ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

পাচার হওয়া বাংলাদেশিদের যাত্রা সাইপ্রাসে গিয়ে যেভাবে শেষ হয়

আন্তর্জাতিক ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৫৪, ২৮ জুন ২০২২   আপডেট: ২১:৫৬, ২৮ জুন ২০২২
পাচার হওয়া বাংলাদেশিদের যাত্রা সাইপ্রাসে গিয়ে যেভাবে শেষ হয়

দুই বাংলাদেশি অভিবাসী গত সপ্তাহে সাইপ্রাসের রাজধানী নিকোসিয়ার বাইরে পৌরনারা অভিবাসী অভ্যর্থনা শিবিরের প্রধান ফটকে মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কারণ ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত অভিবাসন প্রত্যাশীকে রাখা শিবিরটিতে তারা প্রবেশ করতে চাচ্ছিলেন।

বয়সে তরুণ দুজনকে ক্লান্ত ও ভীত দেখাচ্ছিল। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন সেলিম হোসেন,যার বয়স ২৪ বছর। কাগজপত্রের ঘাটতি থাকায় কর্তৃপক্ষ তাদেরকে শিবিরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না বলে তিনি জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভ্যালেকে জানিয়েছেন।

হোসেন বলেন, ‘আমাদের কোনো পাসপোর্ট নেই। বাংলাদেশি এক মানবপাচারকারী দ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলে পাঠানোর আগে উত্তর সাইপ্রাসে আমাদের কাছ থেকে সেগুলো নিয়ে গেছে।’

অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য পৌরনারা সাইপ্রাসের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির। এই শিবিরটি এক হাজার জনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এখানে প্রায় ২০০ বাংলাদেশিসহ প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি লোক অবস্থান করছে। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই সেখানে গুরুতর সমস্যার অভিযোগ করেছেন, যার মধ্যে প্রবল ভীড়, জঘন্য বাথরুম সুবিধা এবং স্বল্প খাদ্য ও জলের রেশন।

শিবিরটি সাম্প্রতিক পরিদর্শনের সময় সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট নিকোস আনাস্তাসিয়াদেস সেখানকার পরিস্থিতিকে ‘দুঃখজনক’ বলে বর্ণনা করেছেন।

হোসেন ও তার বন্ধু এনামুল হক জানান, উত্তর সাইপ্রাসের একটি আপেল খামারে কাজ করার আশায় তারা গত ৬ জুন ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করেন। দুবাই হয়ে ভ্রমণের জন্য প্রত্যেককে স্থানীয় মানবপাচারকারীকে প্রায় সাত হাজার ৩৬০ মার্কিন ডলার দিতে হয়েছিল। বাংলাদেশি এই মানবপাচারকারীদের সঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য পাচারকারীদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে।

হোসেন বলেন, ‘আমরা পর্যটন ভিসায় ঢাকা থেকে দুবাই গিয়েছিলাম। সেখানে দুই রাত কাটানোর পর পাচারকারীরা আমাদের তুরস্ক হয়ে উত্তর সাইপ্রাসে যেতে বলে। আমাদের তিনবার ফ্লাইট পরিবর্তন করতে হয়েছে এবং প্রতিটি ধাপে কিছু বাংলাদেশি এজেন্ট আমাদের সাহায্য করেছে।’

তিনি জানান, উত্তর সাইপ্রাসে, তাদের একটি নির্মাণ কোম্পানিতে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ওই প্রতিষ্ঠানটি উত্তর নিকোসিয়ার এরকান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে কাজ করছে।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা তারিক কাহরামান জানান, দুই বাংলাদেশি নাগরিক এবং আরেকজন পাকিস্তানি শ্রমিক কোম্পানিতে কাজ করতে এসেছিলেন কিন্তু কয়েকদিন আগে তারা নিখোঁজ হয়েছে।

গ্রিসের সঙ্গে অন্তর্ভূক্তি ইস্যুতে ৭০ এর দশকে দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল সাইপ্রাস। ১৯৭৪ সালে এ নিয়ে অভ্যুত্থান হলে উত্তর সাইপ্রাস দখল করে নেয় তুরস্ক। উত্তর ও দক্ষিণ সাইপ্রাসের মধ্যে ১৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ জাতিসংঘের বাফার জোন রয়েছে। শুধুমাত্র তুরস্ক উত্তরে তুর্কি সাইপ্রিয়ট সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। আর দক্ষিণে গ্রীক সাইপ্রিয়ট সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

সাইপ্রিয়ট সরকার জানিয়েছে, প্রায় ৯০ শতাংশ অভিবাসী তুরস্ক এবং বিচ্ছিন্ন তুর্কি সাইপ্রিয়ট দিয়ে শিক্ষার্থী ভিসার মাধ্যমে প্রবেশ করে। এরপর হাজার হাজার মানুষ জাতিসংঘের বাফার জোন অতিক্রম করে গ্রীক সাইপ্রিয়টে আশ্রয় চায়।

যেসব দেশের নাগরিকরা গ্রীক সাইপ্রাসে আশ্রয় চায় সেগুলোর প্রথম দশটির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর ছয় শতাধিক বাংলাদেশি আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছিলেন এবং এ বছর এখন পর্যন্ত আট শতাধিক আবেদন জমা পড়েছে। এই আবেদনগুলির প্রায় সবগুলোই সাধারণত প্রত্যাখ্যান করা হয়। কারণ বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ দেশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যার অর্থ সেখানকার লোকেরা সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক সুরক্ষার পাওয়ার যোগ্য নয়।

অনেক বাংলাদেশি অভিবাসী জানেন যে, তাদের আশ্রয়ের আবেদনের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও তারা আবেদন করেন। কারণ আশ্রয়ের আবেদনকারীদের তাদের আবেদন প্রক্রিয়াকরণের সময় কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাংলাদেশি-সাইপ্রিয়ট অভিবাসী পর্যবেক্ষক বলেন, ‘একজন আশ্রয়প্রার্থী তাদের আবেদনের প্রক্রিয়া চলাকালীন বেশ কয়েক বছর কাজ করতে পারে। একবার একটি আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হলে, তারা বারবার এর বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে। এটি তাদের দীর্ঘ সময়ের জন্য, প্রায় ৫ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশে কাজ করার সুযোগ দেয়।’

ডয়চে ভ্যালে কিরেনিয়া ও উত্তর নিকোসিয়ার মতো শহরে বসবাসকারী বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির সাথে কথা বলেছে। তারা জানিয়েছে, তারা স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কোম্পানির ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করছে। কিভাবে শত শত বাংলাদেশী যুবককে লাভজনক চাকরি ও উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই দেশে আসার জন্য প্রলুব্ধ করা হচ্ছে সেই বিবরণ তারা দিয়েছেন। উত্তর সাইপ্রাসে আসার পর এই বাংলাদেশি যুবকরা বাস্তবতা বুঝতে পারে এবং মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বিষয়টি টের পায়।

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়