ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি আক্রমণে নিহত সেনাদের সমাধিক্ষেত্রে

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৫, ১৩ জুন ২০২২  
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি আক্রমণে নিহত সেনাদের সমাধিক্ষেত্রে

পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাছ থেকেই জেনে নিলাম কোথায় গেলে জায়গাটার তত্ত্বাবধায়ক বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বরত কারও দেখা পাওয়া যাবে। পুরো এলাকায় প্রাথমিক একটা চক্কর দিয়ে অফিস কক্ষে গিয়ে দায়িত্বরত কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। আমাকে একটু বসতে বলে হাতের কাজ সেরে চেয়ার থেকে উঠে এলেন তত্ত্বাবধায়ক জনাব পল। কথা বলার এক পর্যায়ে এক পা দুই পা করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। 

ক্রানজি ওয়ার মেমোরিয়াল মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি আক্রমণে নিহত সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীর সদস্যদের সমাধিক্ষেত্র। সর্বপ্রথম তিনি আমাকে সৌধের কাছে নিয়ে গেলেন। মূল সৌধটি তেরো দেয়াল বা কলাম বিশিষ্ট। অর্থাৎ দশ-বারো ফুট অন্তর অন্তর পাশাপাশি তেরোটি দেয়াল। দেয়ালগুলোর উপরের ছাদ খানিকটা বিমানের পাখা আকৃতির। স্থাপনার ঠিক মাঝখানের দেয়াল তুলনামূলক চওড়া হয়ে ছাদ পেরিয়ে উঠে গিয়েছে উপরের দিকে। দেখতে সাবমেরিনের কনিং টাওয়ারের অনুরূপ। সৌধের নকশায় সেনা, নৌ এবং বিমান তিন বাহিনীর প্রতীকের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। 

তেরোটি দেয়াল দিয়ে সেনাবাহিনী, উপরের ছাদ দিয়ে বিমানবাহিনী এবং কনিং টাওয়ার দিয়ে নৌবাহিনীকে বুঝানো হয়েছে। দেয়ালের গায়ে খোদিত আছে পঁচিশ হাজার যোদ্ধার পদবিসহ নাম ও আনুমানিক মৃত্যু তারিখ, যারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে নিহত হয়েছিলেন। পল সাহেব জানালেন, ক্রানজি মেমোরিয়ালে সিঙ্গাপুর এবং মালয়ায় নিহত যোদ্ধাদের শেষ ঠিকানা। শুধু খ্রিস্টান নয় বরং মুসলিম, ইহুদী, হিন্দু, টাওয়িস্ট, বৌদ্ধ, কনফুসিয়ান, জৈন এবং শিখ ধর্ম বা মতাদর্শের মানুষও সমাহিত হয়েছেন। 
চমকপ্রদ তথ্য হলো তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশই তৎকালীন ইন্ডিয়ান। এমন একটা তথ্য পাওয়ার পর আমার খুব জানতে ইচ্ছা করলো, বাংলাদেশের কোনো যোদ্ধার কবর আছে কিনা? আর যদি থেকেও থাকে জনাব পল কি সেটা আমাকে দেখাতে পারবেন? সমাধির সারিগুলোর মাঝ দিয়ে হাঁটছি এবং একইসঙ্গে দুই কাজ করছি, পলের কথা শোনা ও ফলকগুলোতে নিবিড় নজর বুলিয়ে যাওয়া। যেন নিজেই নিজের কৌতূহলের সমাধান খুঁজে ফেরা। কথার একটা পর্যায়ে প্রশ্নটা তাকে করেই বসলাম। তিনি সুনির্দিষ্ট করে উত্তর দিতে পারলেন না। শুধু বললেন, এই সমাধিক্ষেত্রে শুয়ে আছেন ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, ইন্ডিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস এবং দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন ও মালয় যোদ্ধাগণ। তাদের মধ্যে আবার অনেকের দেহাবশেষ একাধিক জায়গা থেকে তুলে আনা হয়েছে। অধিকন্তু, স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের কোনো নিশ্চয়তা না পাওয়ায় ভিয়েতনামের সাইগন থেকেও কিছু দেহাবশেষ এখানে এনে রাখা হয়েছে। মোট ৪,৪৬১টি কবর আছে, যার প্রতিটিতে খোদিত আছে যোদ্ধার নাম, মৃত্যুর তারিখ ও পরিচিতিমূলক অন্যান্য কথা। তার মধ্যে ৮৫০টি কবরে শায়ীত যোদ্ধার পরিচয় এখনও অসনাক্ত রয়ে গিয়েছে। আর কোনোদিন সনাক্ত করা সম্ভব হবে বলেও তিনি মনে করনে না। এছাড়া, ৬১টি কবর আছে যেগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। সম্পূর্ণ জায়গাটার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশনের হাতে। 

অনেকটা সময় দেওয়ার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে জনাব পলকে ছেড়ে দিলাম। তারপর নিজেই ঘুরতে থাকলাম। সমস্ত ফলক ইংরেজি ভাষায় খোদিত। কিছু কিছু ফলকে উপরের লাইন হিন্দী বর্ণমালা দিয়ে শুরু। আবার কোনোটাতে আরবি ধরনের বর্ণমালা। তা ঠিক উর্দু, ফার্সি নাকি আরবি বুঝতে পারলাম না। বালাওয়াল খাঁন, ১৩তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রাইফেলস। মোহাম্মদ হানিফ, ১২তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট। নূর মোহাম্মদ, ২য় পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। তিনজনের প্রত্যেকেরই বয়স সতেরো, মৃত্যু হয়েছে ১৯৪৪ সালে ১৬ থেকে ২৪ অক্টোবরের মধ্যে। কতটা বয়সই বা হয়েছিল তাদের, কৈশর থেকে সবে যৌবনে পদার্পণ করেছেন। জীবনে মাত্র সতেরোটা বছর পেয়েছে। আপন পৃথিবীটাকে ঠিক মতো দেখেও নিতে পারেননি, এসে গেল যুদ্ধের ডাক। 

আহারে! কোথাকার ছেলে কোথায় এসে প্রাণবায়ু ত্যাগ করল! চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠল তিন তিনটি টগবগে যুবকের কাল্পনিক চেহারা। তীব্র রোদের ওয়ার মেমোরিয়ালের আকাশ ক্রমেই যেন বেদনার ভারাক্রান্ত মেঘে ঢেকে গেল। পা দুটো মাটি থেকে আর উঠতে চাইল না। সৌধের সিঁড়িতে অনেকটা সময় বসে থাকলাম। সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ল তখন আমার বেরিয়ে পড়ার সময় হলো। মূল প্রবেশদ্বারে বেদিটার কাছে এসে শেষ বারের মতো পিছু ফিরে তাকালাম এবং প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার মতো করে ভাবলাম- বিনিময়ে কি পেয়েছে এই পৃথিবী?

পা বাড়ালাম ফাঁকা মাঠের মধ্যে একাকি সমাধিটার দিকে। প্রথমে ধূসর তারপর খয়েরি রঙের পাথর দিয়ে মোড়ানো একটা সাদামাটা সমাধি। মাথার কাছে খোদাই করে লেখা ডাক্তার বেঞ্জামিন হেনরি শেরেজ। তিনি ছিলেন সিঙ্গাপুরের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। ভীষণ অনাড়ম্বর সমাধি। নেই অতিসজ্জা, নেই নিরাপত্তা বেষ্টনি বা রক্ষী। এমনকি দৃষ্টিসীমায় মানুষ পর্যন্ত নেই। সবুজ মাঠের মাঝ বরাবর এক প্রান্তে একটা সমাধি মাত্র। 

তোরণ পেরিয়ে ফিরতি পথে পা বাড়িয়েছি। সামান্য পথ অতিক্রম করতেই বাম পাশের বৃক্ষ সারির ফাঁক দিয়ে মানুষের অস্তিত্ব টের পেলাম। নিছক কৌতূহলের বশে বৃক্ষের ওপারে গিয়ে দেখি এক সারি নারিকেল গাছকে পিছনে রেখে একটা খোলা জমিন। তাতে পাঁচজন শ্রমিক কাজ করছে। দূর থেকে দেখে মনে হলো জমির আগাছা নির্মূল করছে। এগিয়ে যেতেই সবাই আমার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে পুনরায় কাজে মনোযোগী হলো। তাদের মাঝ থেকে আবিষ্কৃত হলো একজন বাংলাদেশি মানুষ। দেশে কাজ কাম নেই, থাকলেও পয়সা নেই। তার উপর দিয়ে কথায় কথায় বিপদ আপদ আর রাজনৈতিক হয়রানি তো লেগেই আছে। এই সমস্ত কারণে সিঙ্গাপুরে শ্রমিকের কাজ করছেন। মাস গেলে বাড়িতে আন্তত কয়টা টাকা পাঠাতে পারেন। মাথায় হ্যাট পরা শ্রমিকদের পায়ে এক জোড়া করে গামবুট। কাজ করছে ছোট ছোট নিচু চেয়ারে বসে। প্রথম দেখায় যা ধারণা করেছিলাম ঠিক তাই, তারা আগাছা নির্মূল করছে। সেটাই তাদের এক মাত্র কাজ। সাধারণত ফসলের ক্ষেত থেকে আগাছা হিসেবে ঘাস অপসারণ করা হয়ে থাকে কিন্তু এখানকার চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। ঘাসের ক্ষেত থেকে খুঁটে খুঁটে অন্যান্য গাছ অপসারণ করা হচ্ছে। অতি সাধারণ ঘাস, বাংলাদেশের মাঠেঘাটে যা হামেশাই বেড়ে উঠতে দেখা যায়। সিঙ্গাপুরে তার বেশ কদর। প্রতি বর্গফুট ঘাসের চাপড় স্থানীয় এক ডলার মূলে বিক্রি হয়। 

জায়গাটা মূলত ঘাসের খামার। তাদের লাঞ্চ হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগে। সুতরাং, আমাকে আপ্যায়ন করার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই। বাংলাদেশি ভাইটির আফসোসের অন্ত রইল না, কয়েক বছরের কর্মজীবনে এই প্রথম তার কর্মক্ষেত্রে কোনো দেশি মানুষ ভ্রমণ করতে এসেছে। অথচ, এক কাপ চা পর্যন্ত খাওয়াতে পারলেন না! পানির পাত্রটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম আপাতত এটা ভরে এনে দিলেই হবে। ব্যাগে থাকা খাবারগুলো তাদের নিয়ে ভাগ করে খেলাম। খাওয়া শেষে ঢকঢক করে পানি পান করে বললাম, এই দেখুন আপনার দেয়া পানিতে আমার পেট ভরে গিয়েছে। (চলবে)  
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়