ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দিয়াকুলে কূলহারা মানুষের আহাজারি কতদূর পৌঁছাবে?  

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪৫, ২৪ ডিসেম্বর ২০২১  
দিয়াকুলে কূলহারা মানুষের আহাজারি কতদূর পৌঁছাবে?  

নদীমাতৃক এই দেশে লঞ্চডুবি-নৌকাডুবির ঘটনা আমাদের কাছে বেশ পরিচিত। লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও মাঝেমধ্যে শোনা যায়। তবে তিনতলা একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ আগুনে পুড়ে যাওয়ার ঘটনা শুনে আমরা থমকে যাই। চারদিকে বিপুল জলরাশির মধ্যে ভেসে থাকা এত বড় একটি লঞ্চ পুড়ে যাচ্ছে দেখে বুকের ভেতরে প্রচণ্ড ধাক্কা লাগে। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে মন।

আগেরদিন রাজধানীর সদরঘাট থেকে যখন লঞ্চটি অন্তত হাজারখানেক যাত্রী নিয়ে যাত্রা করেছিল; তখন কে ভেবেছিল হতভাগ্য লঞ্চটি গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই এত বড় দুর্ঘটনার মুখে পড়বে! আজ শুধু হতভাগ্য সেই যাত্রীরা নন, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এ খবর পৌঁছে গেছে দিকদিগন্তে- এমভি অভিযান-১০ তার শেষ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি।

ঢাকা থেকে বরগুনা, অথবা বরগুনা থেকে ঢাকা। ছোটবেলা থেকেই আমার খুব চেনা পথ। ছোটবেলায় কাঠের তৈরি লঞ্চে এই পথে যাতায়াত করেছি। খাকদোন, বিশখালী, সুগন্ধা, কীর্তনখোলা, মেঘনা পাড়ি দিয়ে লঞ্চ যখন বুড়িগঙ্গায় প্রবেশ করতো, তখন লঞ্চের ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে ঢাকা শহর দেখা শুরু করতাম। ঢাকা থেকে বরগুনাগামী লঞ্চেই একসময় দৈনিক খবরের কাগজ যেত। আজকের দৈনিক পত্রিকাগুলো পরের দিন বিকেল বা সন্ধ্যা নাগাদ বরগুনা ঘাটে পৌঁছতো। পত্রিকাবাহী লঞ্চের হুইসেল শোনাটাই যেন অনেক আনন্দের ছিল!

আমি এবং আমার মতো আরো অনেকে সেই দিনগুলোতে পত্রিকার জন্য লঞ্চের অপেক্ষা করতাম। কিন্তু এই পুড়ে যাওয়া লঞ্চের অপেক্ষায়ও ছিলেন কেউ কেউ। কারো স্বজন হয়তো অনেকদিন পরে বাড়ি ফিরছিলেন। যাত্রীদের মধ্যে কারো বাড়ি ফেরায় হয়তো খুব তাড়া ছিল। কেউ মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন, কেউ স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে। কেউ হয়তো ভেবেছিলেন ঘুম ভেঙেই দেখবেন- বরগুনা ঘাটে পৌঁছে গেছে লঞ্চ। কারো হয়তো মালপত্র নিয়ে নামার কথা ছিল কাকচিড়া, কালিকাবাড়ি, বামনা, বেতাগী অথবা কাঁঠালিয়া ঘাটে। কিন্তু সবকিছুই যেন এলোমেলো হয়ে গেল। যাত্রীদের কারো কোনো গন্তব্যে লঞ্চ না ভিড়ে হতভাগ্য লঞ্চটি কূল খুঁজলো দিয়াকুলে, সুগন্ধা পাড়ের দিয়াকূল গ্রামে। যেখানে লঞ্চের কোনো যাত্রীর গন্তব্য ছিল না। কুয়াশা ঢাকা শীতের ভোরে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না দিয়াকুল গ্রাম। এক অনাকাঙ্খিত আকস্মিকতায় ঘুম ভাঙল দিয়াকুলের। গ্রামবাসী ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিপদাপন্ন মানুষ উদ্ধারে।

লঞ্চে আগুন লাগার ঘটনায় হতবাক দেশবাসী। লঞ্চডুবির ঘটনার চেয়ে এটা অনেক ভয়াবহ! এ যেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই হতভাগ্য নাবিকের গল্প। যে সমুদ্রে অভিশপ্ত জীবন নিয়ে ভেসে ভেড়াচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এক ফোঁটা খাবার পানির জন্য তার হাহাকার পাঠকের মন ভিজিয়ে দিচ্ছে। চারপাশে থইথই সমুদ্র। অথচ লোনা হওয়ায় এই পানি সে পান করতে পারছে না। এও ঠিক এমনই হতভাগ্যদের গল্প। পানির উপরই পুড়ল লঞ্চ। সুগন্ধা নদীর মাঝখানে জ্বলন্ত লঞ্চটির ছবি প্রতিটি মানুষকে মর্মাহত করেছে। এ দৃশ্য দেখার মতো নয়। তবুও দেখতে হচ্ছে। বারবারই আমরা ভয়াবহ ঘটনাগুলোর মুখোমুখি হই এবং ঘটনার পরে একে অন্যের ওপরে দোষ চাপিয়ে নিজেরা মুক্ত থাকার চেষ্টা করি। লঞ্চে আগুন লাগার এই ঘটনা আমাদের চোখের সামনে আরো কয়েকটি লঞ্চ দুর্ঘটনার ছবি ফুটিয়ে তোলে।

বেসরকারি সংস্থা কোস্টট্রাস্ট নৌ দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণা করছে। ওই সংস্থাটি বলছে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশের নৌপথে বড় ১২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে দেড় হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। তাদের তালিকা অনুযায়ী, গত বছর ২০২০ সালে ঢাকার পোস্তগোলাসংলগ্ন এলাকায় মর্নিং বার্ড নামে একটি লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৩ জন যাত্রী প্রাণ হারান। ২০১৪ সালের ৪ অগাস্ট আড়াইশো'র বেশি যাত্রী নিয়ে পদ্মা নদীতে ডুবেছিল পিনাক-৬ নামে একটি লঞ্চ। ওই লঞ্চটি তোলা সম্ভব হয়নি, এবং এর ধ্বংসাবশেষও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০০৩ সালের ৮ জুলাই ঢাকা থেকে ভোলার লালমোহনগামী এমভি নাসরিন-১ লঞ্চটি চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় ডুবে যায়। অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাইয়ের কারণে লঞ্চটির তলা ফেটে গিয়েছিল। ২০০২ সালের ৩ মে চাঁদপুরের ষাটনলসংলগ্ন মেঘনা নদীতে ডুবে যায় সালাহউদ্দিন-২ নামের যাত্রীবাহী লঞ্চ। ২০০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঈদুল আজহার রাতে চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ষাটনল এলাকায় মেঘনা নদীতে এমভি জলকপোত এবং এমভি রাজহংসী নামের দুটি যাত্রীবাহী লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে রাজহংসী লঞ্চটি পানিতে তলিয়ে যায়, সে সময় ওই লঞ্চের ১৬২ জন যাত্রী নিহত হয়েছিলেন। লঞ্চ দুর্ঘটনার তালিকা আরো লম্বা। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো মাত্র।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা এগুলো থেকে কোনো শিক্ষাই নেইনি। যে কারণে আবারো আমাদের সামনে এলো লঞ্চ দুর্ঘটনার খবর, মৃত্যুর খবর, পোড়া মানুষের খবর। আবারো আমাদের কানে এলো স্বজনহারা মানুষের আহাজারি। এ ধরনের প্রতিটি দুর্ঘটনার পরেই বাংলাদেশে নৌপথে নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে আসে। এটা নেই, ওটা নেই অথবা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, ইত্যাদি নানান চিত্র। এই শব্দগুলোই আমরা বারবার শুনি। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। বাংলাদেশের যাত্রী পরিবহন এবং মালামাল পরিবহনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই নৌপথের নিরাপত্তায় কতটা নজর রাখা হচ্ছে? লঞ্চ কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্বগুলো কতটা সঠিকভাবে পালন করছেন? প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল কতটা নিয়োগ হচ্ছে? লঞ্চ দুর্ঘটনা রোধে প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা কতটা আছে? এসব বিষয়ে আমাদের নজর দেওয়া খুব জরুরি। 

বাংলাদেশ যেমন নদীমাতৃক, বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল আরো বেশি নদীনির্ভর। শুধু বরগুনা নয়, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠিসহ বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের যাতায়াত নদীপথে। কিন্তু এই মানুষেরা ঝুঁকি নিয়েই নদীপথ পাড়ি দেন। লঞ্চের সঙ্গে লঞ্চের ধাক্কায়ও এখানে লঞ্চ ডুবে প্রাণ যায় যাত্রীর। ডুবো চরে লঞ্চের ধাক্কায় লঞ্চডুবিতেও যাত্রীর প্রাণ যায়। আবার ঝড়ের কবলে পড়ে লঞ্চ ডুবলেও জীবন দিয়ে তার খেসারত দিতে হয় যাত্রীদের। এবার আগুনে পুড়েও মরতে হলো যাত্রীদের। শেষ খবর পাওয়া অবধি ৩৭ জনের প্রাণহানীর খবর পাওয়া গেছে। এই সাইত্রিশটি মানুষ যেন আমাদের ব্যর্থতার প্রতিবাদ করে গেলেন নীরবে। দিয়াকুলে স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হলো বাতাস। কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়- দিয়াকুলে কূলহারা মানুষের আহাজারি কতদূর পৌঁছাবে?

লেখক: উপকূল অনুসন্ধানী সাংবাদিক
 

/তারা/ 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়