ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মালদ্বীপে কেমন আছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা

মেসবাহ য়াযাদ, মালদ্বীপ থেকে ফিরে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:০৭, ৬ ডিসেম্বর ২০২১  
মালদ্বীপে কেমন আছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা

মালদ্বীপ প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক

ভারত মহাসাগরের মাঝে এশিয়ার ছোট্ট একটি দেশ মালদ্বীপ। ১ হাজার ১৯২টি ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে এ দেশ গঠিত। এর মধ্যে কেবল ২০০টি বাসযোগ্য। এর প্রতিটি দ্বীপে আছে একাধিক রিসোর্ট। এসব দ্বীপে সারা বিশ্ব থেকে প্রতিদিন আসছেন হাজার হাজার পর্যটক। দুটো মাত্র শহর আছে দেশটিতে। রাজধানী শহর মালে এবং আরেকটি শহর হুলহুমালে। মালদ্বীপের জনসংখ্যা ৫ লাখের কিছু বেশি। এখানে কাজ করছেন ২ লাখের বেশি বাংলাদেশি। আছেন অর্ধলাখ ভারতীও। সব মিলিয়ে মালদ্বীপে বসবাসরত মানুষের সংখ্যা মাত্র ৮ লাখ। এদিক-সেদিক এত বাংলাদেশি যে মনে হয়, মালদ্বীপ নয়, এ যেন আরেক বাংলাদেশ!

প্রথমবারের মতো ঢাকা-মালে রুটে বিমান সার্ভিস চালু করেছে বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স। ফলে, অন্য বিমান সংস্থাগুলো তাদের ভাড়া কমাতে বাধ্য হয়। মালদ্বীপে কর্মরত বৈধ বাংলাদেশি কর্মীরা সরাসরি মালদ্বীপ থেকে দেশে আসতে পারতেন না। তাদের আসতে হতো শ্রীলঙ্কা হয়ে। খরচ পড়ত ওয়ানওয়ে ৫৫ হাজার টাকার মতো। বর্তমানে চার ঘণ্টার মধ্যে সরাসরি আসতে বা যেতে পারছেন এসব প্রবাসী বা পর্যটকরা। খরচ পড়ছে ওয়ানওয়ে ২৫ হাজার এবং আপ-ডাউন ৪৫ হাজার টাকার একটু বেশি।

ঢাকার বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করা ৮৫ জন সংবাদকর্মী ইউএস বাংলা এয়রলাইন্সের আয়োজনে গত ৩ থেকে ৫ ডিসেম্বর মালদ্বীপ ঘুরে আসেন। সফরকালে মালদ্বীপের প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত হোটেল, বোট-ইয়ট, বিভিন্ন কারখানা, দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করা অনেক প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। তারা তাদের নানা আনন্দ-বেদনা-বঞ্চনার বিষয়ে রাইজিংবিডির এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছেন। অনেক কষ্টের মাঝেও যারা দেশে নিয়মিত অর্থ পাঠাচ্ছেন, তাদের স্বজনরা কি জানেন, আমাদের প্রায় ২ লাখ প্রবাসী মালদ্বীপে কেমন আছেন?

ছোট্ট এই দ্বীপরাষ্ট্রে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ বাংলাদেশি থাকায় মালে এবং হুলহুমালে শহরের যেকোনো এলাকায় প্রতি ২০-৩০ গজ হাঁটলেই প্রবাসী বাংলাদেশির দেখা মেলে। তারা মূলত এখানে কাজ করছেন হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। কেউ কেউ কাজ করছেন হুলহুমালেতে নতুন তৈরি হওয়া বিশাল ভবনগুলোতে। এখানে কেউ কার্পেন্টার, কেউ ইলেকট্রিশিয়ান, আবার কেউ সাধারণ শ্রমিক। তাদের মধ্যে অল্প কিছু মানুষই সার্বিকভাবে ভালো আছেন। ৪০০-৫০০ ডলার বেতন পাচ্ছেন। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করছে কোম্পানি। দুই বছর পর দুই মাসের বেতন এবং আপ-ডাউন টিকিটসহ দেশে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু, বেশিরভাগ প্রবাসীই অবৈধ বলে তাদের অবস্থা ততটা ভালো নয়।

মালদ্বীপে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান জানিয়েছেন, সরকারি হিসাব অনুযায়ী, মালদ্বীপে বৈধভাবে কাজ করছেন ৭০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক। তাদের মধ্যে দক্ষ ও অদক্ষ উভয় ধরনের শ্রমিক আছেন। অবৈধভাবে মালদ্বীপের বিভিন্ন দোকান-মার্কেট-রিসোর্ট-হোটেলে কাজ করার পাশাপাশি ব্যবসা করছেন ৩০ হাজারের মতো বাংলাদেশি। এসব শ্রমিকের মধ্যে যারা বৈধভাবে কাজ করছেন, তারা ভালো আছেন। যারা অবৈধ, তারা কিছু সমস্যার মধ্যে আছেন। অবৈধ ৩০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিককে মালদ্বীপ সরকারের মাধ্যমে নিয়মিত করার ব্যাপারে কাজ করা হচ্ছে।

মালদ্বীপে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কিছু সমস্যার কথা জানিয়েছেন কয়েক ব্যক্তি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তরুণ ফাইজুল (২২) মালদ্বীপে আছেন তিন বছর ধরে। মালদ্বীপে এক দোকানের সামনে ডাব বিক্রি করেন তিনি। প্রতিটি ডাবের দাম ২০-২৫ রুফিয়া (১০০-১২৫ টাকা)। ফাইজুল বলেন, ‘২৫০ ডলার বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও এখন দিচ্ছে ২০০ ডলার। থাকা-খাওয়ার খরচ বাদ দিয়ে মাসে ১০ হাজার টাকাও থাকে না।’

অন্য জায়গায় যাচ্ছে না কেন? এ প্রশ্নের জবাবে ফাইজুল বলেন, ‘পাসপোর্ট আটকে রেখেছেন মালিক। এ ব্যাপারে দূতাবাসে কথা বলার চেষ্টা করেও কোনো সমাধান পাইনি।’

শুধু ফাইজুল নন, তার মতো আরও কয়েকজন জানান একই ধরনের সমস্যার কথা। তারা অবৈধভাবে আছেন বলে মালিক ঠকাচ্ছেন। ঠিকমতো বেতন দেওয়া হয় না। পাসপোর্ট আটকে রাখা হয়েছে। কুমিল্লার মাসুদ রানা, চাঁদপুরের সাদ্দাম হোসেন, শ্রীমঙ্গলের ইমন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুলাল মিয়াও একই কথা বলেন। তারা একেকজন দালালকে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে মালদ্বীপে এসেছেন। চার বছর ধরে অবৈধভাবে কাজ করছেন। কয়েকবার দূতাবাসে গিয়ে কথাও বলেছেন। কোনো লাভ হয়নি।

কুমিল্লা চান্দিনার ফিরোজ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তিন বছর ধরে। করোনার আগে ৩০০ ডলার বেতন পেতেন। করোনার সময় সেই বেতন গিয়ে ঠেকেছে ১০০ ডলারে। এ বছরের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে বেতন পান ২০০ ডলার। এখানে থাকার খরচ খুব বেশি। পাসপোর্ট আটকে রাখার কারণে অন্য কোথাও কাজ করতেও পারছেন না তিনি।

ফিরোজ বলেন, 'বেতনের ব্যাপারে কয়েকবার দূতাবাসে যোগাযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। প্রথমত, তারা ঢুকতে দেন না। ঢুকতে দিলেও খারাপ আচরণ করেন। বেতন যে পাচ্ছি না, সে ব্যাপারেও কোনো সহযোগিতা করেন না। ২-১ মাস পর পর বেতন পাই।’

ঢাকা থেকে মালদ্বীপে যাওয়া ৮৫ জন সংবাদকর্মীর সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাসে ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রাষ্ট্রদূতের মতবিনিময় সভায় হয়। সে সভায় প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের সমস্যা এবং দূতাবাসের সেবা নিয়ে তাদের অভিযোগের জবাবে মালদ্বীপে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান বলেন, ‘কেউ প্রবাসীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে, সেটা দুঃখজনক। এই ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হবে। তাদের যেকোনো সমস্যায় তারা দূতাবাসে আসতে পারবেন। আমরা তাদের সুবিধা-সমস্যা দেখার জন্যই এখানে আছি।’

রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ‘তবে আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, বিশেষ করে জনবল। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, যেসব প্রবাসী অনিয়মিতভাবে (অবৈধ) এখানে আছেন, তাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে যাতে নিয়মিত (বৈধ) করা যায়। এ ব্যাপারে আমরা মালদ্বীপের ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। যারা নিয়মিত আছেন, কিন্তু বেতন অনিয়মিত বা কম পাচ্ছেন, তাদের অভিযোগ শোনার পর আমরা সেসব মালিককে অনুরোধ করেছি, যাতে শ্রমিকদের চুক্তি মতো নিয়মিত বেতন দেন। এর বাইরে আসলে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা তো তাদের শাস্তি দিতে পারি না। তবে, এখন থেকে বিষয়গুলো দূতাবাসের মাধ্যমে আরও সিরিয়াসলি দেখা হবে।’

মেসবাহ/রফিক

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়