ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কিংবদন্তি নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫০, ২ জুন ২০২২  
কিংবদন্তি নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ

তিনি কিংবদন্তী নাট্যকার। তিনি বহুমুখী প্রতিভার আধার। একাধারে তিনি নাট্য নির্দেশক, অভিনেতা, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গবেষক এবং ভাষা সংগ্রামী। তিনি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে পথিকৃৎ। তিনি মমতাজউদদীন আহমদ। 

অমর নাট্যকারের চতুর্থ প্রয়াণ দিবস আজ। ২০১৯ সালের ২ জুন আমাদের সাহিত্য ও নাট্যাঙ্গনের এই অনন্য মহীরুহকে আমরা হারিয়েছিলাম। 

পূর্ব পাকিস্তানের নাট্য আন্দোলন দিয়ে তার শুরু, এরপর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন- সব আন্দোলনেই তিনি প্রথম সারিতে ছিলেন। তিনি বাংলাদেশে নাটককে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। 

মমতাজউদদীন আহমদের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৮ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার হাবিবপুর থানার আইহো গ্রামে। তার বাবা কলিমুদ্দিন আহমদ ও মা সখিনা বেগম। মমতাজউদদীন আহমদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয় মালদহের আইহো জুনিয়র স্কুলে পাঁচ বছর বয়সে। তাদের পরিবার ছিলো নাট্যপ্রেমী ও সংস্কৃতিবান। তাদের পারিবারিক মঞ্চে থিয়েটার হতো। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে অনেকে শখের বশে অভিনয় করতেন। তার মামা, চাচা, ভাই সবাই অভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন।  মালদহ জেলায় জন্মগ্রহণ করলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলায় তার শৈশব অতিবাহিত করেন। মালদহ জেলায় জন্মগ্রহণ করলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলায় তার শৈশব অতিবাহিত করেন।  ২০১৯ সালের ২ জুন তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী নিজ জেলা ভোলাহাট উপজেলার নিজ গ্রামে তাকে দাফন করা করা হয়।

১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় তার মঞ্চ ও পথনাটকে অভিনয় শুরু। কিন্তু নাটক লেখা শুরু ১৯৬০ সালে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার লেখা প্রথম নাটক ‘বিবাহ'।  ১৯৬৪ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা শুরু। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানেই কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি লিখেন নাটক ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা' ও ‘এবারের সংগ্রাম'।

মুক্তিযুদ্ধের পর একে একে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের অধ্যাপনা করেছেন মমতাজউদদীন আহমদ। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন ছাত্রদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয়। ছাত্ররা তার ক্লাস মিস করতে চাইতো না। পরবর্তীতে ১৯৭৭-৮০ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক ছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ।

স্বাধীনতার এক যুগ পরে এসে তিনি লিখেন বিখ্যাত নাটক ‘সাতঘাটের কানাকড়ি'। এরপর ‘কী চাহ শঙ্খচিল' ও ‘রাজা অনুস্বরের পালা'। এ দুটি নাটক পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে তালিকাভুক্ত হয়েছিল।

লিখেন ‘ক্ষত বিক্ষত', ‘রঙ্গপঞ্চাদশ', ‘প্রেম বিবাহ সুটকেশ", ‘জমিদার দর্পণ', ‘হৃদয় ঘটিত ব্যাপার স্যাপার' এর মতো অসাধারণ সব নাটক। কেবল মঞ্চেই নয়, লিখেন টেলিভিশনের জন্যও। লিখেন ‘দখিনের জানালা’, ‘এই সেই কণ্ঠস্বর’, ‘সহচর’, ‘কূল নাই কিনার নাই’, 

হুমায়ূন আহমদের ’শঙ্খনীল কারাগার’ এ মতিন উদ্দিন চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়েছিল মমতাজউদদীন আহমদের। তানভীর মোকাম্মেলের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘তিস্তা নদীর পারে’ চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। কেবল অভিনয়ই না। চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন তিনি। হাছন রাজার জীবন ও কর্ম নিয়ে ২০০২ সালে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মিত ‘হাছন রাজা’ চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ তিনিই লিখেছিলেন, নিজে অভিনয়ও করেন।

মমতাজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন অসম্ভব ক্ষুরধার প্রাবন্ধিক, গবেষক। নিজের সমগ্র শিক্ষকতা জীবন, শিল্পকলা একাডেমিতে গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক, জাতিসংঘের বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী ও পরবর্তীতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নে বিশেষজ্ঞ থাকাকালীন সময়ে একদিনের জন্যও তার নিজস্ব গবেষণা থেমে থাকেনি। যেমন বহু মাত্রিক লেখক, ঠিক তেমনি নাট্য রচনা, নাট্য নির্দেশনার বাইরে নিজ দায়িত্বেই লিখেছেন বাংলাদেশের নাটকের ইতিবৃত্ত ও বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিবৃত্ত নামে দুটি অমূল্য গবেষণা। তার গদ্য রচনার সৃষ্টিও ছিল বিস্তৃত। চার্লি চ্যাপলিন-ভাঁড় নয় ভবঘুরে নয়, আমার ভিতরে আমি, জগতের যত মহাকাব্য, লাল সালু ও সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, মহানামা কাব্যের গদ্যরূপ, সাহসী অথচ সাহস্য, নেকাবী এবং অন্যগণ, জন্তুর ভিতর মানুষ' এর মতো বিশাল গদ্য ভাণ্ডার ছিল তার । ভাষা আন্দোলন নিয়ে তিনি লিখেছিলেন 'একুশ আমার বাংলা আমার', লিখেছিলেন শিশু সাহিত্য ও কিশোর রচনা, সরস রচনা। সজল তোমার ঠিকানা, এক যে জোড়া, এক যে মধুমতি’র মতো উপন্যাস তারই রচনা। ফেরদৌসির রচিত শাহনামাও তিনি অনুবাদ করেছিলেন।  

সমস্ত কিছুর বাইরে কেবল এক অতুলনীয় নাট্যকারের পরিচয়টিই তার সবার আগে আসে। বাংলা নাটকের এই কিংবদন্তি স্রষ্টার হাত ধরে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাটক প্রাণ ফিরে পেয়েছিলো। বাংলা নাটক যতোদিন থাকবে, এই বাংলা ভাষা থাকবে যতোদিন, এই বাংলাদেশ যতোকাল রবে, ততোদিন মমতাজউদদীন আহমদ চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

/টিপু/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়