপা হতো। দেখতাম। পরবর্তীকালে এনসাইক্লোপিডিয়া, ব্রিটানিকায় পিকাসো, মাতিস, ভ্যান গগ, পল গগা এদের ছবি দেখেছি। ১৯৫৬ সালে বাবা যখন আমাকে পড়তে পাঠালেন (ইতালিতে গেলেন— অলাত এহ্‌সান)। হ্যাঁ, তখন এসব ছবি দেখার মধ্যে আকর্ষণ ছিল, কিন্তু চমক ছিল না। কারণ এগুলি তো ছোটবেলা থেকেই দেখেছি। পিকাসো’র ছবি আমার কাছে তেমন চমক লাগেনি। কারণ ছোটবেলা থেকেই পিকাসো’র কাজ দেখেছি। ওটা (বাড়িতে দেখা ছবির প্রতি ইঙ্গিত করে) ছিল রি-প্রোডাকশন, এটা প্রোডাকশন।

সেই সময়, ব্রিটিশ আমলে, তখন দেশ ভাগ হয়নি, আমাদের পরিবারে একটা অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ ছিল। তখন মুসলিম লীগের হয়ে অনেকেই পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু আমার বাবা কোনোদিন রাজনীতি করেননি এবং মুসলিম লীগের ঘোর সমর্থকও ছিলেন না। বেশির ভাগ মুসলিম; ৯৯ ভাগ, পাকিস্তান চায়, কিন্তু আমার বাবার ওই ব্যাপারে কোনো আগ্রহ ছিল না। সে সময়, ১৯৪৬ সালে আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি, বগুড়া থাকি। বাবা তখন ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের প্রিন্সিপাল। তখন কমিউনিস্ট পার্টি আত্মগোপনে, মানে অত প্রকাশ্য ছিল না। তাদের যে ছাত্র সংগঠন, তার নাম ছিল ছাত্র ফেডারেশন। সেটার সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত হই এবং সদস্য হই। তখন ছাত্র ফেডারেশনের অফিস, কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে যাতায়াত করতাম। ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার ফলে মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিনের নাম শুনি। আমার বাসনা হলো, আমি এদের পোট্রেট করবো। কিন্তু আমি তো ছবি আঁকা জানি না, কী করে আঁকবো? আমি রাস্তা দিয়ে যখন যেতাম, তখন তো আর ডিজিটাল ব্যানার হয়নি, রাস্তার মোড়ে সাইনবোর্ড পেইন্টাররা খোপ কেটে কেটে ওটাকে ব্লক করে বড় করতো। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম আর বাড়িতে এসে অনুশীলন করতাম। এরপর আমি বাইশ বাই ত্রিশ ইঞ্চি চারটি ছবি এঁকে ছাত্র ফেডারেশন অফিসে নিয়ে যাই। তারা ওটা পার্টি অফিসে দেয়। তখন সবে দেশভাগ হয়েছে; ১৪ অগাস্ট ১৯৪৭। এর ১৫ দিন পর কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক-নেতা ভবানী সেন বগুড়া এলেন। তিনি আমার সাথে দেখা করতে চাইলেন। আমাকে বললেন, খোকা এই ছবি তুমি এঁকেছো। আমি বললাম হ্যাঁ। তখন আমার অটোগ্রাফ জমাবার শখ ছিল। (এমনকি আপনার আঁকা ছবি পাঠিয়ে জওহরলাল নেহেরুর অটোগ্রাফ সংগ্রহ করেছিলেন— অলাত এহ্‌সান)। হ্যাঁ। তখন তিনি অটোগ্রাফে যে কথাগুলো লিখেছিলেন সেই কথাগুলো আজ পর্যন্ত, তখন আমার বয়স ছিল পনেরো, আজকে আমার পঁচাশি এবং ওটাই আমার জীবনের মোটো হয়ে গেল|

অলাত এহ্‌সান: আপনার বিভিন্ন সময়ের লেখার মধ্যে কিন্তু তা ঊর্ধ্ব কমার মধ্যে বলে দিয়েছেন।

মুর্তজা বশীর : হ্যাঁ। ‘আর্টিস্টের কাজ হলো শোষিত জনগণের অভাব ও দুঃখ-দুর্দশাকে চিত্রের ভেতর দিয়ে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা যাতে সমাজে সে আর্ট নবজীবন সৃষ্টি করতে পারে।’ এটা আমার হৃদয়ে একেবারে, যেমন কাঁচা সিমেন্টের ওপর দিয়ে একটা চাকা চলে গেলে দাগ হয় তা কিন্তু আর মোছে না, আমার হৃদয়ে তেমনভাবে গেঁথে গেল। পরবর্তীকালে পার্টি আমাকে বলল যে, তুমি আর্ট স্কুলে ভর্তি হও। আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলাম। ’৪৯ সালে ম্যাট্রিক দিয়ে ঢাকা চলে এলাম। আমার বাবা চাইলেন আমি আলীগড়ে (কলকাতা আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়) পড়তে যাই। এটা তখন মুসলিম আভিজাত্য ছিল। আমার বড় ভাই মুহাম্মদ শফীয়ূল্ল্যা, উনি আলীগড়ে পড়ালেখা করেছেন। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য হলো আর্ট, পড়া না। আমি যখন বাবাকে কথাটি বললাম তখন তিনি বললেন, তাহলে তুমি শান্তিনিকেতনে যাও। আমার বাবা রবীন্দ্র ভক্ত ছিলেন। বিশ্বভারতী যখন প্রতিষ্ঠা হয়, তখন রবীন্দ্রনাথ আমার পিতাকে চিঠি লিখেছিলেন যে, বিশ্বভারতীর কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সাথে বাবার চিঠিপত্র আদান-প্রদান ছিল। কিন্তু আমার তো ছবি আঁকাটা মূল উদ্দেশ্য না, তাই আমি শান্তিনিকেতনে যেতে চাইলাম না। আমি ঢাকাতেই থাকতে চাইলাম। ঢাকায় পার্টির কার্যক্রমে যুক্ত হবো এই ভাবনায়।

এখন যে অবস্থা, তেমন ছিল না। তখন শিল্পীরা ছিল ভাব জগতের বাসিন্দা। সমাজের সঙ্গে কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না। তখন ওটার নাম ছিল গর্ভমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্ট, আমি সেখানে ভর্তি হলাম। (’৪৯ সালে, দ্বিতীয় ব্যাচে— অলাত এহ্‌সান)। হ্যাঁ। আমার বাবা বাঁধা দিয়েছিলেন। এটা একটা ‘ইয়ে’ আছে, লোকজন যেটা বলে— যেহেতু তিনি ধর্মভীরু লোক ছিলেন, সেই জন্য তিনি বাঁধা দিয়েছিলেন। কিন্তু অ্যাকচুয়্যালি তা না। তিনি যেটা বলেছিলেন, সেটা আমার লেখার মধ্যে আমি বলেছি।

অলাত এহ্‌সান: তিনি (ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ) বলেছেন যে, দেখ আমি প্যারিস ঘুরে দেখেছি শিল্পীরা খুব কষ্টে-সৃষ্টে, অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন যাপন করেন, আমি চাই না আমার সন্তান হয়ে তুমিও সেই কষ্ট করো। 

মুর্তজা বশীর: হ্যাঁ। সন্তানকে ওই রকম কষ্টের জীবনযাপন করতে দিতে চাননি। তারপর বাবা আমাকে টাকা দিলেন ভর্তি হওয়ার জন্য। 
মজার ব্যাপার হলো, তিনি লাইব্রেরিতে আমাকে নিয়ে গেলেন। তাঁর লাইব্রেরিতে ছোট্ট একটা মেহগণি কাঠের আলমারি ছিল। সেটার ভেতরে মূল্যবান বইপত্র, কাগজপত্র রাখেন। ওটা চাবি মারা থাকতো। ওটা খুলে ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়ামের দুই খণ্ড ক্যাটালগ যেখানে রাফায়েল, দ্য ভিঞ্চি, ইংলে, বোতেচেল্লি এদের কাজ-টাজ ছিল।

অলাত এহ্‌সান: এটা ফ্রান্সে ভারতীয় ছাত্ররা তাঁকে ...

মুর্তজা বশীর: উপহার দিয়েছিল। তাতে বোঝা যায় তিনি আর্ট লাভার ছিলেন। কারণ তিনি প্যারিসে ডক্টরেট করার পর, যার বিষয়বস্তু ছিল চর্যাপদ, ফলে তাঁকে চর্যাপদের ওপর বই দেয়ার কথা, কিংবা ভালো কলম দেয়ার কথা। তাঁকে এটা (ল্যুভর ক্যাটালগ ইঙ্গিত করে) দেয়ার মানে হলো তিনি শিল্পরসিক ছিলেন, শিল্পপ্রেমী ছিলেন। বই দুটো অনেকটা নিষিদ্ধ ফলের মতো ছিল। কারণ ওর মধ্যে কিছু বিবস্ত্রা নারীর ছবি, যা ওই রকম বয়সে কৌতূহল তৈরি করে। কিন্তু আমার বাবা কোনো রকম দ্বিধা না করে বই দুটো আমার হাতে দিলেন। এবং বললেন যে, এতদিন আমার কাছে ছিল, আজ থেকে তোমার। এটা তাঁর অন্যান্য সন্তান, যারা কেউ বিবাহিত কেউ অবিবাহিত, তাদের দিলেন না। কারণ তিনি এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন, এই বিবস্ত্রা নারীরা আমার কাছে সৌন্দর্যের প্রতীক হবে, যা অন্যদের ভেতরে একটা কামভাব জাগ্রত করতে পারে। এই যে ডিফারেন্ট বিটুইন ন্যুড অ্যান্ড ন্যাকেড, এটা আমি লিখেছি।

বাংলাদেশের প্রকৃতি এতই সুন্দর, যে কোনো শিল্পী জল রঙে প্রকৃতির দৃশ্যই বেশি আঁকে। কিন্তু আমি প্রকৃতির দৃশ্য খুব আঁকিনি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে মানুষই হচ্ছে সুপ্রিম। অতএব প্রকৃতির ছবিতে প্রকৃতিই প্রধান হয়, মানুষ খুব ছোট হয়। আমার বাবা যখন আমাকে ইতালি পাঠালেন, ফ্লোরেন্সের প্রাকৃতিক দৃশ্য এত সুন্দর মানে একেবারে স্বপ্নের মতো! কিন্তু আমি ওগুলো না এঁকে ওই যে সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবন, চলমান জীবন, ওই যে ভবানী সেনের যে কথা, ওটাই আমার মোটো ছিল। যার জন্য আমি এখনও যে ছবি আঁকছি, ছবি আঁকার জন্য ছবি আঁকা, আর্ট ফর আর্ট সেক, কখনো করতে পারছি না। আমি করছি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। 

অলাত এহ্‌সান: তবে আপনার ‘আমার জীবন ও অন্যান্য’ বইটা পড়তে গিয়ে একটা বিষয়ে তন্ময় হয়ে যাচ্ছিলাম। সেটা হচ্ছে, ব্রিটিশ কাউন্সিলের পাশে আপনার বাবা হল প্রভোস্ট হওয়ার পর আপনারা যে বাসায় থাকছিলেন, সেখানে দেখছি আপনি কলাবাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। আর কলাবাগারেন ও-পাশেই একটা ঘরে। ঘরের ভেতরে বিগত যৌবনা এক বাঈজি ছিলেন।

মুর্তজা বশীর: ওটা ওখানে না। ওটা হচ্ছে এখন যেখানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তার পাশে ১০ নম্বর বাংলোতে থাকতেন। আমার বাবা আশ্রয় দিয়েছিলেন।  তিনি বাঈজি ছিলেন সেই মোঘল আমলের। 

অলাত এহ্‌সান: আপনি একটু আগে যে বিষয়টি খণ্ডালেন, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ধর্মের অনুশাসন মানতেন বলে আর্ট করতে দিতে চাননি। এটা কিন্তু তিনি নিজেও খণ্ডন করে গেছেন, একজন বিগত যৌবনা বাঈজিকে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়ে।

মুর্তজা বশীর: মানবিক কারণে। তার ভেতরে মানবিক বোধটা বেশি।

অলাত এহ্‌সান: তাকে নিয়ে আপনার কী রকম স্মৃতি? তার সঙ্গে কি আপনার কখনো কথা হয়েছিল?

মুর্তজা বশীর: কার সঙ্গে?

অলাত এহ্‌সান: বাঈজির সঙ্গে।

মুর্তজা বশীর: নাহ্। আমি তো ছোট তখন। আমার বয়স তখন ৯-১০, এ-রকম। কাছে যেতে দিতো না। খুব লম্বা। চোখে সুরমা দেয়া। খাড়া নাক। ঘাগড়া পরা। (সব সবয়ই এরকম থাকতেন? —অলাত এহ্‌সান)। হ্যাঁ, হুঁকা খেত, নলওয়ালা হুঁকা। কাছাকাছি গেলে বলতো— যাও যাও যাও।

অলাত এহ্‌সান: একটা বিষয় হচ্ছে যে, আপনি যখন বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন, তারপর ফিরেও এলেন, তখন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আপনাকে তিরষ্কার বা আঘাত করার পরিবর্তে বলছেন— তুমি লখনৌ পর্যন্ত গিয়েছিলে, আরেকটু গেলে আগ্রায় তাজমহল দেখে আসতে পারতে।  বিষয়টা গভীর আবার কৌতুককরও।

মুর্তজা বশীর: আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম এই জন্য যে, আমার ওই অনুশাসন ঠিক ভালো লাগতো না।

অলাত এহ্‌সান: পার্টির প্রতি আপনার ডেডিকেশন যে, পার্টি নির্দেশ দিয়েছে তাই আর্ট কলেজে পড়তে হবে। এই ডেডিকেশন ওই সময় ছিল, এখন কি তা দেখতে পান?

মুর্তজা বশীর: তখন আমরা ছিলাম আত্মোৎসর্গিত। আমাদের জীবনটাকে আত্মোৎসর্গ করেছিলাম। সেই সময় আমাদের কিছু বই পড়তে দেয়া হতো। যেমন জুলিয়াস ফুচিকের ‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’। আমি যখন এরেস্ট হলাম, আমাকে তারা নানা রকম ইন্টারকোশ্চেন করলো। কিন্তু ওই যে বইটা পড়েছিলাম, মারা যাবো কিন্তু কিছু বলবো না।

অলাত এহ্‌সান: ভীষণ নির্যাতনের চিত্র ওই বই। কী ভয়ঙ্কর! ফুচিককে মেরে দাঁতগুলো ফেলে দিচ্ছে, অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে, আবার রক্তের মধ্যেই ফেলে রাখছে কিন্তু তার কমিটমেন্ট থেকে নাড়াতে পাড়ছে না।

মুর্তজা বশীর: এগুলো আমাদের পড়তে হতো। এখন আমার কাছে যেটা মনে হয়, এখনকার প্রজন্মের মধ্যে সেই নিষ্ঠা নাই। এখন এরা নামে ছাত্র ইউনিয়ন করছে কিংবা বাসদ করছে। কিন্তু আমাদের সময় যে ডেডিকেশন ছিল সেটা এখন নাই। ১৯৮১ সালে আমি যখন চট্টগ্রামে থাকি, চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে পড়াই, তখন মুজিব মারা যাওয়ার পরে নাগরিক কমিটি, মজদুর পার্টির সঙ্গে বাসদ-জাসদ মিলে ওসমানী (এমএজি ওসমানী)কে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী দাঁড় করালো। বিএনপি থেকে দাঁড়ালো জাস্টিস সাত্তার আর আওয়ামী লীগ থেকে দাঁড়ালো ড. কামাল হোসেন। সেই সময় যেহেতু আমি বৃহত্তর চট্টগ্রাম (নাগরিক) কমিটির কনভেনর ছিলাম, মানে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের হিল টেক্স মিলে, আমি দেখেছি সমাজতন্ত্রের কথা বলছে বাসদের বা জাসদের ছেলে কিন্তু চিকা মারবে— আমার কাছে সেই রঙ কেনার পায়সা চাচ্ছে। কিংবা পোস্টার লাগবে সেই জন্য আঠার পয়সা চাচ্ছে। আমি তো একদিন ক্ষুব্ধ হয়ে গেলাম। বললাম, দেখ তুমি তো ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট খাচ্ছ, সিগারেট না খেয়ে তুমি তা দিতে।

আমার মনে পড়লো, আমি যখন কর্মী ছিলাম। আমি বাড়ির আটা চুরি করে নিয়ে গেছি। ছাত্র ফেডারেশনের পতাকা ছিল সাদা কাপড়ে লাল কালিতে লেখা শান্তি—প্রগতি—শিক্ষা। আমি বাড়ির বিছানা চাদর নিয়ে গেছি। মা বলেছেন, তোর চাদর কোথায়? আমি বলেছি, ধোপা বোধহয় হারিয়ে ফেলেছে। এই যে ডেডিকেশন, তখন পোস্টার লিখতাম সারা রাত জেগে খবরে কাগজে; এখন তো সাদা কাগজ। ব্রাশও ছিল না। কাঠির মাথায় তুলা পেঁচিয়ে আর জেবি বলে একটা ব্র্যান্ড তাদের নীল-কালো-সবুজ-লাল বড়ি পানিতে চুবিয়ে রাখতে হতো, বড়িটা পানিতে গুলে যেত, তারপর ওইটা দিয়ে পোস্টার লিখেছি। সাথে আমার এক সহকর্মী, মেয়ে। তখন আমার বয়স ধরো ১৭-১৮, সেই মেয়ের বয়স ধরো ১৪-১৫। শীতকাল। সারারাত একই চাদরের নিচে শুয়ে আছি। কিন্তু কোনো রকম হাঁক বা জৈবিক আকাঙ্ক্ষা ছিল না। কারণ বিপ্লবের জন্য উৎসর্গ করা জীবন। এটা কিন্তু এখানে দেখি না। এই যে সম্পূর্ণভাবে ব্রেইন ওয়াশ করে ফেলা— বিপ্লবই জীবনের মূলমন্ত্র, বিপ্লবের জন্য জীবন দিয়ে দেব।

আমার মনে আছে ১৯৮০ সালে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় আমার ওপর কভার স্টোরি করেছিল। ওই কভার স্টোরি করেছিল মুনতাসির মামুন। সেখানে আমি একটা কথা বলেছিলাম যে, বিপ্লব হবেই। আমি তো এখনো বিশ্বাস করি বিপ্লব হবে। আমি এখনো হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর। কারণ এই যে বৈষম্য এর অবসান হতেই হবে— আজকে না হোক কাল। আমি বলেছি, বিপ্লব হবেই আর ভুখা-নাঙ্গা লোকরা এসে আমাকে হত্যা করবে। কারণ তাদের চোখে আমি বুর্জোয়া। ঘর ভরা কার্পেট, রেফ্রিজারেটর, টিভি। বলেছি, আমি এই গ্লোরিয়াস মৃত্যু চাই। মৃত্যু তো আমার আছেই, রোড এক্সিডেন্টে মরতে পারি, অসুখ-বিসুখে মরতে পারি, কিন্তু বিপ্লবীদের হাতে যদি মৃত্যু হয়, এর চেয়ে মহান মৃত্যু আর কিছু নাই।

বাংলাদেশ মানে ঢাকা শহরে হাই রাইজ বিল্ডিং আর কাঁচের দেয়াল ঘেরা ভবন, তা না। বাংলাদেশকে যদি দেখতে হয় তোমাকে হসপিটালে শিশু বিভাগে যেতে হবে। সেখানে অপুষ্টিতে শিশুর বিরাট মাথা, চোখ কোটরাগত, পা-হাত শীর্ণ। এটা হলো বাংলাদেশ। এবং আমি যখন চিটাগং ছিলাম, হসপিটালে ছিলাম, সেই সময় এগুলো দেখেছি। আমি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরতাম, শিশু বিভাগে যেতাম দেখতাম। 

আমি মর্গে গেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে বাংলাদেশ হলো বেওয়ারিশ লাশের মতো। আমার আগে ধারণা ছিল লাশকাটা ঘরে যে কাটাকুটি করে তা ইচ্ছেমতো। কিন্তু দেখি যে না, খুব সুপরিকল্পিতভাবে হার্ট বের করা হয়, লিভার বের করা হয়, ফুসফুস বের করা হয়। তো, আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশকে রাজনীতিবিদরা খুব সুপরিকল্পিতভাবে এগুলো বের করে নিয়ে গেছে এবং বাংলাদেশ পড়ে আছে একটা বুক খোলা লাশের মতো। আমার একটা কবিতাও আছে যে— এটি হলো বাংলাদেশ।

আরেকটা কথা তোমাকে বলি, ’৫২-র ভাষা আন্দোলনে জড়িত ছিলাম। কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ, তাদের কিন্তু প্রস্তাব ছিল ১৪৪ ধারা না ভাঙার। (সেখানে ভাষা মতিন ও কয়েকজনের সিদ্ধান্ত ছিল যে, পরের দিনের উপস্থিতির ওপর নির্ভর করবে আমরা ভাঙবো কি ভাঙবো না। এটা ছিল ভাঙার টেকনিক— অলাত এহ্‌সান) কিন্তু ১৪৪ ধারা ভেঙে ফেলেছে। নেতারা তো না করেছিল। নদীর যেমন গতিপথ বলে দেয়া যায় না, নদী নিজের মতো যায়। আমি একটা জিনিস মার্ক করেছি— বাংলাদেশের যে আন্দোলন তা নেতা ছাড়াই হয়েছে। কোনো নেতা নাই। স্বতোঃস্ফূর্তভাবে, আন্দোলনের ভেতর দিয়ে নেতা হয়েছে। তুমি ’৫২-র আন্দোলন দেখ, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান দেখ। হ্যাঁ, ’৬৯-এ আসাদের একটা ভূমিকা আছে। আমাদের ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধ দেখ। নেতারা তো কেউ নাই, বঙ্গবন্ধু জেলে, নেতারা ভারতে চলে গেছে। তাহলে যুদ্ধটা করল কে? নেতা ছাড়াই তো!

তুমি দেখ, বাংলাদেশের মানুষ খুব শান্ত টাইপের এবং খুব সংগ্রামী। ঝড়-সাইক্লোন-বৃষ্টি-খড়া এগুলো মাথায় নিয়েই তো বেঁচে আছে। কিন্তু যখন ফুঁসে ওঠে তখন কেউ রোধ করতে পারে না। এই যে বাংলাদেশের আন্দোলনগুলো দেখ, ওই ‘বাংলা মোটর’ পর্যন্ত এসে থেমে যায়। এই যে এরশাদের পতন হলো, কেউ কি চিন্তা করেছিল ’৯০ সালে এইরকম ভাবে হবে!

অলাত এহ্‌সান: আমরা পরবর্তী প্রজন্ম। বই পড়ে, বড়দের মুখে শুনে যা জেনেছি তাতে মনে হয়েছে হয়-হচ্ছে-হবে এমন একটা অবস্থায় ছিল। ওই মুহূর্তেই ঘটে যাবে, এত দ্রুতই, কেউ ভাবেনি।

মুর্তজা বশীর: তুমি দেখ না, একাত্তরে, বঙ্গবন্ধু এরেস্ট। নেতারা কেউ নাই। বর্ডার পেরিয়ে কলকাতায় চলে গেছে। তাহলে আন্দোলন করলো কারা?

অলাত এহ্‌সান: পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকাতেও কিন্তু প্রতিরোধের খবর আমরা জানি। পরে গ্রামেও প্রতিরোধ হয়েছে।

মুর্তজা বশীর : করলো কারা? তখন ছাত্ররাও কিন্তু করেনি। করেছে এদেশের সাধারণ মানুষ, কৃষক। কারণ তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমি পালিয়ে ছিলাম জুলাই মাসে। আড়াইহাজার থানার গোপালদী বলে একটা জায়গায়। আমিনুল ইসলাম, আমার আর্টিস্ট বন্ধু, তার গ্রামের বাড়ি। কারণ আমার তো গ্রাম নাই। আমার জন্ম চব্বিশ পরগনা। তখন এক ইয়াং ছেলে, মুক্তিযোদ্ধা, ১৮-১৯ বছর বয়স। তাকে বলেছি যে, তুমি ছাত্রলীগ করো না ছাত্র ইউনিয়ন? তখন তো পার্টিই দু’টো। বলে যে, আমার মা’কে মেরে ফেলেছে, আমি প্রতিশোধ চাই; যে আমাদের ঘর জ্বালিয়েছে আমি প্রতিশোধ নেব। সে ছাত্র ইউনিয়ন করে না, ছাত্রলীগও করে না। এই যে আমি চিটাগং ভার্সিটিতে ত্রিশ বছর মাস্টারি করলাম, সেখানে টুয়েন্টি পার্সেন্ট পলিটিক্যাল স্টুডেন্ট, বাকি এইট্টি পার্সেন্ট জেনারেল, তারা কোনো পার্টির সঙ্গে যুক্ত না। কিন্তু মিছিলে যায়, ভয়ে যায়। কর্মী কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজন, ১০০ জন, কিন্তু ছাত্র তো চার হাজার। 

অলাত এহ্‌সান: হ্যাঁ। আমি ঢাকা কলেজে যখন আন্দোলনগুলো করেছি— যেমন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশন জটবিরোধী আন্দোলন, বিবিএ আন্দোলন, হল আন্দোলন, রকিবুল হত্যা আন্দোলন, তখন দেখেছি সেখানে আমরা নেতা-কর্মী হাতে গোনা। কিন্তু আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে হাজার হাজার শিক্ষার্থী যুক্ত হয়েছে।  

মুর্তজা বশীর: তারা কি কেউ ছাত্র ইউনিয়ন করেছে?

অলাত এহ্‌সান: না। এমনও হয়েছে যে তাদের কাছে আমরা আন্দোলনের মেসেজও নিয়ে যেতে পারিনি। পোস্টারিং হয়েছে বা শুনেছে। তারা চলে এসেছে যে, এই ইস্যুতে আমাকে কথা বলতেই হবে। আচ্ছা, আপনি সংগঠনে যুক্ত আছেন। আপনি তো পরে গল্প লিখেছেন। আপনার সময়ের গল্পকার সোমেন চন্দ’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল কখনো? 

মুর্তজা বশীর : না। দেখা হয়নি। তাঁর ডেড বডি আমি দেখেছি। আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল তাঁর ডেড বডি। 

অলাত এহ্‌সান: আপনি বইয়ে উঠানে যে লাশের স্মৃতি উল্লেখ করেছেন সেটা কি সোমেন চন্দের লাশ ছিল?  

মুর্তজা বশীর : সোমেন চন্দ কিনা, ওটা রেড ফ্ল্যাগ দিয়ে ঢাকা ছিল। 

অলাত এহ্‌সান: হ্যাঁ, আপনি বলছেন যে, রেড ফ্ল্যাগ দিয়ে ঢাকা একটা লাশ আপনাদের উঠানে রাখা ছিল। সবাই তার ওপর ফুল দিয়ে যাচ্ছে। পতাকার এক কোণায় সোনালী রঙে কাস্তে হাতুড়ি আঁকা। আপনার মনে হচ্ছে এই পতাকাটা আমার হতে পারে।

মুর্তজা বশীর : এটা আমি সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত হয়েছি ভারত সরকারের অনুরাগে পশ্চিমবঙ্গে মন্দিরের ওপর কাজ করার জন্য ঘুরে। তখন তো সিপিএম সরকার। সেই বাঁধের ওপর দিয়ে, ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে, কখনো হাঁটু পানি ভেঙে যখন কোনো একটা গ্রামে গিয়েছি, দেখছি রেড ফ্ল্যাগ উড়ছে কাস্তে-হাতুড়ি দেয়া। তখন মনটা একেবারে ভরে গেছে। কারণ এটিই তো স্বপ্ন দেখেছিলাম। 
একটা জিনিস বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, তারপর শৈলেন দাশগুপ্ত আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমি ১৯৮৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের ৮টা ডিস্ট্রিক্টের ১২৫টা গ্রামে গিয়েছিলাম। আমাকে সিপিএম সরকার সাহায্য করেছে, গাড়ি-টাড়ি থাকা-টাকা। আর ’৯৬ সালে গিয়েছি ১৫০টা গ্রামে। আমার উপলব্ধি থেকে একটা জিনিস তাদের বলেছি, আপনারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন।

অলাত এহ্‌সান: আপনি বুঝতে পারলেন কী করে?

মুর্তজা বশীর: কী করে আমি বুঝলাম? একটা হলো ডেমোক্রেটিক ইউথ ফ্রন্টের মধ্যে ফ্রাস্টেশন, এমএ পাশ করে চাকরি পাচ্ছে না। এটা একটা বিরাট ফ্রাস্টেশন। আর দেখলাম সুবিধাবাদী কিছু লোক পার্টির মধ্যে ঢুকে গেছে। আর পার্টি নেতাদের মধ্যে একটা অহম— আছি তো, থাকাবো তো, বিশ বছর তো আছিই। কখনো তারা এর থেকে চ্যূত হবে এটা ভাবতে পারে নাই। আমি সেটা বলেছি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বলেছি, শৈলেন দাশগুপ্তকেও বলেছি যে, আপনারা পার্টি ক্লাস করেন। এখনো পার্টি ক্লাস করেন, নইলে কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন।

এটা আমার নিজের দেখা। মেদেনীপুরে এক জায়গায় গেছি, জেলা পরিষদ গাড়ি দিয়েছে। হোটেলে দুটো রুম খুঁজছি থাকার জন্য। একটা রুম আছে, আরেকটা রুম নাই। তখন সিপিএম-এর কি সম্মেলন হবে বলে সমস্ত হোটেল বুক্‌ড। যাক আমি তো একটা রুম পেলাম। আমার ড্রাইভার বলছে যে, ‘স্যার আমি একটা কাজ করি, আমি গাড়িতেই শুয়ে থাকি।’ শীতকাল। আমি বললাম— না, তুমি আসো, আমার বিছানায় শোও। ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ‘স্যার আপনার বিছানায়! আপনি কোথাকার কমিউনিস্ট স্যার?’ আমি বললাম— না না, তুমি শোও আমার কাছে। আমি স্ত্রীর সঙ্গে এক বিছানায় শুতাম না। আলাদা দুই বিছানা। সে অবাক হয়ে গেল। আমার বিবেচনাটা হলো, সে তো আমার কর্মী। সে আমাকে নিয়ে ঘুরছে। এটা তো আমাদের। পার্টি কিন্তু সেটা বুঝলো না। 
আবার এও দেখেছি— প্যান্ট পরা, গেঞ্জি গোজা, জুতা পায়ে। বাকুড়ায় ইদ্রাস বলে একটা গ্রামে। মশারি টাঙ্গিয়ে পার্টি কমরেড। আমি বললাম— কমরেড, আপনি? সে বললো— না না, পিপলসের সঙ্গে থাকতে হবে। বীরভূম জেলার পার্টির সেক্রেটারি। তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছি— আপনার পরিবার নাই? স্ত্রী পুত্র সন্তান? বলে— আছে। তাহলে আপনি পার্টি অফিসে শুয়ে আছেন? বলে— পিপলসের সঙ্গে থাকতে হবে। 
আর আমার এখানে বাম যারা তাদের বাড়িতে গেলে প্রথম তো তোমার নানা রকম কৈফিয়ত দিতে হবে দারোয়ানের কাছে। তারপর তুমি বসবে, তারপর অনেকক্ষণ বসার পর তিনি স্নান করে, দাড়ি কামিয়ে, আফটার শেভ লোশন লাগিয়ে, বডিতে উডি লোশন লাগিয়ে আসবেন। কী করে বিপ্লব হবে?

অলাত এহ্‌সান: সেই ডেডিকেশনটা...

মুর্তজা বশীর : বলো সেই ডেডিকেশন কোথায় আমাদের বামদের মধ্যে? আমাদের সময় কিন্তু  মুটোমুটি ...

অলাত এহ্‌সান: আপনার সময় তো অনেকের নাম করা হয়। অনিল মুখার্জি, জ্ঞান চক্রবর্তী, হাতেম আলী...

মুর্তজা বশীর: হ্যাঁ। আমাকে অনিল মুখার্জি খুব স্নেহ করতেন। তিনি যখন পার্টির সেক্রেটারিতে ছিলেন তখন আমাকে সদস্য পদ দেয়া হয়। ১৮ বছর বয়সে পার্টির সদস্য পদ পাই। বিশ বছর না হলে দিত না। যেটা আমাকে আঠারো বছর বয়সে দিয়েছে। কিন্তু পরে পার্টি আমাকে সাসপেন্ডও করে। ফজলে লোহানীর সঙ্গে আমার খুব ‘ই’ (আন্তরিকতা) ছিল। আব্দুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দিন জেল থেকে বের হওয়ার পর এক্সপেল করে দেয়। (বিজ্ঞানী ও লেখক আব্দুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দিন?— অলাত এহ্‌সান)। হ্যাঁ। মিটিংয়ে ডিসিশন হলো পার্টি আব্দুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দিনকে এক্সপেল করবে আর সেই লেটার আমাকে বহন করতে হবে। আমি বললাম, আমাকে কেন? আমরা একসঙ্গে অনেক দিন জেলে ছিলাম। আমি তো বিচারের দিন বন্দি ছিলাম। আমি চা-রুটি পেতাম না। আমাকে দেয়া হতো লাপসি। ওই কেমন খিচুরি-জাওয়ের মতো। তো তিনি আমাকে এক টুকরো রুটি দিতেন— খাও। আলী আশরাফ ক্ষেপে যেতেন— মুতি ভাই, আপনার ভেতরে পেটি বুর্জোয়া ভাব আছে। আপনি বশীরকে দেন কেন?

মুতি ভাই বলতেন— হি ইউজ টু। ও ছোটবেলাতেই ইউজ টু। যাই হোক, সেই মুতি ভাইকে যখন পার্টি এক্সপেল করলো সেই লেটার আমাকে ক্যারি করতে হলো। আমি বললাম যে, আমাকে কেন? আপনি অন্য যে কোনো কমরেডকে দেন। বলে যে— না, আপনাকেই ক্যারি করতে হবে। তিনি রোকনপুরে থাকতেন। আমি নিয়ে গেলাম। তাঁকে দিলাম। চিঠিটা পড়লেন। মুখ একদম সাদা হয়ে গেল। আমি খালি ইংরেজিতে বললাম, মুতি ভাই আই এম সরি, বাট আই কুডনট হেল্প ইট। তখন আমি এটা ফিল করলাম যে, আমি তো যন্ত্র না, আমি মানুষ।

আমার মনে আছে, আমি যখন জেলে ছিলাম তখন কৃষক নেতা আব্দুল বারি, ক্ষেতমজুর নেতা মনু মিয়া। এই মনু মিয়ার জীবন শুনে আমি অবাক হয়ে গেছি যে, পার্টি তাকে বলছে তোমার বৌকে ডিভোর্স দাও। তার বৌ পা ধরে কাঁদছে— আমাদের ছেড়ে দিয়েন না, আপনি যেভাবে রাখেন আমি সেভাবে থাকব। কিন্তু সে পার্টির নির্দেশে বৌকে ছেড়ে দিলো। এবং সবচেয়ে কষ্ট লেগেছে যে, সে মেডিকেল কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিল, তার নাম আমি ভুলে গেছি। সে জেলে ছিল। জেল থেকে বেরুনোর পর দেখি সে রিকশা চালাচ্ছে! পার্টি তার কোনো খোঁজখবর নেয়নি! এগুলো তো ঠিক না। মানুষ তো। আমার ভেতরে একটা মানবিক দিক আছে না। আমি তো হিউম্যান বিঙ। আমি তো যন্ত্র না, রোবট না। তখনই আমি পার্টি থেকে আস্তে আস্তে দূরে যেতে শুরু করলাম। 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়