ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ভিয়েতনামের এক কাঁচাবাজারে  

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৮, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৬:২৩, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১
ভিয়েতনামের এক কাঁচাবাজারে  

বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: ১৩তম পর্ব

ম্যারেলিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে শরীরের ভেজা কাপড় আপন খেয়ালে শুকিয়ে গেছে। এমনিতেই বাজে আবহাওয়া, তার উপর দিয়ে শরীর খারাপ করলে মহা মুসিবতে পড়তে হবে। ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সংক্ষিপ্ত একটা শবাসন করে নিলাম। ফুরফুরে উদ্দীপনা নিয়ে বের হলাম বাসের খোঁজ করতে।

সা পা থেকে হা লং বে যাওয়ার সরাসরি বাস আছে পরের দিন সন্ধ্যায়। একাধিক ট্রাভেল এজেন্সির কার্যালয় ঘুরে দেখলাম ভাড়া সাড়ে তিন থেকে চার লাখ ডং-এর মধ্যে। বাসের খোঁজ করতে করতে শহরের কোন প্রান্তে পৌঁছে গেছি জানি না। দূর থেকে আলোর ঝলক দেখে সেদিকেই চলে গেলাম। স্থানীয় খাবার আর হস্তশিল্পজাত হরেক পণ্যের বাজার। প্রতিটা জিনিসের দাম হাতের নাগালের মধ্যে কিন্তু বিদেশি পর্যটক দেখলেই এক লাফে তা অনেক উপরে চড়ে যায়। চড়ে গেলেও দর কষাকষি করে কেনার সুবিধা আছে। খাবারের মধ্যে মাংস এবং শাকসবজির চাহিদা সমানে সমান। করোলা, বেগুন, গাজরের মতো সবজির গোল গোল মোটা চাকা কাঠিতে ফুড়ে কাঠ কয়লায় ঝলসে খাওয়া তাদের ভিষণ প্রিয়। ঢেরসের মতো অতি সাধারণ সবজির কদরও কম নয়। একই প্রক্রিয়ায় ঝলসানো আস্ত ঢেরস খাওয়া আভিজাত্যের ব্যাপার কিনা বুঝলাম না। নাস্তা জাতীয় খাবার বলতে ঝলসানো প্রক্রিয়ারই প্রাধান্য। মাছের পদ সহজলভ্য মনে হলো না। মাংস আর শাক পাতার মেলবন্ধন খুবই আকর্ষণীয়। অর্ডার করার সঙ্গে সঙ্গে কিছু পরিমাণ শাকপাতা মুঠি করে মাংসের পাতলা ফিতা দিয়ে পেঁচিয়ে ঝলসে পরিবেশন করা হয়।

বাজার ঘুরতে ঘুরতে রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেল। হোস্টেলে ফিরে দেখি ফান্সিপানে মিলিত হওয়া বন্ধুদের পার্টি জমে উঠেছে। মেঘের ভেলায় গা ভাসিয়ে গানে গানে জমে উঠল আসর। একেক দেশের একেক মানুষের নানান পরিবেশনায় চমৎকার আয়োজন। সা পা’র এই পাহাড়ের কোলে এমন সুন্দর একটা অনুষ্ঠান যে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল তা কে জানতো? প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ভ্রমণ পরিকল্পনার অনেকটাই অবাস্তবায়িত রয়ে গেল। যা কিছু হলো তাও ভিন্ন প্রক্রিয়ায়। তবুও দিন শেষে মনে হল আমি ব্যর্থ নই।

স্বার্থকতাজনিত আনন্দের আতিশয্যে প্রতিদিনের মতো আজও ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। হোস্টেলে খাবার টেবিলে খেতে বসা মানে প্রতিদিন কারো না কারো সঙ্গে পরিচিত হওয়া। আজ আমার সকালে নাস্তার টেবিলের অতিথি এক সুইডিশ অভিযাত্রী। একই ডর্মেটরির বাসিন্দা হলেও এটাই তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ। কে কখন ফিরেছি আর কখন বেরিয়ে পড়েছি তার ঠিক নেই, ফলে দেখাটা পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। তার ভ্রমণের ধরন আমার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পাহাড়-পর্বতের বাঁকে বাঁকে মোটর সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো তার শখ। কয়েক দিন হলো আশপাশটা ঘুরে শেষ করেছে। পরের দিন বের হবে দূরের কোনো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। কেমন হবে সেই পথ, সেখান থেকে কিছুটা বর্ণনা করতে চাইলে সম্মতি না দিয়ে পারলাম না। 

উঠে এলো পথের রূপ, রস, গন্ধ আর রহস্যের খুঁটিনাটি। তার সুন্দর এবং সাবলীল বর্ণনা শুনে মনে হলো জায়গাগুলো থেকে সে এইমাত্র ঘুরে এসেছে। গল্পে গল্পে কথার ডালপালা ছড়াতে শুরু করল। তাতে আমার আপত্তি নেই কারণ আজ বিদায়ের দিন, তাড়াহুড়োও নেই। ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা থেকে একেবারেই বাদ দেয়া যায় না এমন দুই একটা ঘটনার বর্ণনায় তার চোখে মুখে ভেসে উঠল প্রশান্তির ছাপ, যেন এমন করে এর আগে আর কেউ তার কথা শোনেনি। 

বাসের টিকিট নিশ্চিত করতে হবে। তারপর চারপাশটা শুধু ঘুরবো আর দেখবো। স্টোন চার্চ এলাকায় প্রবেশের আগেই ফলের দোকানটার মূল আকর্ষণ কাচা-পাকা রঙিন ফল। মোটর সাইকেলের পেছনে সংযুক্ত ডালির মধ্যে চেনা এবং অচেনা হরেক ফলের সমাহার। বেদানার সমান একেকটা বড় কমলালেবু, দুই কেজির দাম মাত্র বিশ হাজার ডং। সা পা অবতরণের পর থেকে বৃষ্টি আমার সঙ্গের সাথী! বেগতিক অবস্থা দেখে কমলার রস পান বাদ দিয়েই মাথার উপর ছাতা মেলে ছুটতে হলো। ট্রাভেল এজেন্সির কার্যালয়ে আমার জন্য টিকিট যেন আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখা ছিল। কম্পিউটারের কীবোর্ডে এক মুহূর্তের খটাখট শব্দের পর বেরিয়ে এল একটা কাগজের টুকরো। তার আগে ও পরে কথার ফুলঝুরি। ভিয়েতনামে এই প্রথম কারও ব্যবহারে অতি সৌজন্য লক্ষ্য করলাম, যেন আমার মতো সোনার টুকরো যাত্রী আর হতেই পারে না। বাস ছাড়বে সন্ধ্যা ছয়টায়। আধা ঘণ্টা আগেই উপস্থিত হওয়ার কথা বলা হলো। 

এজেন্সি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সামান্য পেছনের দিকটায় কেন্দ্রীয় বাজার। দুটি অংশে বিভক্ত বাজারের একটাতে কাঁচাবাজার অপরটায় পোশাক ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং খাদ্যদ্রব্যের দোকান। এক পা দুই পা করে কাঁচাবাজারে প্রবেশ করলাম। বাজার জমে উঠেছে। ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে একেবারে সরগরম। শতভাগ দোকানের বিক্রেতা নারী। মাংসের দোকানও তার বাইরে নয়। এদেশে ব্যবসায় নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণের বিষয়টা আমার কাছে খুব ইতিবাচক একটা দিক বলে মনে হলো। অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রে কি হতে পারে বলা মুশকিল! তবে যে কোনো ধরনের দোকানদারীতে আশি থেকে নব্বই ভাগ নারীদের অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে একটা লক্ষণীয় বিষয়। হরেক পণ্যের মধ্যে চার কোণা দন্ড আকৃতির সাদা ধবধবে জিনিসটা আমার নজর কাড়ল। এত জিনিসের মধ্যে ওই জিনিসটিই কেন আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো সে উত্তর আমার জানা নেই। 

চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা জিনিসগুলো দেখেই আন্দাজ করা যায় নরম হয়ে থাকবে। এমনকি তুলতুলেও হয়ে থাকতে পারে। তবে তা পনির নাকি অন্য কিছু তা জানতে ভালোই বেগ পেতে হলো। ঝরঝরে সিদ্ধ নুডুলসও বিক্রি হয়। প্রয়োজন মতো নিয়ে বাসায় ফিরছে, মশলাপাতি মিশিয়ে খেয়ে নেবে। ফলমূলের কথা তো বলাবাহুল্য। অধিকাংশ ফল কয়েক ঘণ্টা আগেই গাছ থেকে ছিড়ে আনা। বাজারে ফুলের কদরও কম নয়। শাকপাতার দোকানে হরেক রকম সবুজ শাকের সমাহার। দৈনন্দিন খাবারে কাচা শাকপাতা তাদের অত্যান্ত জনপ্রিয় একটা অনুষঙ্গ। বাজারের অপর অংশ দালানটার ভেতর প্রবেশ করে মনে হলো, কোনো দৈত্যাকৃতির কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করলাম! উঁচু ছাউনির নিচে তিনতলা একটা দালান। মাঝখানে খয়েরি টাইলস বিছানো দীর্ঘ চলার পথ এবং তার দুই পাশে সারি সারি দোকান। তৃতীয় তলায় কোন দোকান বা অন্য কিছু নেই। সূর্যের আলো প্রবেশ ও বাতাস যাতায়াতের সুবিধার্থে পুরোটা শুধু জানালার মতো করে তৈরি করা। ফলে বাজারের ভেতরে সম্পূর্ণরূপে বৈদ্যুতিক আলোর উপর নির্ভর করতে হয় না। হস্তশিল্পজাত পণ্যের পাশাপাশি প্যাকেটজাত ভেষজ জিনিসপত্র ও শুকনো ফল এখানকার প্রধান পণ্য। দোকানের তাকে সাজানো শত প্রকারের ভেষজ পণ্য। ভিয়েতনামে চায়ের প্রচলন চোখে পড়ল না। কফির পাশাপাশি তারা এই সমস্ত ভেষজ পানীয়েই অভ্যস্ত।

দুপুরের খাবার খেয়ে হ্রদের পাশ দিয়ে হেঁটে চলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করলাম। হ্রদের পাড় ধরে উদ্যানের মতো করে গড়ে তোলা। চলতে চলতে যে জায়গাটাকে সব থেকে সুন্দর মনে হলো সেখানে অনেকটা সময় ধরে বসে থাকলাম। অপর পাড়ে পাহাড়ের গায়ে মেঘের অলস বিচরণ, একটু নড়াচড়াতেই ঢেকে যাচ্ছে তিন-চারতরা দালানগুলো উপরিভাগ। বসে থাকতে থাকতে ইচ্ছা হলো ও পাড়ে গিয়ে দালানগুলোর ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে হেঁটে বেড়ালে মন্দ হয় না। ইচ্ছার টানে গিয়ে হাজির হলাম। বিভিন্ন অলিগলি আর উঁচুনিচু সিঁড়িপথ মাড়িয়ে ঢুকে গেলাম গাছের ডালপালায় আবৃত ভীষণ নিরিবিলি এক সরু পথে। সরু পথের পর ঘুরেফিরে আবারও পতিত হলাম স্টোন চার্চ এলাকায়। দেখা হলো মুখ চেনা হয়ে ওঠা ব্ল্যাক মং বৃদ্ধার সাথে।

মুখজুড়ে বার্ধক্যের কোচকানো ভাঁজের কারণে বহু মানুষের মাঝে তাকে আলাদা করে চেনা যায়। পিঠের ঝুরিতে নিজ হাতে বোনা বাচ্চাদের পোশাক। তিন দিনে এ নিয়ে তার সাথে কয়েকবার দেখা, কত করে কিছু একটা কিনতে বললো! নেহায়েতই ওসব আমার প্রয়োজন না থাকায় কিনতে পারলাম না। তাতে বৃদ্ধার ক্ষেদের অন্ত নেই। ক্ষোভে গজরগজর করতে করতে পাশ ফিরেই আর একজনের পিছু নিলো। ওদিকে পথিকের তো কোনো বিকার নেই। সে তার মতো কী কী সব বলতে বলতে ছুটতেই থাকল। 

উন্মুক্ত মঞ্চের পেছন থেকে এগিয়ে যাওয়া রেস্টুরেন্টপাড়ার পথটা ধরে নেমে গেলাম অনেকটা নিচের দিকে। এ পথেরই কোনো একটা অংশ থেকে হাতের বামে সামান্য মোড় নিয়ে পেয়ে গেলাম সিঁড়িপথ। শুধু উপরের দিকেই উঠে গেছে। যেতে যেতে দুই ধারে অসংখ্য দোকান। ডানে-বামে দোকানে পূর্ণ দু’একটা গলিও বেরিয়ে গেছে। নতুন এক জগতে ঢুকে পড়লাম। বিভিন্ন বস্ত্রাদী এবং হস্তশিল্পের রাজ্য বলা যায়। খাবার জিনিসপত্রের দোকনও কম নয়। সেক্ষেত্রে বরাবরের মতই প্যাকেটজাত ভেষজ জিনিসের প্রাধান্য সর্বাগ্রে। প্রতিটি দোকানে এই ভেষজ পণ্যের দীর্ঘ প্রদর্শনী দেখে চোখ কপালে চড়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রক্রিয়াজাত করা রং-বেরঙের শুকনো ফলের বহরও কম নয়। দামেও বেশ পর্তায়। 

অ্যাপ্রিকট, প্লাম আর পীস মিলে প্রায় কেজি পাঁচেক নিয়ে নিলাম। আদরের কঁচিকাচাদের হাতে উপহারস্বরূপ তুলে দেয়ার জন্য এর চেয়ে উত্তম জিনিস আর হতেই পারে না। শুকনো খটখটে কালো বস্তু সেই কখন থেকে আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে বসে আছে। দশ-বারো ইঞ্চি একেকটা চটির মতো দেখতে। বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলাম জিনিসটা আসলে কী? তিনি কি বুঝে নিলেন জানি না। একটা সুন্দর হাসি দিয়ে পাশে রাখা ধারালো ছুরি দিয়ে সামান্য কেটে আমার হাতে তুলে দিলেন। ঝাল আর লবণের  স্বাদে দারুণ জিনিস। খেতে মাংসের মতো। খাওয়ার পর আমার অভিব্যক্তি প্রত্যক্ষ করে বললেন, মহিষের মাংসের শুঁটকি। কুড়িয়ে কুড়িয়ে এই বিচিত্র অভিজ্ঞতাগুলো অর্জনের মধ্য দিয়ে বিকেল গড়িয়ে বাস ছেড়ে দেয়ার সময় সন্নিকটে এসে দাঁড়াল। (চলবে)  

পড়ুন ১২তম পর্ব: ভিয়েতনামের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের চূড়ায় 

 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়