ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ঢুপি মঠ: দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া 

সুমন্ত গুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০২, ২৩ মে ২০২২   আপডেট: ১৪:১২, ২৩ মে ২০২২
ঢুপি মঠ: দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া 

আমি ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি সময় আর সুযোগের সংমিশ্রণে বেরিয়ে পড়ি অদেখা ভুবন দেখার নিমিত্তে।  করোনার সময় কোথাও ঘুরতে যেতে পারছিলাম না। যখন সুযোগ পেলাম তখন কি আর ঘরে বসে থাকা যায়। শনিবার অফিস বন্ধ তাই এই দিনটি বেছে নিলাম অদেখা ভুবন দেখার জন্য।

হাতের কাজ শেষ করে বের হতে হতে প্রায় সকাল দশটা। আমাদের তিন চাকার পাইলট লিলু ভাই এসে উপস্থিত। আকাশের মন একটু খারপ; উপেক্ষা করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বলাই হলো না- আমরা যাচ্ছি কোথায়? আমাদের আজকের গন্তব্য সিলেটের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ‘ঢুপি মঠ’।

আমার সহকর্মী রুহেল ভাইয়ের কাছ থেকে সন্ধান পাই ঢুপি মঠের। তিনি একবার কথায় কথায় বলছিলেন আপনি তো অনেক জায়গায় ঘুরতে যান, আমার এলাকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক ঢুপি মঠ ঘুরে দেখে আসতে পারেন। আমি বললাম কোথায়? তিনি বললেন, আপনি এই মঠের সামনে দিয়ে গিয়েছেন এটি নিশ্চিত করে বলতে পারি। কিন্তু না চেনার জন্য কখনো সেখানে দাঁড়ান নাই। আপনি নিশ্চয়ই  জাফলং বা ভারত ভ্রমণের সময় চলতি পথে রাস্তার মধ্যখানে প্রাচীন আমলের একটি দ্বি-চালা ঘর দেখেছেন। কিন্তু কখনো সেখানে দাঁড়ান নাই। 

আমি বললাম ঠিক বলেছেন। বেশ কয়েকবার এ পথে ভ্রমণ করেছি। কিন্তু কোনো দিন ঢুপি মঠ দর্শনের  সৌভাগ্য হয় নাই। আর সত্যি বলতে এই জায়গার প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস জানতাম না। যখন জানলাম তখন দেখার অগ্রহ আরো বেড়ে গেলো।  

আমরা চলছি বন্দরবাজার, টিলাগড় পেড়িয়ে। এদিকে আকাশ একটু একটু করে কান্না শুরু করেছে। আর পূব আকাশে মেঘের দল জটলা পাকিয়ে বসে আছে। লিলু ভাইকে বললাম একটু দ্রুত চালাতে। কারণ ঝুম বৃষ্টি এলো বলে। অল্প কিছু সময়ের ভেতর শুরু হলো বৃষ্টি। তিন চাকার বাহনে বসে আমরা বৃষ্টি বেশ উপভোগ করছিলাম। কিছু সময় পর মেঘালয়ের পাহাড়ের কোলে দেখা পেলাম রংধনুর। কিন্তু হরিপুর বাজারে এসে ঘটলো বিপত্তি। বৃষ্টির সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাস। আমাদের তিন চাকার বাহন এগুতেই পাড়ছিল না। হরিপুরের আশেপাশে হাওরবেষ্টিত হওয়ার জন্য হয়তো এই বাতাসের বেগ এতো বেশি। 

না পাড়তে লুলু ভাই তিনচাকার বাহন একপাশে দাঁড় করাতে বাধ্য হলেন। প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর বাতাসের বেগ কমে এলো। আমরা আবার গন্তব্যপানে যাওয়া শুরু করলাম। ঘড়ির কাঁটায় তখন একটা। আমরা পা দিলাম আমাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে। তিন চাকার বাহন থেকে নেমেই আমরা জাফলং যাওয়ার পথে দ্বি-চালা যে ঘরটি দেখতে পেলাম সে  ঘরটির সামনে দাঁড়িয়ে এর কারুকাজ অবলোকন করলাম। দেখা পেলাম ঐ এলাকার প্রবীণ নিরুপমদার। তিনি বললেন, এই দুই চালার ঘরটি মূলত পান্থশালা। ঢুপি মঠ তৈরির সময় রাজকীয় পূণ্যার্থী ও অন্যান্য অতিথিদের জন্য এটি নির্মাণ করা হয়। সারিঘাটের পান্থশালার পূর্ব দিকে প্রায় একশ গজের মধ্যেই ঢুপি পাহাড় শুরু হয়ে পূর্ব দিকে চলে গেছে। সে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে ঢুপি মঠ যা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত।

আমরা এগিয়ে চললাম। দেখা পেলাম ‘রামেশ্বর শিব মন্দিরের’। জনমানব শূন্য স্থানে অবস্থান করছেন  মহাদেব। ধূপকাঠির মোহনীয় আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। আমরা কিছু সময় সেখানে অবস্থান করলাম। এরপর আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। এক দিকে হিমেল হাওয়া, অন্যদিকে বৃষ্টি হবার জন্য মাটির সোঁদা গন্ধ মন ভরিয়ে তুললো। নিরুপমদা বললেন, প্রবীণদের মতে, ওপরে মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাটি আগে খুব সুন্দর পাথর নির্মিত ছিল। আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম, স্বল্প সময়ের মাঝে পৌঁছে গেলাম পাহাড় চূড়ায়।

একটি গেইট দেখলাম। সম্ভবত এটি ছিল মঠে প্রবেশের ঐচ্ছিক কোনো দ্বার। গেইটটি চুন-সুরকির তৈরি । এর পাশেই ঝোপ-জঙ্গলে আবৃত একটি ঘর। আমরা এই প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখে মনে হচ্ছিল আগের দিনের মানুষ কত শৈল্পিক কাজ করতো। কিছু দূরে দেখতে পেলাম আরেকটি গেইট। এটি আগের গেইটের চেয়ে বেশ বড় কারুকার্যখচিত। এর পাশেই ভিটার ধ্বংসাবশেষ চারপাশে স্তূপাকারে পড়ে আছে। ধ্বংসাবশেষের কাছেই রয়েছে পাকা বাঁধানো একটি পানির কুপ। সেটির কাঠামো অবিকৃত থাকলেও এখন পরিত্যক্ত।

নিরুপম দাদা বলছিলেন- ‘রামেশ্বর শিব’ নামক শিবমূর্তি এখানেই স্থাপিত ছিল। শিব মূর্তির নিকটে একটি পাথরের ষাঁড়ও রক্ষিত ছিল। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মন্দিরের চূড়া ও বৃষটি বিচূর্ণ হয়ে যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রায় ২১৬ বছর পূর্বে জৈন্তিয়ার রাজা লক্ষ্মী সিংহের মৃত্যুর পর রাজা বিজয় সিংহের ভাগনে রাজা দ্বিতীয় রাম সিংহ ১৭৯০ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি নিত্যানন্দ গোস্বামীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং ঢুপি পাহাড়ের প্রায় চারশ ফুট উচ্চতায় সুচারুশিল্প খচিত এক উচ্চ চূড়াবিশিষ্ট মন্দির নির্মাণ করেন। ১৭৯৮ সালে সেখানে ‘রামেশ্বর শিব’ নামক শিবমূর্তি স্থাপন করেন। রাজা রামসিংহ মঠস্থ ‘রামেশ্বর’ শিবের সেবা পরিচালনার জন্য ‘রোকড়পুরী’ সন্ন্যাসী নামক জনৈক সন্ন্যাসীকে সেবায়েত নিযুক্ত করেন। 

রাজা তাঁর দীক্ষাগুরু নিত্যানন্দ গোস্বামীর উপদেশে বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেন এবং ১৮০৬ সালে মঠের নিকট ডৌডিক গ্রামে ‘রাধা গোবিন্দের’ যুগলমূর্তি স্থাপন করে গোস্বামীকেই অর্চনা কাজে নিয়োজিত করেন। রাজা দ্বিতীয় রাম সিংহ প্রায় ৪২ বছর অত্যন্ত নিরুদ্বেগে জৈন্তিয়া শাসন করেন এবং ১৮৩২ সালের নভেম্বর মাসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রামেশ্বর শিব স্থাপন ও জমি দানের জন্য লিখিত সে সময়ের তিনটি তাম্রলিপি পাওয়া যায়। সময় দ্রুত চলে যায় আমাদের শহর পানে ফিরে যাওয়ার সময় হলো। ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করে সামান্য সংস্কার করলে এই ঐতিহাসিক স্থাপনা পূণ্যার্থী ও দর্শকদের জন্য এক আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হতে পারে। 

যাবেন কীভাবে 

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ‘ঢুপি মঠ’ দেখতে হলে আপনাকে প্রথমে আসতে হবে সিলেট শহরে। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে অথবা বন্দরবাজার থেকে সিএনজি, লেগুনা করে চলে যেতে হবে প্রায় সারিঘাট। এখান থেকে ঢুপি মঠের দূরত্ব প্রায় ৩৭ কিলোমিটার।    
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়