ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

করোনা রুখতে নির্দেশনা কিন্তু বাস মালিকদের রুধিবে কে

রাজন ভট্টাচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৪৮, ১৩ জানুয়ারি ২০২২   আপডেট: ২০:০৭, ১৩ জানুয়ারি ২০২২
করোনা রুখতে নির্দেশনা কিন্তু বাস মালিকদের রুধিবে কে

করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট অমিক্রন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। বিশ্বের অন্যান্য দেশও অমিক্রনে আক্রান্ত। এ নিয়ে দুনিয়াজুড়ে নতুন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই অমিক্রন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। করোনা রোগীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি নতুন এই ভেরিয়েন্টে আক্রান্তের খবরও মিলছে একের পর এক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে একটু আগেভাগেই সরকারের পক্ষ থেকে সতর্ক অবস্থান নেয়ার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।

এই ধারাবাহিকতায় আজ বৃহস্পতিবার থেকে সরকার ঘোষিত ১১ দফা বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ি সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সভা সমাবেশ বন্ধ থাকবে। সেইসঙ্গে সবাইকে সব জায়গায় মাস্ক পরতে হবে। যদি কেউ না পরেন, তাহলে তাকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা হবে এবং জেল পর্যন্ত হতে পারে। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিধিনিষেধের আওতায় আনা হয়েছে গণপরিবহন। সংক্রামক ব্যাধি সাধারণত গণপরিবহন থেকেই বেশি ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। সড়কপথে চলা গণপরিবহনে কী ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে এজন্য গত বুধবার রাতে পাঁচদফা নির্দেশনা জারি করেছে পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিআরটিএ। 

ইতোমধ্যে রেল কর্তৃপক্ষ ভাড়া না বাড়িয়ে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ট্রেন পরিচালনা করার ঘোষণা দিয়েছে। রেল মন্ত্রণালয়ের এ রকম ঘোষণার ব্যতিক্রম হবে না এ ব্যাপারে আশ্বস্ত সবাই। সংকট সড়ক ও নৌ-পথে। সড়কপথের বিষয়ে বুধবার বিআরটিএ কার্যালয়ে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বাস ভাড়া না বাড়ানো ও অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কথা হলো নৌ ও সড়ক পথ পুরোপুরি বেসরকারী পরিবহন মালিকদের নিয়ন্ত্রণে। তাই মালিকপক্ষের সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা না করে গণপরিবহনে কতোটুকু স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা যাবে- এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। কেননা এ বিষয়ে আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। তাছাড়া গণপরিবহন মালিকরা যে কথা রাখেন না- এটি অতীতে দেখা গেছে। আগেও আমরা দেখেছি, করোনার কারণে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ৬০ ভাগ ভাড়ায় পরিবহন চলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তখন নগর পরিবহন থেকে শুরু করে আন্তঃজেলার বেশিরভাগ রুটে শতভাগ ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। যাত্রীদের রীতিমতো জিম্মি করে পকেট কাটা হয়েছে। ধারাবাহিক এই অপরাধের কিন্তু প্রতিকার হয়নি। 

এই কিছুদিন আগেও দেখা গেছে, তেলের দাম বৃদ্ধির পর সরকার নির্ধারিত ভাড়ার কেউ তোয়াক্কা করছে না! ইচ্ছেমত যাত্রীদের থেকে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারী নির্দেশনা কাগজে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। বিআরটিএ অবশ্য অভিযান চলিয়েছে। তখন বাড়তি ভাড়া নেয়ার প্রমাণ মিলেছে। বারবার একই পরিবহন কোম্পানির বিরুদ্ধে বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রামাণ পেয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু সেই কোম্পানির বাসের কি রুট পারমিট বাতিল করা হয়েছে? একজন মালিককে কি জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়েছে? মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারেনি বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। একই চিত্র নৌ পরিবহন সেক্টরেও। 

জ্বালানী তেলের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে বাস ভাড়া বৃদ্ধির পর ওয়েবিল বন্ধের দাবিতে বাস চালানো বন্ধ করেছিল শ্রমিকরা। এতেও কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। পিছু হটেনি মালিকপক্ষ। ওয়েবিল ঠিক রাখতে বাধ্য করিয়েছে তারা। তখন গণপরিবহনের ব্যয় মেটাতে না পেরে শ্রমিকরা শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নিতে রাজি হয়নি। এ নিয়ে বাধে বিপত্তি। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় মাসব্যাপী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছাত্র আন্দোলন হয়েছে। ঘটেছে সহিংস ঘটনাও। তীব্র হয়েছে জনদুর্ভোগ। শেষ পর্যন্ত মালিকপক্ষ হাফ ভাড়ায় শিক্ষার্থী পরিবহনে রাজি হলেও ওয়েবিল ঠিকই আছে। এতে লস হয়েছে শ্রমিকদের। আর বাড়তি ভাড়া যাচ্ছে যাত্রীদের পকেট থেকেই। এ যেন গা সয়ে যাওয়ার পুরনো অভ্যাস।  

সরকারী নির্দেশনা মেনে আগামী শনিবার থেকে অর্ধেক আসন খালি রেখে গণপরিবহন চলবে- এমনটাই সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ আজ বিকেলে জানা গেল বাসে যত আসন তত যাত্রী নিয়েই বাস চলবে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত নেয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন! এমন একটা আশঙ্কা থেকেই লেখাটি শুরু করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো। নির্দেশনায় আরো আছে, চালক ও হেলপারের অবশ্যই করোনা টিকা নেয়ার সনদ থাকতে হবে। বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে এগুলোসহ পাঁচদফা নতুন নির্দেশনা জারির পর বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, ৯৫ ভাগ চালক-শ্রমিক এখনও টিকা নেননি। তাহলে বাস চালাবে কে? অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে এ নির্দেশনা মেনে রাজধানীতে গণপরিবহন চালানো সম্ভব নয়। ফলে এরও বাস্তবায়ন হবে না। আবার বাস্তবায়ন করতে গেলে বেঁকে বসতে পারেন মালিক-শ্রমিকপক্ষ। এ যেন উভয়সঙ্কট।   

সরকারকে জিম্মি করে পরিবহন মালিকদের দাবি আদায় এ দেশে নতুন কিছু নয়। শেষ পর্যন্ত জনস্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকার তাদের দাবি দাওয়া পূরণ করতে বাধ্য হয়, এমনকি তাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা পর্যন্ত নিতে পারে না- এমনও আমরা দেখেছি। সরকারি নির্দেশনায় আরো রয়েছে, পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মাস্ক পরা ও বাসে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখা। গাড়ি পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখাসহ যানবাহনে জীবানুনাশক ছিটানো। সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে যাত্রী ওঠানামা করানো। 

করোনা রোধে বিআরটিএ যেসব নির্দেশনা দিয়েছে তা শতভাগ প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এই নির্দেশনার প্রতিটি স্তরে রয়েছে আপত্তির দেয়াল। এ নিয়ে যদি বাস পরিচালনায় বিআরটিএ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পদক্ষেপ নেয় তাহলে কৌশলে মালিকপক্ষ গাড়ি চালানো বন্ধের সুযোগ নিতে পারে। এজন্য প্রতিটি বাস টার্মিনালে টিকা নেয়ার বুথ চালু করা জরুরি। এতে যারা টিকা নেননি, তাদের দ্রুত টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে। এর বাইরে যে কটি নির্দেশনা রয়েছে সেগুলোও বাস্তবায়ন সহজ হবে। অবশ্য তার আগে মালিকপক্ষের সদিচ্ছা থাকতে হবে।

সরকারের উচিত জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া। তারা সেটি দিচ্ছে। করোনার মধ্যে বেকার হয়েছে প্রায় দুই কোটি মানুষ। আয় কমেছে অনেকের। বাস মালিকরা আবারও যেন ভাড়া বাড়ানোর সুযোগ না পায় সেদিকে কড়া লক্ষ্য রাখতে হবে। এ জন্য সরকারের উচিত বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া। যাতে কোনো কিছু পূঁজি করে পরিবহন মালিকরা ফায়দা লুটতে না পারে। আমরা ঘর পোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ আমাদের মনে ভয় জাগায়।   

লেখক: সাংবাদিক 
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়