ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব: ভুল বোঝাবুঝি এ রকমও হয়!  

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৫, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১  
সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব: ভুল বোঝাবুঝি এ রকমও হয়!  

এগারো সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাব তলবের ঘটনায় ক্ষোভ, উদ্বেগ প্রকাশ এবং আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সাংবাদিকদের শীর্ষ চার সংগঠনের ১১ নেতার ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক নেতারা প্রতিবাদ জানিয়েছেন, প্রেসক্লাবে সমাবেশ করেছেন, স্বরাষ্ট্র ও তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রত্যেকে যার যার জায়গা থেকে বক্তব্য রেখেছেন। সামাজিক মাধ্যমে এসব বক্তব্যের সমর্থনে ও বিপক্ষে নানা কথাও চলছে। প্রথমেই সাংবাদিক নেতারা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন সেটি খুবই ইতিবাচক। তারা বিস্মিত হয়েছেন, তারা বিষয়টিকে মানহানীকর মনে করলেও হিসাব তুলে ধরতে স্বপ্রণোদিত হয়েছেন। বলেছেন শেষ পর্যন্ত যা পাওয়া যাবে তা যেন প্রকাশ করা হয়। কারণ এতে সমাজে তাদের সন্মানহানী হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও মনে করেন সাংবাদিক নেতাদের মানহানী হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে যেসব তথ্য তিনি দিয়েছেন সেগুলো ভাবনার জায়গা তৈরি করে। সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেন, ‘ঘটনাগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে হয়েছে, আসলে আমারও জানা ছিল না। তথ্যমন্ত্রী মহোদয়ও বোধহয় জানতেন না কিছু। এই ঘটনা কীভাবে ঘটলো আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আপনাদের মতো একটি চিঠির কথা বলেছেন। সেই চিঠির উৎপত্তি কোথায় সেটি আমি দেখেছি। আমার মনে হয় একটা ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমে চিঠিটা গিয়েছে’। 

ভুল বোঝাবুঝি এ রকম হতে পারে, এতটা অসংবেদনশীল হতে পারে সরকারের ভেতরের লোক, এটা ভাবলেই অবাক লাগে।  

যে কোনো নাগরিকের ব্যাংক হিসাব তলব করতে পারে বিএফআইইউ। কিন্তু এই সংস্থার আসল কাজটা কী, সেটা একটু খতিয়ে দেখা দরকার। বিএফআইইউ-এর কথা সংক্ষেপে বলা আছে দুটি আইনে—২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন আর ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে। বিএফআইইউ-এর মুখ্য উদ্দেশ্য হলো মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর অস্ত্রের (উইপন অব মাস ডেস্ট্রাকশন) বিস্তার রোধকল্পে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ব্যাংকিং হিসাব–নিকাশের অনুসন্ধান করা। তারপর সেই অনুসন্ধানলব্ধ তথ্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে জানানো। ১১ জন সাংবাদিক নেতা একযোগে এসব কাজ করেছেন বলে তারা মনে করল?  এভাবে সাংবাদিক সংগঠনের পদ-পদবি উল্লেখ করে সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা অনভিপ্রেত বলেই প্রতীয়মান হয়; যেটা স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলছেন। 

অনেক প্রকারের ব্যাখ্যা আসছে খোদ সাংবাদিক মহল থেকেই। এই ১১ নেতা অবশ্যই সততা ও সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করছেন এবং করে যাবেন বলেই বিশ্বাস করি। এবং এর মাধ্যমে তারা আমলা, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও অন্য পেশাজীবীদেরও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের দাবি করতে পারেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ায় মনে হলো, বিষয়টি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে জানানো হয় নি। তাই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, সরকারের ভেতর এমন অতি উৎসাহী কারা, যারা সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিতর্কিত করতে চাচ্ছে? কিংবা সাংবাদিকদের সরকারের মুখোমুখি করতে চায়?

সাংবাদিক নেতারা বলছেন, সরকারের ভেতর যে চক্রটি দুর্নীতি করে তারা নিজেদের অপকর্মের সমান্তরাল করতে সাংবাদিকদেরকেও দুর্নীতিবাজের তকমা দিতে চায়। সবাইকে এক পাল্লায় আনতে চায়। 

ব্যক্তি আর সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান এক নয়। সরকার প্রয়োজন মনে করলে যে কারও সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু একসঙ্গে ১১ সাংবাদিক নেতা, তাও তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ উল্লেখ করে, ব্যাংক হিসাব চাওয়ার বিষয়টি বড় জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করেছে। কারণ তাদের কাছে কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে হিসাব তলব করে নোটিশ দেয়া হয় নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত, বিএফআইইউ, দেশের সব ব্যাংকে চিঠি দিয়ে ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে। বিএফআইইউ-এর গোয়েন্দা সংস্থার মতো কাজ করার কথা। তাদের তথ্য বাইরে যাওয়ার কথা নয়। একজন নাগরিকের ব্যাংক হিসাব অত্যন্ত গোপনীয় বিষয়। ব্যাংকগুলোর কাছেও এটা আমানত। কিন্তু সেটা মিডিয়ায় এত ফলাও করে প্রচার করা কেন হলো- সেটাও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। 

সরকারের যে বা যারা ১১ সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাব বিএফআইইউ-এর কাছে চেয়েছে সেটা প্রকাশ হলো কীভাবে? প্রকাশ করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হলো কেনো? এই গোপনীয়তা রক্ষা করতে না পারলে ব্যাংকিং খাতকে গ্রাহকরা বিশ্বাস করবে কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন। একজন নাগরিকের তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

আগেই বলেছি, বিএফআইইউ-এর দায়িত্ব হলো মানি লন্ডারিং, জঙ্গি অর্থায়নে ওতপ্রোতভাবে জড়িতদের হিসাবের তথ্য নেওয়া। তাই এখন বিএফআইইউ ব্যাংক হিসাব–নিকাশের লেনদেন থেকে তাদের এসব অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অকাট্য প্রমাণ দিতে হবে। যদি না হয় তাহলে বলতেই হবে বিএফআইইউ-এর এমন পদক্ষেপে ১১ জন সাংবাদিক নেতার বিনা কারণে সুনাম নষ্ট হয়েছে। এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার দৃঢ় ও যৌক্তিক কারণ ছাড়া সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংকের হিসাব তলব বিএফআইইউ করতে পারে কী?

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়