ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

দুর্গতিনাশিনীর মন্দিরে (শেষ পর্ব)

ফাতিমা জাহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ১৬ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ২০:৫৪, ১৬ অক্টোবর ২০২১
দুর্গতিনাশিনীর মন্দিরে (শেষ পর্ব)

মন্দিরের গায়ে খোদাই করা পুরাণের বিভিন্ন ঘটনা

পুরোহিতের খালি গা, পরনে সাদা লুঙ্গি বা পাঞ্চা। এ মণ্ডপে ভক্তদের ভিড়ও বেশি। রেলিং দেওয়া মণ্ডপ যাতে ধাক্কাধাক্কি না লাগে৷ রেলিং ধরে ধরে এগিয়ে যেতে যেতে পূজারীর হাত থেকে প্রসাদ গ্রহণ করলেই এই মণ্ডপ থেকে বের হতে হবে। আমি এতক্ষণে বুঝলাম যে মূল মন্দিরে এসে পড়েছি। বোঝার আগেই লাইন ধরে বেরিয়ে আসতে হলো। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবার নিয়ম নেই। আর গর্ভগৃহও একেই বলা হয়।

বাইরে লেখা দেখেছি- ছবি তোলা নিষেধ। একই প্যাসেজ পার হলে সামনে আরেকটি মণ্ডপ। ভেতরে শিব ঠাকুরের লাইফ সাইজ রূপার মূর্তি নটরাজ নাচের ভঙ্গিতে। আরেকটু এগুলে ফুলের সুবাসে মাদকতা আসে। এটিও মূল মন্দিরের অংশ। মন্দিরে শিব ঠাকুরের ছোট একটি মূর্তি চন্দন, কুমকুম আর ফুলের মালায় সেজে চুপটি করে নৈবিদ্য নিচ্ছে। মীনাক্ষী আর সুন্দরেশ্বরের মন্দিরের দেয়াল রূপায় বাঁধানো, চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে তাদের কক্ষ থেকে, রূপা দিয়ে মোড়ানোই শুধু নয় দেয়ালে রূপার ধাতুর উপর খোদাই করা নানা চিত্র, মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বরের নানা পুরাণ আঁকা। সন্ধ্যা আরতির পর সুন্দরেশ্বরকে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয় মীনাক্ষীর কক্ষে, সেখানে স্বামী স্ত্রী একত্রে রাত্রিযাপন করেন, সুখ-দুঃখের কথা কন, মনের ডালি উজাড় করে দেন।

সূর্যের মতো সোনালী একটি স্তম্ভ। পুরোটাই স্বর্ণ দিয়ে গড়া

মন্দির দুটো থেকে বের হয়ে আসার পর দেখি বাইরে লেখা আছে- হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রবেশ নিষেধ। হায় ভগবান, হায় দুর্গা দেবী, হায় মীনাক্ষী দেবী আমি তো না জেনেই ঢুকে পড়েছি। এখন উপায়! যাই হোক ভুল করে ফেলেছি; আর আমি তো মানুষ, তাহলে দেব-দেবীর কাছে এ অপরাধ হতেই পারে না। কারণ তাঁদের চোখে সবাই সমান। এই কনফিডেন্স নিয়ে সামনের দিকে চললাম। এই মন্দিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চওল্ট্রি হলো হাজার স্তম্ভের মণ্ডপ। কারুকাজে সমৃদ্ধ এক হাজার স্তম্ভের সমন্বয়ে নির্মিত হয়েছে এই মণ্ডপ লম্বা প্যাসেজের এক পাশে পূজা বা বিভিন্ন অনুষ্ঠান করার জন্য অনেকখানি জায়গা। আশপাশের অনেকেই এ মন্দিরে আসেন বিবাহ সম্পন্ন করতে। হিন্দু ধর্ম মতে, বিবাহ মানব জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়।

স্থানীয় স্কুল ফেরত কিশোরীদের সঙ্গে লেখক

এক জায়গায় দেখি শিব পার্বতীর বিবাহ অনুষ্ঠানের দৃশ্য খোদাই করা আছে দেয়ালে৷ মীনাক্ষী দেবীকে স্বামী সুন্দরেশ্বরের হাতে সম্প্রদান করছেন স্বয়ং দেবতা বিষ্ণু। এ মন্দিরে মানা হয় যে, মীনাক্ষী দেবীর বিবাহের সময় বিষ্ণু ঠাকুর খোদ কন্যার জেষ্ঠ্য ভ্রাতা হয়ে কন্যা সম্প্রদান করেছিলেন সুন্দরেশ্বর ঠাকুরের হাতে। একটি মন্দিরের ছাদের নিচে কত যে দেবদেবীর মন্দির তা বলে শেষ করা যাবে না৷ শুধু দুর্গা বা শিব নয় অন্যান্য অনেক দেবতার ছোট ছোট মন্দির আছে একই প্রাঙ্গণে একটু দূরে দূরে। সব মন্দির বা ভগবানের ঘর একটি ছাদের নিচে ছায়া পাচ্ছে, ভক্ত আর পুরোহিতদের ভালোবাসা পাচ্ছে।

প্রতিমার মতো রঙিন সাউথ সিল্ক জড়ি পাড়ের কাপড়ের টপ আর লম্বা স্কার্ট পরে, মাথায় গাজরা ঝুলিয়ে বাচ্চা মেয়েরা এক দেবতা থেকে অন্য দেবতার কাছে ছুটে যাচ্ছে। আজকের দিনের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখে নিলাম! প্রতিমা মন্দিরে থাকতে হবে তার কোনো মানেই হয় না। স্তম্ভে স্তম্ভে খোদাই করা দেবতারাও কম আদর যত্ন পাচ্ছেন না, তেল সিঁদুরে, কোথাও তুলসী পাতা আর হলুদে বেশ মাখামাখি হয়ে আছেন। কোথাও পুরোহিত আপন মনে শ্লোকের পর শ্লোক পড়ে যাচ্ছেন। কোনো দেবতার সামনে ভক্ত সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছেন। চারিদিকে আবছা আলো আঁধারিতে একটু একটু করে আমি এক আলোকজ্জ্বল মণ্ডপে চলে গেলাম। এবার কল্পনায় নয়, সত্যিই। এমন আবছায়ায় এত ঔজ্জ্বল্য আঁকড়ে আছে সূর্যের মতো সোনালী একটি স্তম্ভ। স্তম্ভটি পুরোটাই স্বর্ণ দিয়ে গড়া। বলা হয় এটিতে কম করে হলেও ১৭ কেজি স্বর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে দর্শনার্থীদের ভিড়ও বেশ।

মন্দিরের ভেতরেই স্বচ্ছ জলের পুকুর। ডানে পুরোহিত নিচ্ছেন পূজার প্রস্তুতি

আমি মূল মন্দির থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছি। অনেক দেশের, অনেক জাতের, ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মানুষের কথায় মুখরিত মন্দির চত্ত্বর। আধ বেলা ঘুরে-ফিরে পুজো দেখে, পুজোর আবহাওয়ায় পেট পুজোর কথা একেবারে ভুলিনি। কাছেই একটি শুদ্ধ শাকাহারি রেস্তোরাঁ আছে। বন্ধুদের কাছ থেকে জেনেছি সেখানে মাদুরাই-এর শ্রেষ্ঠ খাবার পাওয়া যায়।

রেস্তোরাঁয় তখন ভক্তদের ভিড়। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে প্রায়। সাধারণত দক্ষিণ ভারতীয়রা পূজা পার্বণে শাকাহারি বা নিরামিষ খাবার ভোজন করেন। আমি বহু বছর দক্ষিণ ভারতে বাস করার কারণে এই নিরামিষ খাবার খুব আনন্দ নিয়ে খাই। বিয়ে বাড়ি, জন্মদিন বা যে কোনো অনুষ্ঠানে এই খাবার পরিবেশন করা হয়। দক্ষিণ ভারতের এক বিশাল অংশ নিরামিষাশী।

প্রথমে কলাপাতা পেতে দেয়া হয় অতিথির সামনে। তারপর যে কোনো মিষ্টি বা সেমাই বা হালুয়া বা চার-পাঁচ রকমের মিষ্টি রাখা হয় কলাপাতার এক কোণায়, এরপর কয়েক রকমের সবজি বা ভাজি এদেশে বলা হয় পালইয়া, সাথে লুচি। এসব খাওয়া হলে আসে সবজি পোলাও সাথে রাইতা, এই খাবার আমার কাছে অমৃত। সবই পরিবেশক এসে একটু একটু করে পরিবেশন করে যান নিজ হাতে রাখা লম্বা জগের মতো বাটি থেকে। কারো সামনে কোনো বাটি রাখা হয় না। সবজি পোলাও পাত থেকে পাকস্থলীতে গেলে আসে আসল খাবার, দক্ষিণ ভারতের অত্যন্ত প্রিয় খাবার আন্না সারু বা ভাত সাম্বার, সাথে পাপড়। আমাকে এই খাবার মাসের ত্রিশ দিন দিলে অতি আগ্রহভরে খাব। এর সাথে পানীয় বাটার মিল্ক বা মাজিগে বা নোনতা ঘোল। এরপর আসে ভাতের সাথে রাসাম বা তেঁতুলের তরকারি।

পিরামিড আকৃতির একেকটা গোপুরাম 

আনন্দের সঙ্গে ভোজন করতে করতে ভাব করে ফেলি রেস্তোরাঁর সেবক মানে যিনি খাবার পরিবেশন করেন তাঁদের সাথে। একজনের নাম নাগারাজ অন্যজন গানেশা। নাগারাজের বক্তব্য আমার আসলে আরও বেশি খাওয়া উচিত। অন্যরা যেখানে তিন-চার বার ভাত চেয়ে নেয় সেখানে আমি কিছুই চেয়ে খাইনি। আমি বলি, ‘মীনাক্ষী আম্মান মন্দির দেখেই পেট ভরে গিয়েছে।'

বিকেলের মন্দির অন্য আলোয় গড়া, সূর্য এখন আরও শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে গোপুরামগুলোর। মন্দিরের সামনের রাস্তায় পুলিশ টহল দিচ্ছে ফুল ইউনিফর্ম আর খালি পায়ে। নগ্ন পদে ডিউটি করার কারণ হলো এখানে এই পবিত্র জায়গায় কোনোভাবেই জুতার মতো অপবিত্র (দক্ষিণ ভারতীয়দের মতে) বস্তু পায়ে দিয়ে চলাফেরা করা যাবে না।

পথের দুই ধারে বাজার এখন বেশ জমে উঠেছে। হাত দেখার গণকের সাথে দেখি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত গণকও পথের এক কোণে চাদর বিছিয়ে বসে মন্দিরে আগত ভক্তের ভাগ্য গণনা করছেন। দক্ষিণ ভারতের একটা ব্যাপারে পুরুষদের সবার মধ্যে খুব মিল, সবাই সাদা রঙের শার্ট আর সাদা লুঙ্গি বা পাঞ্চা পরে (অবশ্য তা ভাঁজ করে হাঁটু অবধি ওঠানো থাকে)। আর নারীরা সবাই রঙিন শাড়ি পরেন খুব, বয়স যাই হোক না কেন, সাথে থাকে মাথায় ফুলের গাজরা বা মালা।

পূজা শেষে ভক্তরা নিচ্ছেন প্রসাদ

আমি ভাবলাম পথের খোলা বাজার তো অনেক দেখলাম এবার মন্দিরের উল্টোদিকে সাধারণ একটা মার্কেটে ঢুকে পড়ি। মন্দিরের পাশে বলে একতলা মার্কেটেও মন্দিরের মতো আকার। আসলে এটি মন্দিরের একটি অংশ ছিল। দ্বাদশ শতকে যখন মন্দির নির্মিত হয়েছিল তখন আরও অনেক দূর অবধি বিস্তৃত ছিল। আর এত সমৃদ্ধশালী স্থাপত্যকলায় সুদৃশ্য মন্দিরটি ছিল শহরের একদম কেন্দ্রে৷ মন্দির থেকে চারপাশে লম্বা পথ চলে গিয়েছিল, কেউ হারিয়ে গেলে সোজা মন্দিরে এলে পথ খুঁজে পেত।
বাজারের ভেতরের স্তম্ভে কারুকাজ আর প্রতি কোণায় দেব-দেবীর মূর্তি প্রতিস্থাপন করা। ভক্তরা যখন ইচ্ছে প্রণাম করে যাচ্ছেন। বাজারে জামাকাপড়, গহনা, প্রসাধনী, পিতলের তৈজসপত্র বা পুজোর জন্য একটু দামী জিনিসপত্র সবই পাওয়া যাচ্ছে। এই বাজারে এত মূর্তি, এত পুজোর সামগ্রী আর পুজো পুজো আবহাওয়ার মাঝেও বোরখা পরা মুসলমান নারীরা কেনাকাটা করছেন। বাইরে পথ দিয়েও হেঁটে চলছেন, কোথাও কোনো অসমতা নেই।

বাজার ঘুরে আবার চললাম মন্দিরে। সন্ধ্যা আরতি দেখব এবার। প্রদেশদ্বার পার হয়ে দেখি কয়েকজন বাদ্যযন্ত্রশিল্পী দক্ষিণ ভারতীয় পুজোর সুরে ঢোল, সানাই বাজিয়ে মন্দির প্রদক্ষিণ করছেন। সবাই সাদা শার্ট, সাদা পাঞ্চা পরিহিত। দক্ষিণ ভারতের ট্রেডিশন মেনে কপালে চন্দন, কুমকুমের ফোঁটা দেওয়া। আমাকেও এমন চন্দন, হলদি, কুমকুমের ফোঁটা দিয়ে দিয়েছিল পুরোহিত এ মণ্ডপ, সে মণ্ডপ ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম যখন।

দক্ষিণ ভারতীয়রা পূজা পার্বণে শাকাহারি বা নিরামিষ খাবার ভোজন করেন

সন্ধ্যার স্বর্ণালী আভা এখন ছড়িয়ে পড়েছে গোপুরামে। ভেতরে পুস্করিণীর পাড়ে বসে পড়লাম আরতি শুরু হলে ভেতরে যাব তাই। কিচ্ছুক্ষণ পর দেখি একদল স্কুল ফেরত দুর্গা মন্দিরে এসে প্রণাম শেষে পুস্করিণীর ধারে বসল। আমার পাশে কেউ, সিঁড়িতে কেউ। ওরা জানতে চায় বড় শহরের গল্প আর আমি জানতে চাই ওদের গল্প। এই গল্প, কলকল কথার বেলায় আমি ভুলেই গেলাম যে আমি মীনাক্ষী মন্দিরে এসেছি। আমার কাছে এরাই দুর্গতিনাশিনী। এরাই বিদায় বেলার দুর্গা, এরাই রক্ষাকবচ, এরাই প্রতিবাদের প্রতীক, এরাই মমতাময়ী, শক্তির তৃতীয় নয়ন। এরা শরতকালে আসে আমাদের উঠোনে মিষ্টি আলো হয়ে, কাশফুলের রূপ আর শিউলির বাসনা হয়ে। এরাই আমাদের আগলে রাখে দুর্গা মায়ের পাঠানো দেবী হয়ে।

মূল মন্দিরে তখন পুরোহিত সুর করে বলছেন,

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু ক্ষান্তিরূপেণ সংস্থিতা
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু জাতিরূপেণ সংস্থিতা
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু লজ্জারূপেণ সংস্থিতা
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু শান্তিরূপেণ সংস্থিতা
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ

 

প্রথম পর্ব: দুর্গতিনাশিনীর মন্দিরে

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়