ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাবো’

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪১, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১   আপডেট: ১১:৪৯, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২
‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাবো’

‘এই রাত তোমার আমার’, ‘আঁধারেরও আছে ভাষা’, ‘ও আকাশ সোনা সোনা’, `মুছে যাওয়া দিনগুলো’, `আজ দুজনার দুটি পথ’ এমন কালজয়ী অসংখ্য গান আজো তার কথা মনে করিয়ে দেয়। বাংলা গানের এই কিংবদন্তীর দরদমাখা কণ্ঠের প্রতিটি গানই হয়ে আছে দেদীপ্যমান। 

‘তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো’, ‘কেন দূরে থাকো শুধু আড়াল রাখো’, ‘আমার জীবনের এত খুশি এত হাসি’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব’, ‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘বসে আছি পথ চেয়ে’, ‘আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি’, ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না’, ‘পৃথিবীর গান আকাশ কি মনে রাখে’, ‘আজ রাতে ঘুমিয়ে পড়ো না তুমি’, ‘যাবার আগে কিছু বলে গেলে না’, ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম’, ‘আয় খুকু আয়’, ‘সব কথা বলা হলো’, ‘তারপর, তার আর পর নেই’, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’, ‘বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা’, ‘মেঘ কালো আকাশ কালো’, ‘কত দিন পরে এলে একটু বসো’, ‘এক গোছা রজনীগন্ধা হাতে দিয়ে বললাম’, ‘শোনো বন্ধু শোনো’, ‘রানার ছুটেছে’, ‘যে বাঁশি ভেঙে গেছে’, ‘এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু’, ‘কোনো এক গাঁয়ের বধুর’, ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’, ‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাবো’-র মতো চিরায়ত গানগুলো কি কখনো ভোলা যায়?

বাংলা গানের জনপ্রিয় গায়ক, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ৩২তম মৃত্যবার্ষিকী আজ।  ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আমাদের ছেড়ে চলে যান।  মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে তিনি ঢাকায় এসে ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে, আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে’ এই গানটি শুনিয়েছিলেন।  বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে শিল্পী যে তার গানের স্বরলিপি চিরদিনের জন্য খোদাই করে রেখে গেছেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে গান করেছিলেন। তিনি সেসময় বিভিন্ন ক্যাম্প এবং শরণার্থী শিবিরে ঘুরে বেড়াতেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। শুধু তাই নয়, তিনি চ্যারিটি শো করে এর অর্থ তুলে দিয়েছিলেন উদ্বাস্তু শিবিরের সাহায্যার্থে। তার গাওয়া ‘মা গো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে’ গানটি দারুণভাবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের।

১৯২০ সালের ১৬ জুন ভারতের বারাণসীতে তার জন্ম। 

অলৌকিক এক সৌন্দর্য রয়েছে গানগুলোর পরতে পরতে। এ কারণে গানগুলো শোনা হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তার আবেদন একটুও ম্লান হয়নি।  বাংলা গানের ইতিহাসে এ যাবৎ কত কত শিল্পী গান গেয়েছেন। কিন্তু তারমধ্যে স্ব-মহিমায় আজো তিনি ‘সুরের আকাশে শুকতারা’ হয়ে আছেন। 

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই হেমন্ত নিজেকে সম্ভাবনাময় শিল্পী এবং কম্পোজার হিসেবে সবার নজর কাড়েন। সেসময় তিনিই ছিলেন একমাত্র পুরুষ কণ্ঠশিল্পী যিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কাজ করেছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনায় মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ছবির মধ্যে রয়েছে হারানো সুর, দ্বীপ জ্বেলে যাই, নীল আকাশের নীচে, স্বরলিপি, শেষ পর্যন্ত, কুহক, দুই ভাই, সপ্তপদী, রাগ অনুরাগ, ফুলেশ্বরী এবং দাদার কীর্তি।

তিনি উত্তম কুমারের বাংলা সিনেমা ‘শাপমোচন’ এর সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই ছবিতে তিনি চারটি গান করেছিলেন। তারপর থেকেই যেন উত্তম কুমারের ছবি মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। পরবর্তী সময়ে এই জুটি পেয়েছিল অসম্ভব জনপ্রিয়তা। 

হেমন্ত গেয়েছিলেন ‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাবো, আমিও নদীর মতো আসবো না ফিরে আর আসবো না ফিরে কোনোদিন’। সত্যিই তিনি আর ফিরে আসবেন না কোনো দিন। কিন্তু তার সৃষ্টিই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে চিরদিন। জনপ্রিয় গানগুলোর মাধ্যমে তিনি মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।

জীবনবাদী গায়ক নচিকেতা তার এক গানে বলেন, ‘বাংলার গানে যার নামেই বসন্ত/তিনিই গায়ক-সুরকার হেমন্ত’। 

ঢাকা/টিপু

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়