ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পার্বত্য এলাকার আরো গভীরে 

ফেরদৌস জামান  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪২, ৬ জানুয়ারি ২০২২   আপডেট: ২০:২৯, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২
পার্বত্য এলাকার আরো গভীরে 

ঝিরির পরতে স্রোতের কলতান: দ্বিতীয় পর্ব

পানি পান বিরতি শেষে একটানা হাঁটার পর দৃশ্যমান হলো পাকা ধানের সোনালি পাহাড়। উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো পাহাড়ের গায়ে বয়ে চলেছে সুখের বাতাস। আবেগে জায়গাটির নাম দিয়ে ফেললাম- জুমনগর।

জুমনগরের মাঝ দিয়ে এগিয়ে গেছে সাঙ্গু-মাতামুহূরী সংরক্ষিত বনপথ। পথের ধারে ফুটে আছে লাল আর হলুদ বর্ণের ফুল। মুরং বা ম্রো জনগোষ্ঠী পুষ্পপ্রিয়। তারা জুমে ফসলের পাশাপাশি ফুলের চাষ করে। তাদের সমাজে অঙ্গসজ্জায় নরী-পুরুষ নির্বিশেষে ফুলের কদর আছে।

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে মুরংদের বসতি তুলনামূলক অগোছালো। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, তাদের জুম এবং জুমের ঘর সবচেয়ে পরিপাটি।

বেলা গড়িয়ে সূর্য ক্রমেই হেলে পড়ছে পাহাড়ের অপর পাশে। বাতাস বইছে ঝিরিঝিরি। ধানের শীষে বেজে উঠছে শনশন শব্দ। অমনি কে যেন মুখ দিয়ে মাত্র উচ্চারণ করল- আজকের রাতটা এখানে থেকে গেলে কেমন হয়? কি আশ্চর্য! চারপাশের আবহেও ঠিক একই কথার প্রতিধ্বনি। মুহূর্তে সেই প্রতিধ্বনির অনুরণন প্রত্যেকের অন্তর থেকে মুখে উচ্চারিত হলো- তবে তাই হোক, আজকের রাতের নিবাস এখানেই। 

ফুলগাছ ঘেরা জুমঘরটিই হলো আমাদের আশ্রয়স্থল। বৃক্ষকাণ্ডে খাঁজ কেটে বানানো সিঁড়ি জুড়ে দেয়া হয়েছে একটা মাচার ধারে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেই প্রশস্ত মাচা। অন্য প্রান্ত পাহাড়ের ঢাল পর্যন্ত প্রসারিত এবং অপর প্রান্তে ছাউনি দেয়া ঘর। ঘরের ভেতর দুইটি আলাদা ভাগ। দ্বিতীয় অংশের পাটাতন প্রথম অংশের তুলনায় খানিকটা উঁচু। প্রথম অংশে স্তূপ করে রাখা ধানের আঁটি এবং ফসল ভরা কয়েকটা বড় আকারের থুরং বা ভান্ড। ঘরের দ্বিতীয় অংশে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাথাটা একটু ঝুকে নেয়া জরুরি। এই কাজটি না করার দরুণ যা ঘটার তাই ঘটল এবং তা একমাত্র চন্দ্র বাদে বাকি তিনজনের ক্ষেত্রেই।

মাথাটা যখন চালের পাশিতে সজোরে ধাক্কা খেলো মনে হলো দুনিয়াদারী কেঁপে উঠল। হাত দিয়ে দেখি মুহূর্তেই মাথার চূড়া আলুর মতো ফুলে ওঠা সারা! জুমনগরজুড়ে ধানের ম ম সুগন্ধ। ঘরের ভেতর তার মাত্রা কয়েক গুণ বেশি। পার্বত্য অঞ্চলে ঘোরাঘুরির সুবাদে অনেক জনগোষ্ঠীর জুম ঘর দেখার সুযোগ ঘটেছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে দ্বিধা নেই অন্য সকলের তুলনায় মুরংদের ঘর অনেক বেশি শৈল্পিক এবং পরিপাটি। পাহাড়ে চলতে কোনোমতে একটা জুমঘর পেয়ে যাওয়া মানে থাকা খাওয়া নিয়ে আর চিন্তা নেই। সাধারণত প্রতিটি জুমঘরেই একটা পাতিল, খড়ি এবং কিছু পরিমাণ পানির মজুদ থাকে। অনেক সময় লবণ ও মরিচের মতো অতি প্রয়োজনীয় জিনিসও পাওয়া যায়। তা থেকে প্রয়োজন মাফিক ব্যবহার করলে চাষীরা কিছু মনে করে না। 

পাহাড়ের নিচে ক্ষুদ্র একটা ঝরনা। জুমনগরের পানির চাহিদা পূরণে তার ভূমিকা অনেক। সরু পথটা চলে গেছে একেবারে ঝরনার গোড়ায়। প্রশান্তিদায়ক একটা গোসলের পর ফিরে দেখি চন্দ্র রান্নার কাজ অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে। এবার তাকে গোসলে পাঠিয়ে রান্নায় হাত লাগালাম আমি আর নূর ভাই। সন্ধ্যার আগ দিয়েই রান্না হয়ে গেল- লাল চালের ভাত এবং পেঁয়াজ, মরিচ আর কোয়া কোয়া রসুন দিয়ে শুঁটকি মাছের ঝোল।    

রাতে হালকা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার কারণে পথ খানিকটা সিক্ত এবং কোনো কোনো জায়গায় পিচ্ছিল হয়ে আছে। খুব সকালে উঠে রওনা করে একটানে উপস্থিত হলাম দনপাড়া নামক আরেক মুরং বসতিতে। আমাদের পরবর্তী পথে মুরং ছাড়া অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর বসতি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। দন পাড়ার সমস্ত মানুষ জুমে গিয়েছে ধান কাটতে। বসতির শুরুতে ঢালু উঠান। আঁকাবাঁকা শিকড় বেরিয়ে পড়া অপুষ্ট গাছটার নিচে বিচরণ করছে কয়েকটা শুকনো শরীরের গরু এবং কিছু শূকর। খোঁজাখুঁজির পর একটি মাত্র ঘরে দুজন মানুষের দেখা মিলল। বৃদ্ধ দম্পতি সাত-আট মাসের ছোট্ট নাতনিকে দেখভাল করতে ঘরেই ছিলেন। 

শিশুটি আপন মনে উল্টেপাল্টে খেলায় ব্যস্ত। বৃদ্ধা কার্পাস তুলা থেকে সুতা প্রস্তুতে মনোযোগী আর বৃদ্ধ ব্যস্ত তার শখের পেশা বাঁশ এবং লাউ এর খোল দিয়ে বাদ্যযন্ত্র তৈরিতে। ঘরের খুঁটিতে শিকারের চিহ্নস্বরূপ ঝুলছে কয়েকটা হরিণের মাথা, যা তাদের ঐতিহ্যের অংশ। খাবার খেতে চাইলে সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। সেক্ষেত্রে রান্নাটা নিজেদেরকেই করে নিতে হলো। বিনিময়ে বিদায়ের সময় হাতে যা দিলাম তাতেই খুশি। 

বসতির নিচ দিয়ে বয়ে গেছে সরু একটা ঝিরি। ঝিরিপথে চলা তুলনামূলক সহজ এবং আরামদায়ক। শীতল পানির পরশে সারা শরীরে খেলে যায় প্রশান্তি। খাল, পথ পেরিয়ে পাহাড়ে উঠতে শুরু করতেই চড়া রোদ উঠে গেল। আমাদের পরবর্তী বসতি ধাংপাড়া। বসতিজুড়ে বিরাজ করছে ভুতুরে নীরবতা। মানুষ তো দূরের কথা কোনো প্রাণিরও দেখা পেলাম না।

ধাংপাড়া পেরিয়ে আবারও ঝিরি। বৃষ্টি শুরু হওয়ায় প্রশান্তির ঝিরিপথ হয়ে উঠল অশান্তির কারণ। কাক ভেজা হয়ে উপস্থিত হলাম রাইপাড়ায়। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য যেহেতু খদপাড়া, সেহেতু ঝিরিপথ ধরে যেতে পারলে পরিশ্রম অনেকটা লাঘব হয় কিন্তু সে পথে যাওয়া অসম্ভব। কারণ একটু পরেই সেনাক্যাম্প। পার্বত্য এলাকার গভীরে বাঙালি প্রবেশের অনুমতি নেই। সুতরাং তাদের হাতে ধরা পড়ার অর্থ অবধারিতভাবে ফিরে আসা। উপায় না দেখে স্থানীয়দের পরামর্শক্রমে কঠিন পথেই এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো।

বসতির পেছনে একটা খাড়া পাহাড়। উঠতে হবে একেবারে চূড়ায়। এক ঘণ্টা পর বৃষ্টি থেমে গেলে পথে নামলাম পুনরায়। উপরে আরোহণের পর জঙ্গল মাড়িয়ে যখন একটু ফাঁকা পেলাম তখন মুখের সামনে হাজির হলো আরেক দৈত্যাকৃতির পাহাড়। পাথুরে দেয়ালে ছোট ছোট গর্তে পা রেখে কোনোমতে উপরে ওঠার ব্যবস্থা। এমন খাড়া পথের সবচেয়ে বড় ঝুকি হলো পিঠের ব্যাগ, ওজন একটু বেশি হয়ে থাকলে শুধু পেছনের দিকে টানতে থাকে। সামান্য এদিক-সেদিক হওয়া মানে চিৎ হয়ে নিচে পড়ে একেবারে অক্কা পাওয়া। 

পাহাড়টার নাম ‘রিভ পাহাড়’ কেন হলো জানি না। শুধু এতটুকু জানতে পারলাম বাকি পথের অনেকটাই তার পিঠের উপর দিয়ে এগিয়েছে। আরোহণের পর চারপাশের দৃশ্য দেখে দুচোখ ভরে গেল। পেছনে ক্রিস এবং রাং পাহাড় আর দক্ষিণে মিরি রেঞ্জ এর বুতং পাহাড়। সামনে ছোটবড় অজস্র পাহাড় পেরিয়ে সীমান্তের ওপারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কালো কুচকুচে এক পর্বতশ্রেণী। কি তার নাম, কি তার পরিচয় কিছুই জানি না। এমনিতেই এসব পাহাড় পর্বতের নামধাম মুখস্থ করা অথবা মাপাজোকে  আমার আগ্রহের পরিমাণ শূন্য। তার উপর দিয়ে সীমান্তের ওপারের পাহাড়। 

আমার দুই সহযাত্রীর এসবে আবার বেশ মুন্সিয়ানা। সুতরাং, দুচার লাইন আমার যা জানা তার পুরোটাই তাদের অবদান। রিভ পাহাড়ের উপর হাতে গোনা কয়েকটা মাতৃবৃক্ষ, তার নিচে শীতল ছায়া। বাতাসও বইতে থাকল তার আপন খেয়ালে। শরীর যেন ছেড়ে দিলো। বিরতির ফাঁকে সহযাত্রীদ্বয় লেগে পড়লেন পাহাড় অধ্যয়নে। আর আমি নির্বাক শ্রোতা হয়ে তাকিয়ে থাকলাম দিগন্তের পানে। অধিকাংশ পাহাড়ই জঙ্গলশূন্য, নকশার মতো ফুটে আছে অগনিত জুম। কোনোটাতে পাকা ধান, কোনোটাতে আধাপাকা আবার কোনোটা পরিত্যাক্ত হয়ে। (চলবে)

 

পড়ুন সূচনা পর্ব: দুর্গম পথে খরস্রোতা খালের বাঁকে 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়