ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম: যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত

সৈয়দ ফারুক হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১  
নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম: যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত

সম্প্রতি নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুমোদন করেছে সরকার। মুখস্থ ও পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি শিক্ষায় অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষাকাঠামো প্রণয়ন এর লক্ষ্য।

আইনস্টাইন বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের জীবনে দুটোর বেশি পরীক্ষা থাকা উচিত নয়। বর্তমানের পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতি থেকে শিক্ষাকে বের করে আনতে চাচ্ছে সরকার। পরীক্ষার পরিবর্তে শ্রেণিকক্ষে দক্ষতাভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়ন চালু হতে যাচ্ছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পাল্টে যাচ্ছে শিক্ষাক্রম। বিষয় ও পরীক্ষা কমানোর পাশাপাশি বইয়েও আনা হচ্ছে পরিবর্তন। ফলে সিলেবাসভিত্তিক মুখস্থ বিদ্যার চর্চাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন ফল’ অর্জনের জন্য পড়াশোনা করতে হবে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের মধ্যে থাকছে: প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট ও গ্রুপভিত্তিক শিক্ষা। এ ছাড়া সমসাময়িক ঘটনার অংশ হিসেবে নতুন শিক্ষাক্রমে ঢুকছে ‘করোনা’ নামের অতিসংক্রামক রোগের আদ্যোপান্ত।

দেশের বর্তমান শিক্ষাক্রম মূলত উদ্দেশ্যভিত্তিক। এখানে পরীক্ষার ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। এটি স্বীকার করে নেওয়া প্রয়োজন যে, নির্দিষ্ট সময় পরপর শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক নির্দেশিকায় পরিবর্তন আনা খুব জরুরি। সময়ের সঙ্গে আপডেট থাকার জন্য এটি যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেদের অন্যদের সমপর্যায়ে রাখার প্রয়াসেও এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। অপর দিকে, যখনই নতুন বই তৈরি করা হয়, তখন এর পাশাপাশি শিক্ষক নির্দেশিকা তৈরির কাজটিও করতে হয়। অর্থাৎ পাঠ্যপুস্তক শুধু আলাদাভাবে বদলে ফেললেই হয় না; এর সঙ্গে শিক্ষাক্রম ও শিক্ষক নির্দেশিকাও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আরও বেশ কিছু বিষয় জড়িত, তবে সেগুলো উহ্য থাকলে কোনো সমাধান নেই। আমাদের এই উপমহাদেশে মা-বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে খুব কম সন্তানই নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী পড়তে পারে। কেননা আজকাল সন্তানের রেজাল্ট, সাফল্যের ওপর স্যোশাল স্ট্যাটাস নির্ভর করে! সবাই হয়তো সমান মেধাবী নয়, কিন্তু সবাই কিছু না কিছুতে নিশ্চয়ই মেধাবী। কেউ ভালো ছবি আঁকে, কেউ ভালো গান গায়, কেউ তুখোড় বক্তা, কেউ ভালো খেলাধুলায়, কেউ ডিজাইনে দারুণ, কেউ নাচে দুর্দান্ত। আমাদের মা-বাবা ও শিক্ষকদের লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মেধার দিকটা খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ অভিভাবক বাচ্চাদের সিলেবাসভুক্ত বইয়ের বাইরে অন্য বই পড়তে দেন না। বাবা-মা মনে করেন, তাতে মনে বাজে চিন্তা ঢুকবে বা সময়ের অপচয় হবে। এমন মনে করার জন্য দায়ী আমাদের গড়ে ওঠা সামাজিক আচার।

সব বাবা-মা চান তাদের সন্তান যেভাবে হোক পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পাক। ভালো নাম্বার না পেলে ভালো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না। মেধা তালিকায় না থাকলে ভালো চাকরি পাবে না। অর্থাৎ ভালো চাকরিই হয়ে ওঠে মূল কথা। ভালো স্যালারির চাকরি দেবে সন্তানকে সচ্ছল জীবন। সন্তানের নিরাপদ-সচ্ছল জীবন চাওয়া এই বাবা-মাকে দোষ দেওয়া যায় না। তবে এ জন্য দায়ী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। বর্তমান শিক্ষাক্রমে একজন শিক্ষার্থীকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পরই প্রচণ্ড চাপ নিতে হয়। পঞ্চম শ্রেণিতে ছয়টি বই পড়লেও ষষ্ঠ শ্রেণিতে তার বিষয়সংখ্যা দাঁড়ায় ১২-তে। এরপর নবম শ্রেণিতে ওঠার পর পড়তে হয় মহাসমুদ্রে। বিজ্ঞান, বাণিজ্য নাকি মানবিক কোন বিভাগে পড়বে তা ঠিক করতে হয়। কিন্তু মাত্র ১৪ বছর বয়সে ওই শিক্ষার্থী এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ফলে অভিভাবক বা শিক্ষকরা যে কোনো একটি বিভাগ তার ওপর চাপিয়ে দেন। এতে দেখা যায়, ওই শিক্ষার্থী হয়তো জোর করে বিজ্ঞান বা বাণিজ্যের বিষয়গুলো পড়ছে। মুখস্থের ওপর ভর করে নাম্বার পেলেও প্রকৃত অর্থে সে বিষয়গুলো আত্মস্থ করতে পারে না।

এ ছাড়া একটি বিভাগে সীমাবদ্ধ থাকায় সামগ্রিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয় না। এসব সমস্যার অবসানে এবং বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে ১৩ সেপ্টেম্বর নতুন শিক্ষাক্রমের খসড়া রূপরেখার অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম একেবারে বদলে যাচ্ছে। প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রমে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বদলাবে পরীক্ষা পদ্ধতিও। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে জানা যায়, প্রতি বিষয়ে পূর্ণমান ১০০ নাম্বার থাকলেও চূড়ান্ত পরীক্ষায় বিষয় ও শ্রেণিভেদে ৪০ থেকে ৫০ নাম্বারের পরীক্ষা নেওয়া হবে। বাকি নাম্বারের শিখনকালীন মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা। নতুন এ পদ্ধতি চালুর জন্য বদলে ফেলা হচ্ছে বিদ্যমান শিক্ষাক্রম। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে লেখা হবে নতুন পাঠ্যবই। আর এর সবকিছুই হবে ২০২৩ সাল থেকে।

পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম অনুসারে, শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান নাকি অন্য কোনো শাখায় পড়বে, তা নির্ধারণ করা হবে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে। দশম শ্রেণির আগে আর কোনো পাবলিক পরীক্ষা থাকবে না। শুধু দশম শ্রেণির কারিকুলামের ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হবে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা। ২০২৪ সাল থেকে অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) এবং পঞ্চম শ্রেণির প্রাইমারি এডুকেশন সার্টিফিকেট (পিইসি) পরীক্ষা আর কেন্দ্রীয়ভাবে নেওয়া হবে না। বিদ্যালয়েই বার্ষিক পরীক্ষার মতো এসব শ্রেণির মূল্যায়ন করা হবে। তবে এসব শ্রেণিতে জেএসসি, জেডিসি ও পিইসি সনদ দেওয়া হবে। আর প্রাথমিক স্তরে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষায়ই থাকবে না। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে অভিন্ন ১০টি বিষয় পড়তে হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে, অর্থাৎ প্রতি বছর শেষে হবে পাবলিক পরীক্ষা। আর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমের পথরেখা অনুসারে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের কাজটি আগামী বছর পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে। ২০২৩ সাল থেকে তা সবার জন্য বাস্তবায়ন করা হবে। পর্যায়ক্রমে ২০২৫ সালে গিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি কার্যকর হবে।

ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বিষয়ে পড়ানো হবে। এরপর একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শাখা পরিবর্তনের সুযোগ রাখা হবে। বর্তমানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কিছু অভিন্ন বই পড়তে হয় এবং নবম শ্রেণিতে গিয়ে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা- এসব শাখায় ভাগ হয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে। প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত যে ১০টি বই পড়ানো হবে সেগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সামাজিক বিজ্ঞান, জীবন ও জীবিকা, ধর্ম, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। বর্তমানে এসব শ্রেণিতে ১২ থেকে ১৪টি বই পড়ানো হয়।

একজন শিক্ষার্থী প্রাথমিক পার হয়ে মাধ্যমিকে যায়। এ জন্য এক স্তর থেকে আরেক স্তরে যাওয়া যেন মসৃণ হয়, মাঝে যেন ছেদ না পড়ে, অন্য স্তরে গিয়ে যেন খাপ খাওয়াতে কোনো সমস্যা না হয়, সেটি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আনন্দময় পড়াশোনা হবে। বিষয়বস্ত ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমানো হবে। গভীর শিখনে গুরুত্ব দেওয়া হবে। মুখস্থ-নির্ভরতার বিষয়টি যেন না থাকে, এর বদলে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শেখাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা ও অন্যান্য কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এরপর শিক্ষার্থীরা যেন নিজেদের মতো সময় কাটাতে পারে। বর্তমানে পড়াশোনার বাইরে খেলাধুলা বা অন্যান্য বিষয়ের সুযোগ কমে গেছে, এটা যেন না হয়। জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।

সৃজনশীলতা সবার মধ্যেই আছে। সেটা বের করে আনতে হবে। সবার আগে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করতে হবে। ছেলেমেয়েদের জন্য এমন বই প্রণয়ন করতে হবে যেগুলো তাদের আনন্দ দেবে। সেটা বইয়ের মলাট থেকে শুরু করে লেখা পর্যন্ত। তাদের বিভিন্ন সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে। আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেক মেধাবী, তাদের সুযোগ দিতে হবে। কারিকুলাম হলো শিক্ষার মূলরেখা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য উপযুক্ত হয়ে গড়ে ওঠার মূলরেখা অনুসরণ খুবই জরুরি। পরীক্ষার চাপমুক্ত পড়াশোনা ও জ্ঞানার্জনটা আসলে শিক্ষার্থীদের সময়ের দাবি। এটি বাস্তবায়ন কঠিন হলেও মেধাবী জাতি গঠনে যুগের সঙ্গে তথা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।

লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়