ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

শাবিপ্রবিতে আন্দোলনের নেপথ‌্যে

মাসুদ আল রাজী, শাবিপ্রবি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২০, ১৭ জানুয়ারি ২০২২   আপডেট: ১৯:১৪, ১৭ জানুয়ারি ২০২২
শাবিপ্রবিতে আন্দোলনের নেপথ‌্যে

বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) মধ্যরাত। প্রচণ্ড শীতের মধ্যেই হঠাৎ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালযের বেগম সিরাজুন্নেসা হলের শিক্ষার্থীরা। শুরু করলেন বিক্ষোভ। হল থেকে বেরিয়ে এসে ক্যাম্পাসের গোলচত্বর এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। শতাধিক ছাত্রীর এই বিক্ষোভ দেখে হতভম্ব সবাই। কারণ, এর আগে কখনো এভাবে ছাত্রী বিক্ষোভ হয়নি। 

ছাত্রীদের দাবি ছিল হলের ভেতরে তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা হয় না। খাবারের মানও নিম্নমানের। নানাভাবে ছাত্রীদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। আর এসব করেন প্রভোস্ট নিজেই। তবে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানিয়েছেন, ছাত্রী হলে বিধিনিষেধ একটু বেশি। নিয়ম হচ্ছে-রাত ১০টার আগেই সব ছাত্রীকে হলে ফিরতে হবে। কিন্তু দেখা যায় অনেক সময় ছাত্রীরা নির্ধারিত সময়ের পরে হলে ফেরে। এজন্য ভেতরে ঢুকতে হলে হল প্রভোস্টের অনুমতি নিতে হয়। আর এই অনুমতি নেওয়াকে কেন্দ্র করে ক্ষোভের জের ধরে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন। তাই ছাত্রীদের দাবি ছিল প্রভোস্টকে অপসারণ না করলে তারা হলে ফিরবে না। 

আরও পড়ুন-শাবিপ্রবি ভিসির পদত্যাগ দাবি শিক্ষার্থীদের, চলবে ভর্তি কার্যক্রম

রাত ৩টার দিকে ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমদের তরফ থেকে আসে খবর। দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে বিক্ষোভ ছেড়ে হলে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা। তার পরদিন শুক্রবার (১৪ জানুয়ারি) ছাত্রীদের ৭-৮ জনের একটি প্রতিনিধিদল ভিসির সঙ্গে দেখা করে লিখিত আকারে দাবিগুলো উত্থাপন করেন। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে ছিল বর্তমান প্রভোস্ট কমিটির পদত্যাগ, ছাত্রীবান্ধব নতুন প্রভোস্ট কমিটি নিয়োগ এবং হলের সব অব্যবস্থাপনা দূর করে সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। কিন্তু উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠক ফলপ্রসূ না হওয়ায় দুপুরের পর শিক্ষার্থীরা ফের আন্দোলন শুরু করেন।

সে দিন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব পান হলটির সহকারী প্রভোস্ট জোবেদা কনক খান। এরমধ্যে শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে হলটির প্রাধ্যক্ষ ও সহকারী প্রাধ্যক্ষদের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন আন্দোলনরত ছাত্রীরা। 

তিন দফা দাবি না মানায় শনিবার (১৫ জানুয়ারি) বিকাল ৫টার দিকে শতাধিক ছাত্রী হল থেকে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে অবস্থান নেন। এরপর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে প্রবেশের প্রধান রাস্তা ‘কিলো রোড’ অবরোধ করেন। এসময় ছাত্রীরা সড়কের চারপাশে প্ল‌্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে অবরোধ তৈরি করে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। 

এদিন সন্ধা ৭টার দিকে ছাত্রীদের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ হামলা করে। ওই হামলায় কয়েকজন আহত হন। ছাত্রীরা জানান, রাত ৭টা ৫ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা জহির উদ্দীন আহমেদ ও প্রক্টর আলমগীর কবির আন্দোলনরত ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন। তারা ছাত্রীদের রাস্তা থেকে সরে হলে যাওয়ার অনুরোধ জানান। এসময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও সেখানে আসেন। আন্দোলনকারী ছাত্রীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বাগবিতণ্ডা হয়। হঠাৎ করে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী ছাত্রীদের আন্দোলনের আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাম ছাত্রসংগঠনের কিছু কর্মী ও সাধারণ ছাত্রদের ওপর চড়াও হয়ে কিল-ঘুষি মারেন। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন।  

চলমান কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে আন্দোলনরত ছাত্রীরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। 

রোববার (১৬ জানুয়ারি) সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে অবস্থান নিয়ে ছাত্রীরা আগের দিনের মতো ফের সড়ক অবরোধ করেন। এসময় সংহতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যোগ দেন।

আন্দোলন শুরুর পর থেকে সিলেট শহর ও শহরতলির বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার সময় ৯টি বাস ছাত্রীরা কিলো সড়কে আটকে দেন। একই সময়ে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত গাড়িও শিক্ষার্থীরা ভেতরে ঢুকতে দেননি।

ওইদিন দুপুরে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে অবরুদ্ধ করে রাখেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। দুপুর পৌঁনে ৩টার দিকে তিনি উপাচার্য ভবন থেকে বের হয়ে ডিনদের এক সভায় যাওয়ার সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা দাবি করেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হঠাৎ করেই উপাচার্যকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা চালান। এসময় উপাচার্যের সঙ্গে থাকা কয়েকজন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী তাকে আগলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে নিয়ে যান।

বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ মো. আনোয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে শিক্ষক সমিতির নেতারা ও প্রক্টরিয়াল বডি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে আসেন। এসময় কোষাধ্যক্ষ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বলেন, ভেতরে অবরুদ্ধ থাকায় উপাচার্য অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে বাসায় নিয়ে যেতে হবে। তখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি মেনে নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। এসময় শিক্ষকদের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বাগবিতণ্ডা হয়।

পরে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদসহ শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পুলিশ মুক্ত করতে গেলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা পুলিশকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন। এর জেরে ধাক্কাধাক্কির একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ‌্য করে রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার সেল নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা করেন। এতে অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী আহত হন।

রাত সাড়ে ৮টার দিকে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ তার বাসভবনে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের আগামীকাল সোমবার (১৭ জানুয়ারি) দুপুর ১২টার মধ্যে হল ত্যাগ করতে হবে। এছাড়া বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ (লিজা) ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন। তার জায়গায় নতুন প্রাধ্যক্ষ হিসেবে অধ্যাপক নাজিয়া চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

পুলিশী হামলা ও ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণার ঘটনায় উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে সোমবার সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেন ও ক্যাম্পাসের ভেতরের বিভিন্ন রাস্তায় স্লোগান দিতে থাকেন। ধীরে ধীরে ওই মিছিলের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও জড়ো হন। তবে কিছু শিক্ষার্থীকে সকাল থেকেই হল ছাড়তে দেখা যায়।

আজ সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ মোহাম্মদ সামিউল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন সহকারী প্রাধ্যক্ষকে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। তারা হলের ভেতরে ঢুকলে শিক্ষার্থীরা বাইরে থেকে হলের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন।

শিক্ষার্থীদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হল বন্ধের যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটা বাতিল করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই হল বন্ধ করা যাবে না। এছাড়া দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ারও দাবি জানান তারা।

সার্বিক বিষয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, হল প্রভোস্ট বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। হলে খাবার, আসন, ওয়াইফাইসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে কিন্তু তারা সমাধান না করে আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। আমরা তিন দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলাম। প্রশাসন চাইলে মাত্র এক ঘণ্টায় এ দাবি মেনে নিতে পারতেন। কিন্তু তারা তা না করে আমাদের উপর ছাত্রলীগ ও পুলিশ দিয়ে গুলি চালিয়েছে। আমরা এই ভিসিকে আর চাই না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। শিক্ষক সমিতিসহ সব বিভাগের প্রধানেরা কর্মসূচিস্থলে উপস্থিত হয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সব দাবি মানার আশ্বাস দেন। তখন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সঙ্গে আপত্তিকর আচরণ করেন। এরপর উপাচার্য ভবনের সামনে গিয়ে উপাচার্যকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেন। উপাচার্যকে রক্ষা করতে গিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হামলায় শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আহত হয়েছেন। এতে আমরা খুবই মর্মাহত। ক্যাম্পাস এখন শান্ত রয়েছে। সবাই হল ছাড়ছে।’

/মাহি/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়