ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পর্যটকের নজর কাড়ে কক্সবাজারের যেসব স্থান 

তারেকুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ৬ মে ২০২২   আপডেট: ১৪:৪৭, ৬ মে ২০২২
পর্যটকের নজর কাড়ে কক্সবাজারের যেসব স্থান 

ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। কিন্তু সমুদ্র সৈকত ছাড়াও যে কক্সবাজারে ঘুরে বেড়ানোর মতো আরও দর্শনীয় জায়গা আছে, তা অনেকের অজানা। এসব দর্শনীয় স্থান পর্যটকের নজর কাড়ে।

রামু বৌদ্ধ বিহার
রামু বৌদ্ধ বিহার কক্সবাজার জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী বিহার। এটি রামু উপজেলায় অবস্থিত। পুরাকীর্তিসমৃদ্ধ রামুতে রয়েছে অনেক প্রাচীন বৌদ্ধ নিদর্শন। রামুতে সর্বমোট ৩৫টি বৌদ্ধ মন্দির ও জাদি রয়েছে। রামুর উত্তর মিঠাছড়ির পাহাড়চূড়ায় রয়েছে গৌতম বুদ্ধের ১০০ ফুট লম্বা সিংহশয্যা মূর্তি। আর মাত্র ২ কিলোমিটার অদূরেই কেন্দ্রীয় সীমাবিহার নতুন করে নির্মিত হয়েছে। কিছুটা দক্ষিণে এগিয়ে গেলেই রয়েছে নজরকাড়া লালচিং ও সাদাচিং বৌদ্ধ বিহার। এছাড়াও আশপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ছোট-বড় আরও  অনেক বৌদ্ধ বিহার।

এখানে দেখার মতো ঐতিহ্যবাহী ও উল্লেখযোগ্য মন্দির ও বিহারগুলো হলো উত্তর মিঠাছড়ি ১০০ ফুট বৌদ্ধ মূর্তি, রামু সীমা বিহার, লামার পাড়া বৌদ্ধ বিহার, রাংকূট বৌদ্ধ বিহার, শ্রী শ্রী রামকুট তীর্থ ধাম ও শ্রীকুল পুরাতন বৌদ্ধ বিহার ইত্যাদি। এছাড়া রামু রাবার বাগান ঘুরে মনটাকে আরও উৎফুল্ল ও বাড়তি আনন্দ দেওয়া যায়।

যেভাবে যাওয়া যায়:
কক্সবাজার শহর থেকে কাছে হওয়ায় পর্যটকরা সাধারণত কক্সবাজার এসে রামু বৌদ্ধ বিহার দেখতে যায়। সেখানে ঘুরতে যাওয়ার সহজ উপায় হলো রিজার্ভ গাড়ি নেওয়া। তাহলে জনপ্রিয় স্থানগুলো সহজেই ও অল্প সময়ে দেখা যাবে। ৪-৫ ঘণ্টা সময় নিয়ে গেলে মোটামুটি অনেকগুলো বৌদ্ধ বিহার ঘুরে দেখা যায়। কক্সবাজার থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা নিয়ে বৌদ্ধ বিহার থেকে অনায়াসে ঘুরে আসা যাবে। এ যানবাহনে রামু যাওয়ার জনপ্রতি ভাড়া ৪০ টাকা। রিজার্ভ নিয়ে গেলে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা লাগবে। সিএনজি চালিত অটোরিকশা ৫ জন অনায়াসে ভ্রমণ করা যায়।

আদিনাথ মন্দির
কক্সবাজারের মহেশখালীর গোরকঘাটার মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় আদিনাথ মন্দির অবস্থিত। সনাতন ধর্মালম্বীদের কাছে এই মন্দিরের রয়েছে আধ্যাত্মিক গুরুত্ব। হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবতা মহাদেবের নামানুসারে মন্দিরের নামকরণ করা হয়েছে আদিনাথ। এই মন্দির কমপ্লেক্সের ভেতরে রাখাইন বৌদ্ধ বিহার ও মসজিদ আছে। এজন্য অনেকে মন্দিরটিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক হিসাবে আখ্যায়িত করেন। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে শিব চতুর্দশী উপলক্ষে ১০/১৫ দিনব্যাপী মেলা বসে তখন হাজার হাজার দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে এখানে।

যেভাবে যাওয়া যায়:
কক্সবাজার শহর থেকে অটোরিকশা অথবা সিএনজি চালিত অটোরিকশা নিয়ে যেতে হবে কস্তুরাঘাট বা ৬ নম্বর জেটি ঘাট।  ঘাট থেকে জনপ্রতি ১০০ টাকা ভাড়ায় স্পিডবোট করে মহেশখালী ঘাটে যেতে হবে। স্পিডবোট রিজার্ভ নিলে ১০০০ টাকা নিবে। এতে ২০-৩০ মিনিট সময় সময় লাগবে।

ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক
কক্সবাজারের চকোরিয়া উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক। এটি শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্ক নামেও পরিচিত। ১৯৯৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে পশুপাখি মুক্ত অবস্থায় বিচরণ করে। এটি বাংলাদেশের প্রথম সাফারি পার্ক। এই সাফারি পার্ক দেখতে ছুটে আসে হাজার হাজার পর্যটক।

যেভাবে যাওয়া যায়:
কক্সবাজার থেকে সরাসরি ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে যাওয়া যায়। এতে প্রতি জন ৭০ টাকা করে ভাড়া লাগবে।  রিজার্ভে গেলে ২০০০-২৫০০ টাকা নিতে পারে।

সোনাদিয়া দ্বীপ
কক্সবাজারের আকর্ষণীয় স্থানসমূহের মধ্যে সোনাদিয়া দ্বীপ অন্যতম ম্যানগ্রোভ ও উপকূলীয় বনের সমন্বয়ে গঠিত দ্বীপ। কক্সবাজার গিয়ে এ দ্বীপে না গেলে ভ্রমণটা অপূর্ণ থেকে যায়। মহেশখালী উপজেলার প্রায় ৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের অপরূপ এক দ্বীপ হলো সোনাদিয়া। এটি সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ও মহেশখালী দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত।

তিনদিকে নীল সাগর, লাল কাঁকড়া, কেয়া বন, সব মিলিয়ে সোনাদিয়া দ্বীপ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ধারণ করেছে।
বিভিন্ন অতিথি পাখি ও জলচর পাখিরও দেখা মিলবে সোনাদিয়া দ্বীপ। পর্যটকরা সূর্যাস্ত দেখতে পারে এখানে। চাঁদনি রাতে ক্যাম্পিংয়ের জন্য সেরা একটি জায়গা সোনাদিয়া দ্বীপ। সোনাদিয়া দ্বীপ দেশের প্রধান শুটকি মাছ উৎপাদন কেন্দ্র। শীতে হাজার হাজার জেলে ঘাঁটি গেড়ে মাছ শুটকি বানানোর জন্য শুকাতে দেয় এই দ্বীপে। মাছ শুকানোর জন্য বিখ্যাত সোনাদিয়া দ্বীপ। 

যেভাবে যাওয়া যায়:
কক্সবাজার কস্তুরী ঘাট থেকে স্পিডবোট বা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে যাওয়া যায়। মহেশখালী ঘুরেও যাওয়া যায় এবং শহর থেকে সরাসরি বোট রিজার্ভ করেও যাওয়া যায়। তবে বেশিরভাগই শহর থেকে সরাসরি যায়। প্রথমে ৬ নম্বর ঘাটে আসতে হবে। তারপর সেখান থেকে স্পিডবোট বা ডেনিশবোট রিজার্ভ করে সোনাদিয়া যাওয়া যাবে। রিজার্ভ না হলে বোটগুলো যায় না। এক্ষেত্রে তারা ২৫০০-৩০০০ টাকা বা মৌসুম বুঝে আরেকটু বেশি চেয়ে নেয়। তবে মহেশখালী থেকে গেলে প্রথমে ভাড়া লাগবে প্রতি জন ৭৫ টাকা। মহেশখালী ঘাটে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১২-১৫ মিনিট। স্পিড বোটে চড়তে ভয় লাগলে কাঠের নৌকাতেও চড়তে পারেন। ভাড়া ৩০ টাকা। সময় লাগবে ৪৫-৫০ মিনিট।

মহেশখালী ঘাটে নেমে রিকশা নিয়ে চলে যেতে হবে গোরকঘাটা বাজারে। ভাড়া ২০ টাকা। এরপর যেতে হবে ঘটিভাঙ্গায়, মহেশখালীর গোরকঘাটা থেকে ঘটিভাঙার দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার। ৩-৪ জন হলে একটা সিএনজি চালিত অটোরিকশা নিয়ে ঘটিভাঙ্গা যাওয়া যায়। ভাড়া ১৫০-১৭০ টাকা।

সেখান থেকে আবার ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে সোনাদ্বিয়া দ্বীপে যেতে হয়। ঘটিভাঙ্গা নেমে খেয়া নৌকায় সোনাদিয়া চ্যানেল পার হলেই সোনাদিয়া দ্বীপ।

মাথিনের কূপ
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার নাফ নদীর কূলঘেঁষে টেকনাফ থানা চত্বরে মাথিনের কূপ অবস্থিত। আঠারো শতকের শেষ ভাগে টেকনাফে পানির অভাবের পুরণের জন্য মাত্র একটি সুপেয় পানির কূপ ছিল। থানা প্রাঙ্গণের এক কূপ হতে রাখাইন তরুণীরা প্রতিদিন জল নিতে আসতো। পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য কলকাতা থেকে এই থানায় বদলি হয়ে আসেন। সবার সাথে রাখাইন জমিদার কন্যা মাথিনও এখান থেকে জল নেওয়ার জন্য আসতো। ঘটনাচক্রে ধীরাজের সাথে মাথিনের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং দুজনে বিয়ে করার সিন্ধান্ত নেন। কিন্তু হঠাৎ করেই ধীরাজের বাবার অসুস্থতার খবর আসে। তাই ধীরাজ কলকাতায় ফিরে যেতে চান কিন্তু মাথিন তাকে যেতে বাধা দেয়। মাথিনের মনে ভয় ছিল হয়তো ধীরাজ কলকাতা থেকে আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু ধীরাজ মাথিনকে না জানিয়ে কলকাতা চলে যান।  ভালোবাসার প্রিয় মানুষটা চলে যাবার পর দীর্ঘ সময় প্রহর গুনতে গুনতে অনিদ্রা আর অনাহারে নিজের সুন্দর জীবনকে চিরতরে বিসর্জন দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রাখাইন জমিদার কন্যা মাথিন।

ধীরাজ ও মাথিনের প্রেমের নিদর্শনটিকে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন সংরক্ষণ করে মাথিনের কূপ নামকরণ করেন। টেকনাফ গেলে এই কূপ না দেখে আসেন এমন পর্যটক খুবই কম আছে। এই কূপের পাশে ধীরাজের ভাস্কর্য ও প্রেমকাহিনির দেয়ালিকা রয়েছে। এটি দেখতে পর্যটকরা ভিড় জমায়।

যেভাবে যাওয়া যাবে:
কক্সবাজার থেকে মাথিনের কূপ দেখতে যাওয়া যাবে।  শ্রেণি ভেদে বিভিন্ন যানবাহনের সিট ভাড়া ১২০-১৪০ টাকা। 
তবে চাঁদের গাড়িতে রিজার্ভ করে ২৫০০-৩০০০ টাকা ভাড়া দিয়ে মাথিন কূপ দেখে আসা যাবে।  কক্সবাজার থেকে লোকাল বাসে, জীপ বা সিএনজিতে করেও টেকনাফ যাওয়া যায়।

ন্যাচার পার্ক টেকনাফ
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়ার এলাকায় অবস্থিত ‘টেকনাফ ন্যাচার পার্ক’।  এটি টেকনাফ শহর থেকে ৯ কিলোমিটার উত্তরে শতবর্ষী পার্ক। এখানকার সবুজের সমারোহ পাহাড়ি পরিবেশ দেখলে যে কারো প্রাণ জুড়িয়ে যায়। প্রতি বছর পর্যটকরা ন্যাচার পার্ক দেখতে ভিড় করে। 

টেকনাফ শহর থেকে একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশা নিয়ে ২৫০ টাকার মধ্যে এ পার্কে যাওয়া যাবে।

মেরিনড্রাইভ 
কক্সবাজার-টেকনাফ দৃষ্টিনন্দন মেরিনড্রাইভ ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক, যা বঙ্গোপসাগর এর পাশ দিয়ে কক্সবাজারের কলাতলী সৈকত থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি বর্তমানে পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভসড়ক। ২০১৭ সালের ৬ মে এটি বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। এই সড়কের পশ্চিম পাশে বিশাল সমুদ্র আর পূর্বে পাহাড়। সমুদ্র আর পাহাড়ের মাঝে সরু বয়ে গেছে এই সড়ক। পর্যটকরা কক্সবাজার আসলে ছুটে যান মেরিনড্রাইভ সড়ক দেখতে। যেকোনো যানবাহনে ৮-১০ ঘণ্টার মধ্যে ঘুরে আসা যাবে ৮০ কিলোমিটারের এই সড়ক।

সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক
কক্সবাজারের টেকনাফে সমুদ্র সৈকতের পাড়ের সাবরাং এলাকায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণের কাজ চলমান। এই পার্কটি বাস্তবায়িত হলে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি ৩৯ হাজার পর্যটক এখানে সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। এখনো পর্যন্ত চলমান কাজ দেখতে পর্যটকরা ছুটে যান সাবরাং জিরো পয়েন্টে।

যেভাবে যাওয়া যায়:
টেকনাফ শহর কিংবা সরাসরি কক্সবাজার শহর থেকে মেরিনড্রাইভ হয়ে সাবরাং জিরো পয়েন্টে যাওয়া যায়। এতে চাঁদের গাড়ি ৩০০০-৩৫০০ টাকা রিজার্ভ ভাড়া নিতে পারে।

সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ছাড়াও ইনানী, পাটোয়ারটেক পাথর রানী বিচ, হিমছড়ি ঝর্না, বিনোদন পার্কসহ এই রকম আরও অনেক ছোট-বড় দেখার মতো জায়গা রয়েছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে। যেগুলো দেখে পর্যটকরা আনন্দ পায়। যেগুলো দর্শন করে মনের মাধুরী মিশিয়ে আর প্রিয়জনদের সাথে অবকাশ যাপনে চলে আসে সেই অপরূপ সৌন্দর্যের স্থানগুলোতে। এসব স্থানের জন্য কক্সবাজারকে প্রধান পর্যটন স্পট হিসেবে চিনে দেশের মানুষ।

/তারেকুর/সাইফ/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়