ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

শেখ হাসিনার স্বদেশযাত্রা: কী ট্র্যাজিক কী মহাকাব্যিক: ৩য় পর্ব

মিনার মনসুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১০, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৯:৩৬, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
শেখ হাসিনার স্বদেশযাত্রা: কী ট্র্যাজিক কী মহাকাব্যিক: ৩য় পর্ব

(পূর্ব প্রকাশের পর)

পাশাপাশি দেখেছেন মা ফজিলাতুন নেছা মুজিবকেও। মাত্র তিন বছর বয়সে- পিতৃস্নেহ কী তা বোঝার আগেই পিতৃহীন হয়েছিলেন এ মহীয়সী নারী। কঁচি দুই হাতে জন্মদাত্রী মাকে যে আঁকড়ে ধরবেন সেই সুযোগটুকুও মেলেনি তাঁর। সেই মমতাময়ী মাও যখন তাঁকে রেখে পরপারে পাড়ি দেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ৫। একমাত্র আশ্রয় ছিলেন যে দাদা অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনিও বিদায় নেন। একেবারেই শিশু বয়সে পিতৃমাতৃহীন এ অনাথ শিশুটিকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন তাঁর দাদি সায়েরা খাতুন। তিনিই ছিলেন রেণু নামের এ মেয়েটির যুগপৎ মা ও বাবা। মায়ের বেদনাবিধুর সেই শৈশবের মর্মস্পর্শী চিত্রটি ফুটে উঠেছে কন্যা শেখ হাসিনার বয়ানে:২৩

তাঁর ছোটবেলার কথাই যদি ধরি- সে এক দুঃখের কাহিনি। খুব ছোট বয়সে পিতা-মাতা ও দাদাকে হারিয়ে আশ্রয় পেয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ি। তিন বছর বয়সে বাবাকে এবং পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছেন। বাবা-মাকে হারাবার পর দাদার কোলে আশ্রয় পান। দাদা দুই নাতনিকে বিয়ে দিয়ে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি তাঁদের দান করে দেন। কিন্তু সাত বছর বয়সে দাদাও চলে যান না ফেরার দেশে। ছোট রেণুকে কোলে তুলে নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মা, তাঁর শাশুড়ি। 

একই কারণে সেই শিশুবয়সেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল রেণুর জীবন। এক সঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন দুজন। আমৃত্যু ছায়াসঙ্গী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর। কিন্তু চির দুঃখী এই নারী স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাত ধরে যে দুদণ্ড শান্তি ও স্বস্তি খুঁজে নেবেন- রচনা করবেন নিজের জন্য একান্ত একটি নীড়- সেই অবকাশটুকুও মেলেনি তাঁর জীবনে। বলতে গেলে সব ঝড়ঝঞ্ঝা তো তাঁকে একাই সইতে হয়েছে। বারবার। পরিবারের বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ছিলেন সব কিছুর প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি লিখেছেন:২৪

... আমাদের বিপত্তির শেষ নেই। একের পর এক মামলা দিচ্ছে আব্বার নামে। সব থেকে কষ্ট আমার মায়ের। একদিকে সংসার, ছেলেমেয়েদের সামলানো, অন্যদিকে আব্বার মামলা-মোকদ্দমার জন্য কোর্ট, আইনজীবীর চেম্বার- সব জায়গায় ছুটতে হতো তাঁকে। 

কোমলে-কঠোরে মেশানো সমীহ জাগানিয়া এক মানুষ ছিলেন এই ফজিলাতুন নেছা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ হয়নি, কিন্তু ছিলেন আগ্রাসী পাঠক। শুধু স্বশিক্ষিত বললে কমই বলা হয়; আজ বঙ্গবন্ধুর যে-তিনটি গ্রন্থ জাতির অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তার মূল প্রেরণাদাতাও ছিলেন তিনিই। ছিলেন অতি সাধারণ এক বাঙালি নারী; কিন্তু তাঁর দৃঢ়তা, তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, তাঁর সাহস এবং  সর্বোপরী স্বামীঅন্তপ্রাণ এই নারীর আত্মত্যাগের তুলনা বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন:২৫

 ...জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াসঙ্গী ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে তিনি পালন করেছেন বলিষ্ঠ ভূমিকা। নিজের জীবনের সব চাওয়া-পাওয়াকে তুচ্ছজ্ঞান করে, সকল লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে স্বামীর আদর্শকেই তিনি বুকে ধারণ করেছিলেন। নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন স্বামীর স্বপ্ন- স্বাধীন বাংলাদেশের অর্জনে। তাঁর আত্মত্যাগ সমগ্র বিশ্বের নারী জাতির জন্য এক বিরল প্রেরণা হতে পারে। 

ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যদি হিমালয় হন, বেগম মুজিব ছিলেন হিমালয়ের পাশে ছায়ার মতো সেঁটে থাকা আরেকটি অদৃশ্য হিমালয়। একাধারে ছিলেন ধরিত্রীর মতো সর্বসংহা, অন্যদিকে দেবী দুর্গার মতোই দশ হাতে সামলেছেন সব ঝড়ঝঞ্ঝা। প্রতি ১৫ দিন অন্তর সন্তানদের নিয়ে কারাফটকে হাজিরা দিয়েছেন। খোঁজ নিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য, সুখ-সুবিধা এবং রাজনীতিসহ যাবতীয় জরুরি কাজকর্মের। তাঁর নির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছেন নেতাকর্মীদের। আবার নেতাকর্মীদের খবরাখবর জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে। বিপুল বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ করি, এই যে বিয়ের পর থেকে একটি মানুষ সংসারের সব দায়দায়িত্ব তাঁর কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে দেশ ও জনগণের সেবা করে বেড়াচ্ছেন এ নিয়ে বিন্দুমাত্র খেদ ছিল না তাঁর। কখনোই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে বাধা হয়ে দাঁড়াননি স্বামীর দীর্ঘ যাত্রাপথে। বরং তাঁর সর্বস্ব নিয়ে সাধন সঙ্গী হয়েছেন বাঙালির জাতির পিতার। বাঙালি এমন মা আর কোথায় পাবে!

নিজের জন্য কখনোই কিছু চাননি। বরং যখনই অর্থের প্রয়োজন হয়েছে পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত জমিজমার সমস্ত আয় অসঙ্কোচে তুলে দিয়েছেন স্বামীর হাতে। নিরন্তর তাঁকে ভরসা জুগিয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিক উপদেষ্টার ভূমিকাও পালন করেছেন বাংলাদেশের রাজনীতির নানা ঐতিহাসিক সংকটময় মুহূর্তে। সর্বোপরী জীবনে শুধু নয়, মৃত্যুতেও সহযাত্রী হয়েছেন বঙ্গপিতার:২৬ 

বেগম মুজিবকে ঘাতকেরা বলল: আমাদের সাথে চলেন। তিনি বললেন: ‘তোমাদের সাথে কোথাও যাব না। তাঁকে (বঙ্গবন্ধুকে) মেরেছ, আমাকেও গুলি করো। আমি এক পা-ও নড়ব না। ঘাতকের হাতের বন্দুক গর্জে উঠলো। ৩২ নম্বরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো তাঁর দেহ। তাঁর শরীরের রক্ত গড়িয়ে গিয়ে মিশে যায় সিঁড়িতে পড়ে থাকা স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রক্তের সাথে। আর সে রক্তের স্রোতধারা গড়িয়ে গড়িয়ে মিশে যায় বাংলার মাটিতে। 


অনন্য এক রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে বহুমাত্রিক ও মহামূল্যবান এসব অভিজ্ঞতার আগুনে পুড়ে পুড়ে অন্যরকম এক মানুষে পরিণত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। নয়ত তাঁর মতো অতি সংবেদনশীল মনের একজন মানুষের পক্ষে নির্বাসনের দিনগুলোতে নিজেকে সুস্থির রাখা কোনোমতেই সম্ভব হতো না। শেখ হাসিনাকে বুঝতে হলে তাই অত্যাবশ্যকভাবে যে-পরিবারে যে-পরিবেশে তিনি বেড়ে উঠেছেন তা বুঝতে হবে। সংগত কারণেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি তাঁর শৈশবের সেই সহজ সরল মায়াময় পরিপার্শ্বটিও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। শেখ হাসিনার চোখেই দেখে আসা যাক মধুমতি-বাইগার পলিবিধৌত গ্রামবাংলার সেই ছবিটি:২৭

আমার শৈশবের স্বপ্ন-রঙিন দিনগুলো কেটেছে গ্রাম-বাংলার নরম পলিমাটিতে, বর্ষার কাদা-পানিতে, শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে, ঘাসফুল আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে, জোনাক-জ্বলা অন্ধকারে ঝিঁঝিঁর ডাক শুনে, তাল-তমালের ঝোপে বৈচি, দিঘির শাপলা আর শিউলি-বকুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে, ধুলোমাটি মেখে, বর্ষায় ভিজে খেলা করে। 

এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে যে এ হলো সেই পরশপাথর- যার ছোঁয়ায় টুঙ্গিপাড়ার দামাল ছেলে খোকা পরিণত হয়েছিলেন বিশ্বনেতায়। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে কেন? তিনি শুধু যে পিতার মতো স্বদেশ ও জনগণ অন্তঃপ্রাণ আপাদমস্তক বাঙালি ছিলেন তাই নয়, তাঁর হৃদয়ও ছিল অদ্ভুত কোমল। তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল তাঁর বিস্ময়কর সাহিত্য ও প্রকৃতিপ্রীতি। সর্বোপরী, অসাধারণ এক কবিমন তো ছিলই।২৮ 

জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ যেন আমার গ্রাম- ঘন সবুজ প্রকৃতি ও ফসলের প্রান্তর দেখে দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। নির্জন দুপুরে ভেসে আসে ঘুঘু আর ডাহুকের ডাক, মাছরাঙাটা টুপ করে ডুব দিয়ে নদী থেকে ঠিকই তুলে আনতে পারে মাছ। এর চেয়ে আর কোনো আকর্ষণ, মোহ, তৃপ্তি আর কোনো কিছুতেই নেই আমার। ধূলি-ধূসরিত গ্রামের জীবন আমার আজন্মের ভালোবাসা। আমার হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি। 

বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প আর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ‘কলাগাছের ঝোপে নোলকপরা বউয়ের ছবি’ ছিল তাঁর ‘ভীষণ প্রিয়’।২৯ স্কুলে পড়া শৈশবের সুঘ্রাণময় স্মৃতিজাগানিয়া সুরেলা কবিতাগুলো এখনো তাঁকে আলোড়িত করে:৩০ 

শৈশব ও কৈশোরের স্কুলপাঠ্য বইয়ের গ্রাম-সম্পর্কিত কবিতাগুলো আমার খুব সহজেই মুখস্থ হয়ে যেতো। ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর’, ‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়’, ‘বহুদিন পর মনে পড়ে আজ পল্লী মায়ের কোল’, ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ’, ‘মেঘনা পারের ছেলে আমি’, ছিপখান তিন দাঁড়, তিনজন মাল্লা’, ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে’- এসব কবিতার লাইন এখনও মনে আছে। 

আর এমন একজন মানুষকেই কিনা পাড়ি দিতে হয়েছে পিতা-মাতা-ভাই-ভাবীসহ বহু স্বজনের রক্তের সমুদ্র! এত বড় বিপর্যয়ের রক্তসমুদ্র পার হয়ে যখন দেশে ফিরলেন তার পরের অভিজ্ঞতাও কি কম ভয়াবহ?৩১  

১৯৮১ সালে আমি ফিরে এসে (ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের) বাড়িটি খুলে দিতে বলি, কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমান অনুমতি দেননি। এমনকি বাড়িতে প্রবেশ করার অনুমতিও পাইনি। মিলাদ পড়ানোর জন্য বাড়ির দরজা জিয়া খুলে দেয়নি। রাস্তার উপর বসেই আমরা মিলাদ পড়ি।  

বঙ্গবন্ধুর ঘাতক ও পৃষ্ঠপোষক শাসিত নিজ দেশে ফেরার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার যে স্বদেশযাত্রা শুরু হয়েছিল- তার প্রতি পদক্ষেপে ওত পেতে ছিল ষড়যন্ত্র, অপমান, লাঞ্ছনা, নিপীড়ন ও মৃত্যু। নিজ বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনাটি ছিল তার সামান্য সূচনামাত্র। বস্তত এটা ছিল হারানো পিতা ও স্বদেশের সন্ধানে পরবর্তী দিনগুলোতে যে অভাবনীয় কণ্টকাকীর্ণ পথ তাঁকে পাড়ি দিতে হবে সেই বিশাল ডুবোপাহাড়ের চূড়া মাত্র। আর পঁচাত্তরের রক্তসমুদ্রে নিমজ্জিত যে দেশটির সন্ধানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি স্বদেশে ফিরেছেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে পা দিয়েই তিনি দেখে ফেলেন লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সেই দেশটির রক্ত-হিম-করা অবয়ব:৩২ 

এই বাড়িটি  যখন ১২ জুন, ১৯৮১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তার সাহেবের নির্দেশে খুলে দেওয়া হল তখন বাড়িটির গাছপালা বেড়ে জঙ্গল হয়ে আছে। মাকড়সার জাল, ঝুল, ধুলোবালি, পোকামাকড়ে ভরা। ঘরগুলি অন্ধকারাচ্ছন্ন। গুলির আঘাতে লাইব্রেরি ঘরের দরজা ভাঙা, বইয়ের আলমারিতে গুলি, কাচ ভাঙা, বইগুলি বুলেটবিদ্ধ, কয়েকটা বইয়ের ভেতরে এখনও বুলেট রয়েছে। একটা বই, নাম ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’। বইটির উপরে কবি নজরুলের ছবি। বইটির ভেতরে একখানা আলগা ছবি, একজন মুক্তিযোদ্ধার- বুলেটের আঘাতে বইটি ক্ষতবিক্ষত। মুক্তিযোদ্ধার ছবিটির বুকের উপর গুলি। ঠিক ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে এ বাড়িতে যে আক্রমণ হয়, তা হল ১৯৭১ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ। এ বইটির দিকে তাকালে যেন সব পরিষ্কার হয়ে যায়। 

কী অদ্ভুত মিল একাত্তরের সঙ্গে পঁচাত্তরের! একাত্তরেও এ বাড়ি আক্রান্ত হয়েছিল। লুট হয়েছিল। তছনছ করে ফেলা হয়েছিল পুরো বাড়ি। প্রত্যক্ষদর্শী শেখ হাসিনা ২৫শে মার্চের পর প্রথম যেদিন সেনা প্রহরায় এ বাড়িটিতে পা রাখেন সেদিন তিনি দেখলেন, ‘সমস্ত বাড়িতে লুটপাটের চিহ্ন, সব আলমারি খোলা, জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো। বাথরুমের বেসিন ভাঙা, কাচের টুকরো ছড়ানো, বীভৎস দৃশ্য।’৩৩ আর তখনো বিশেষভাবে আক্রোশের শিকার হয়েছিল ‘বই’।৩৪

ছয় দফা দেবার পর অনেক সোনা-রুপার নৌকা, ৬ দফার প্রতীক প্রায় ২-৩ শত ভরি সোনা ছিল। এগুলি আমার ঘরের স্টিলের আলমিরায় রাখা ছিল। সব লুট করে নিয়ে যায়। যাক, ওসবের জন্য আফসোস নেই, আফসোস হলো বই। আব্বার কিছু বইপত্র, কিছু পুরোনো বই ছিল। বিশেষ করে জেলখানায় বই দিলে সেগুলি সেন্সর করে সিল মেরে দিত। ১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানার বই বেশিরভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন কিন্তু আমার মার অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনও দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলি, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নাডশ’র কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেওয়া ছিল। জেলে কিছু পাঠালে সেন্সর করা হয়, অনুসন্ধান করা হয়, তারপর পাস হয়ে গেলে সিল মারা হয়। পরপর আব্বা কতবার জেলে গেছেন তার সিল এই বইগুলিতে ছিল। মা এই কয়টা বই খুব যত্ন করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ছাড়া পেলেই খোঁজ নিতেন বইগুলি এনেছেন কিনা। যদিও অনেক বই জেলে পাঠানো হতো। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। নিউ মার্কেটে মার সঙ্গে আমরাও যেতাম। বই পছন্দ করতাম। নিজেরাও কিনতাম। সব সময়ই বই কেনা ও পড়ার একটা রেওয়াজ আমাদের বাসায় ছিল। প্রচুর বই ছিল। সে বইগুলো ওরা নষ্ট করে। বইয়ের প্রতি ওদের আক্রোশও কম না। আমার খুবই কষ্ট হয় ঐ বইগুলির জন্য যা ঐতিহাসিক দলিল হয়ে ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে সবই হারালাম। (চলবে)

তথসূত্র:
২৩. শেখ হাসিনা, “বঙ্গমাতা”, ‘মুজিব বাংলার বাংলা মুজিবের’, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৭ 
২৪. শেখ হাসিনা, ‘অন্তরের রক্তক্ষরণ: একটি রাষ্ট্রের জন্ম”, ঐ, পৃষ্ঠা ৬৮
২৫. শেখ হাসিনা, “বঙ্গমাতা”, ঐ, পৃষ্ঠা ৪৬
২৬. শেখ হাসিনা, ঐ, পৃষ্ঠা ৫০
২৭. শেখ হাসিনা, “স্মৃতির দক্ষিণ দুয়ার॥ দুই”, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৫
২৮. ঐ, পৃষ্ঠা ৬২
২৯. ঐ, পৃষ্ঠা ৫৯
৩০. ঐ, পৃষ্ঠা ৫৮
৩১. শেখ হাসিনা, “স্মৃতি বড় মধুর, স্মৃতি বড় বেদনার”, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭১
৩২. ঐ, পৃষ্ঠা ৭১-৭২
৩৩. শেখ মুজিবুর রহমান, “কারাগারের রোজনামচা”, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৮
৩৪. শেখ হাসিনা, “স্মৃতি বড় মধুর, স্মৃতি বড় বেদনার”, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭০-৭১

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব : শেখ হাসিনার স্বদেশযাত্রা: কী ট্র্যাজিক কী মহাকাব্যিক

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়