ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

২০২২: সম্ভাবনা আর প্রত্যাশার বছর

রাজন ভট্টাচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৮, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১  
২০২২: সম্ভাবনা আর প্রত্যাশার বছর

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে নতুন বছরের শুরু হতে পারে শৈত্যপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। ধীরে ধীরে কমতে পারে তাপমাত্রা। একাধিকবার তাপমাত্রা কমার মধ্য দিয়ে বিদায় নেবে শীত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার বাংলাদেশও।

এতো গেলো নতুন বছরের যাত্রা শুরুর কথা। সার্বিকভাবে পুরো বছর কেমন যাবে? কিংবা নাগরিক হিসেবে নতুন বছরে প্রত্যাশা কী? যদিও প্রতিবার ভালো কিছু পরিবর্তনের প্রত্যাশা থাকে সবার মধ্যেই। বছর শেষে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির জায়গা যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে পুরোপুরি সমন্বয় ঘটানো কঠিন। ফলে ২০২২  সালের সব আশা পূরণ হবে এমন ধারণা করে লাভ নেই। তবুও আশায় বসতি, আশায় বাঁচে মানুষ।

নতুন বছর বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ওমিক্রণ মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বলছে, করোনার ছোবলে প্রায় দুই কোটিরও বেশি মানুষ বেকার হয়েছে। বেকার থাকা বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা জরুরি। সেইসঙ্গে বিদেশে নতুন নতুন শ্রম বাজার খোলার বিকল্প নেই। এজন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। তাছাড়া সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫ করার দাবির বিষয়টি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়ার প্রত্যাশা এ প্রজন্মের তরুণদের।

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই- বৈশ্বিক রাজনীতির ছোবলে বাংলাদেশ। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দেশটিকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। শক্তিশালী বিভিন্ন রাষ্ট্রের মন রক্ষার বিষয়টিও গুরত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে রাজনীতি, অর্থনীতি, বিনিয়োগসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এর পরেও বলবো আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। কূনীতিকরা সব সময় সফল হতে পারছেন না। সেটি সব সময় সম্ভবও নয়, তারপরও প্রত্যাশা রয়েই যায়। কারণ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে প্রয়োজনীয় সম্পর্কের উন্নতি না হলে নানা দিক থেকে বেকায়দায় পড়তে হতে পারে। সাম্প্রতিক কালের একটি উদাহরণ দেই-

‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের ১০ তারিখে  মার্কিন অর্থ দপ্তরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ খবর প্রকাশ করা হয়। এই সংকট সমাধানে সরকার পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। যদিও কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কিছু জানায়নি। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার এ প্রসঙ্গে বলছেন, এই নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের উপর কোনো প্রভাব পড়বে না।

বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক দিয়েই এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করা বাংলাদেশী শ্রমিকরা নানাভাবে কষ্টে আছেন। রেমিটেন্স কারিগরদের সুখ-দুঃখের কথা আরো বেশি সরকারকে ভাবতে হবে। তারা যদি ভালো পরিবেশ না পায় তবে কাজেও মন বসবে না। আয় কমবে। যার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। সেইসঙ্গে অর্থ পাচার রোধে নিতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা।

পৌষ-মাঘ শীতের মধ্যেই শুরু হবে বোরো আবাদের মৌসুম। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বৈশাখে মুখর হয়ে উঠবে গ্রামবাংলা। উদ্বেগের বিষয় হলো এবার বোরো মৌসুমে কৃষকের বাড়তি খরচ। তেলের দাম বাড়ায় সার, তেলসহ সব রকমের কৃষি পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই সামনের মৌসুমে কৃষকদের সরকারের পক্ষ থেকে আরো বেশি প্রণোদনা দেওয়ার বিকল্প নেই।

বৈশ্বিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দূষণের তালিকায় শীর্ষস্থানে ঢাকার সঙ্গে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা। ঢাকায় বায়ুদূষণের উপাদান অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম- ২.৫ এর উপস্থিতি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে প্রায় ২৭ গুণ বেশি। সব মিলিয়ে দূষণের ঝুঁকি কমাতে জরুরিভিত্তিতে সরকারি উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়ন করা না হলে আগামী বছর শুকনো মৌসুমে আবারো ঢাকাকে দূষণের তালিকায় হয়তো শীর্ষে দেখা যাবে। এটি কাম্য নয়।

গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। সরকারের শত প্রচেষ্টার ফলেও এ বিষয়ে সুখবর মিলছে না। প্রায় ১৬ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে নিতে আন্তরিক নয় মিয়ানমার। বিশ্বের শক্তিশালি দেশগুলোও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এ নিয়ে কথা বলছে না। নিরুপায় হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংকট সমাধানে বিশ্ব নেতাদের সহযোগিতা কামনা করেছেন।

এদিকে গত ১৮ নভেম্বর রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার বিষয়ে ইসলামি সহযোগী সংস্থা (ওআইসি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) উপস্থাপিত একটি প্রস্তাব জাতিসংঘে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। ২০১৭ সালে সংকট শুরুর পর এই প্রথম রোহিঙ্গাবিষয়ক কোনো প্রস্তাব জাতিসংঘে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হলো। এটি আমাদের আশা দেখাচ্ছে। সব মিলিয়ে নতুন বছর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সুখবর মিলবে এটাই কামনা। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অনেকটাই ভারমুক্ত হয়ে পথ চলবে বলে বিশ্বাস।

বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক উত্তাপ শুরু হয়েছে। দল প্রধানের সুচিকিৎসা যতোটা না জরুরি তার চেয়ে বিএনপির অবস্থান জানান দেওয়া ও দল চাঙ্গা করার বিষয়টি ইতোমধ্যে তাদের কার্যক্রমে স্পষ্ট হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী আগামী ২০২৩ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। তাই ২০২২ সালে রাজনীতি আরো চাঙ্গা হবে একথা ধরেই নেওয়া যায়।

নতুন বছরের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। নতুন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। ইসি গঠন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে আবারো কোনো সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক তা কাম্য নয়। যদিও একটি কার্যকর ইসি গঠনে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছেন রাষ্ট্রপতি। বলা হচ্ছে, সার্চ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে নতুন ইসির পথচলা শুরু হবে। সংবিধান অনুযায়ী আইন করে ইসি গঠনের নিশ্চয়তা চান বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতারা।

রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে দেশ ও অর্থনীতি পিছিয়ে পড়ে। এমনিতেই করোনার কারণে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সুস্থির নয়। এর মধ্যে আবারো যদি রাজনৈতিক উত্তাপে শিক্ষা সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তাহলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চয়তার দিকে যাবে। আশাকরি নতুন বছরের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব রকমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মধ্য দিয়ে আবারো প্রাণ ফিরবে শিক্ষাঙ্গণে।

সবচেয়ে আশার কথা হলো, নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত যোগাযোগ খাতে সর্ববৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর কথা রয়েছে নতুন বছরের জুনে। সকল বাঁধা এড়িয়ে প্রকল্পটির শুভ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের সড়ক ও রেলপথ আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে। পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে অর্থনীতিতে আরো গতি ফিরবে এটাই প্রত্যাশা। আগামী বছরই মেট্রো রেল যুগে পা রাখছে দেশ। তেমনি দেশে প্রথমবারের মতো নির্মাণ হওয়া কর্ণফুলি টানেল উদ্বোধনের অপেক্ষায়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বাস র্যাপিড ট্রানজিট চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকা টাঙ্গাইল, ঢাকা-সিলেট ফোর লেন প্রকল্প। যোগাযোগ খাতে এসব প্রকল্প চালু সময়মতো করা গেলে বাংলাদেশ সত্যিই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে।

সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা নতুন বছর থেকে ঢাকাবাসী যানজটের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে থাকবে। একটি পরিকল্পিত ও উন্নত গণপরিবহণ ব্যবস্থার যুগে সবাইকে যুক্ত করা সম্ভব হবে। অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসীসহ সব অপরাধীদের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করবে সরকার। শিশুদের গ্যাং কালচারের অভিশাপ থেকে রক্ষায় সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেয়াও জরুরি। লাগাম টেনে ধরা হবে আমলাতন্ত্রের। জনস্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ক্ষমতা দেয়া হবে। রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনাও জরুরি।

শেষ কথা হলো, শত বছরের জন্য করা ‘ডেল্টা প্ল্যান’-এর কার্যক্রম চলমান থাকলে অনেক সম্ভাবনা আর প্রত্যাশার বছর হবে ২০২২।     

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়