ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

হায় উৎপল: এ কোন পাপের ফল?

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:১১, ২৯ জুন ২০২২   আপডেট: ১৭:৪০, ৩০ জুন ২০২২
হায় উৎপল: এ কোন পাপের ফল?

শান্তি আর অশান্তির মধ্যে এটাই তফাৎ। শান্তি শীতল বাতাসের মতো ধীরে বয়, অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। গত কিছুদিন; বলতে গেলে কয়েক বছর ধরেই দেশে ‘সংখ্যালঘু’ নামধারী হিন্দু নামধারীদের ওপর চলছে নির্যাতন। নির্যাতনের ধরন বদলে গেলেও টার্গেট গ্রুপ বদলায়নি। রসরাজ থেকে কপালের টিপ, এরপর এখন এটা নেমে এসেছে শিক্ষকদের ওপর।  

এর আগে শিক্ষকদের অনুভূতির নামে অত্যাচার বা তাদের বিপদে ফেলে অপমান করা হচ্ছিল। শ্যামলকান্তির কান ধরার সেই অপঘটনা এখনও খুব বেশি পুরনো হয়ে যায়নি। অনেকেরই স্মরণে থাকার কথা ওই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এমন আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে। এবং সেই ঘটনাগুলোর সর্বশেষ যেটা আমরা দেখলাম- বিজ্ঞান পড়ানোর অপরাধে কারাগারে গেলেন হৃদয় মন্ডল। 

তারপরও ঘটনা থামলো না। গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানো প্রিন্সিপাল স্বপন কুমার বিশ্বাসের ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ার ফাঁকেই ছাত্রের হাতে আহত আরেক শিক্ষক উৎপল সরকারের প্রাণ গেল ছাত্রের হাতে। এ নির্মমতা একদিনে বা একক কোনো ঘটনায় তৈরি হয়নি। এর পেছনে আছে সমাজ রাজনীতি ও মানুষের নীরবতা আর আপোসকামিতা। কি হয়েছিল সেদিন? খবর বলছে:

প্রতি বছরের মতো এবারও কলেজে মেয়েদের ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। শনিবার দুপুরে খেলা চলাকালে দশম শ্রেণির ওই ছাত্র ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে অতর্কিত শিক্ষক উৎপল সরকারের ওপর হামলা চালায়। প্রথমে ওই ছাত্র শিক্ষকের মাথায় আঘাত করে এবং পরে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকে। এ ছাড়া স্টাম্পের সুচালো অংশ দিয়ে পেটের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে। পরে শিক্ষকেরা এগিয়ে গেলে ওই ছাত্র সেখান থেকে সটকে পড়ে। গুরুতর আহত অবস্থায় উৎপল সরকারকে প্রথমে আশুলিয়া নারী ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়া হয়। আঘাত গুরুতর হওয়ায় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সোমবার ভোরে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ১০ বছর ধরে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে চাকরি করছিলেন উৎপল সরকার। প্রতিষ্ঠানটির শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। তাঁকে মারধরের অভিযোগ ওঠা শিক্ষার্থীর (১৬) বাড়ি আশুলিয়ায়। দশ বছর এক স্কুল এন্ড কলেজে কাজ করার পরও উৎপল ধরতে পারেননি নাড়ি। বুঝতে পারেননি সমাজের পচন কতোটা গভীরে চলে গেছে। হয়তো  ছাত্রটিকে তিনি শাসিয়েছিলেন, হয়তো শাস্তি দিয়েছিলেন; দিতেই পারেন। তিনি শিক্ষক, শাসনের অধিকার তার আছে। সবচেয়ে বড় কথা শাস্তি বা বিচার  শিক্ষাদান কিংবা পাঠের কোনো অংশ ছিল না। যেহেতু উৎপল ছিলেন শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি তিনি এ কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক। এবং নিঃসন্দেহে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীকে সংশোধন করা, তাকে অন্যায় থেকে বিরত রাখা। এই শাস্তি বা বিচারের মুখোমুখি আমরা সবাই হয়েছি। স্কুল কলেজে টিনএজ বয়সে আমাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। সে সময় আমরা সবাই অনভিজ্ঞতা, বুদ্ধির অপরিপক্কতায় ভুগি। আমাদের অভিভাবক তখন ঘরে যেমন মা-বাবা, বাইরে আমাদের শিক্ষক। সময়ের সিংহভাগ কাটে স্কুল কলেজে। আর আজকাল মোবাইল ও ডিজিটাল জগতে ঘরেও মানুষ একা। যে যার মতো মুখ গুঁজে মোবাইল  কিংবা অন্য কোনো মিডিয়ায়। মা-বাবা ভাইবোন সবাই আলাদা আলাদা জগতের বাসিন্দা। এমন সময়ে শিক্ষকরাই তো অভিভাবক। কিন্তু যে কোনো কারণে হোক জিতু নামের ছেলেটি তা মানেনি। তার আক্রোশ এমন আগ্রাসী ছিল যে উৎপল  বাঁচতেই পারেননি। জীবন কেড়ে নেওয়ার মতো এমন দানব তৈরি হচ্ছে ঘরে, এমন জন্তুর অধম আমরা লালন করছি সমাজে- এটাই ভয়ের ব্যাপার!

আজকাল কিশোর গ্যাং তরুণ গ্যাং নামে যে সব কথা শুনি তাদের নৃশংসতা আর আক্রমণের যেসব গল্প পড়ি তাতে এটা স্পষ্ট এরা নিয়ন্ত্রণহীন। কোথাও মাদক কোথাও সেক্স কোথাও ধর্মের নামে উস্কানী এদের মগজ ধোলাই করে রাখে। তখন এরা আর স্বাভাবিক মানুষ থাকে না। জিতু নামের ছেলেটিও ছিল না। এই অমানবিকতার উৎস খুঁজে বের করা না গেলে প্রবণতা থামানো যাবে না। আগামীতে আরো উৎপল প্রাণ হারালেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। সমাজের দিকে তাকালেই আপনি কতগুলো প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন। এই সমাজে এখন অল্প কিছু যুবক ছাড়া আর কেউ ক্রিকেট ফুটবল খেলে না। কেউ ‘খেলাঘর’ ‘কচি কাঁচার আসর’ কিংবা এমন কোনো সংগঠন করে না। সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে যোগাযোগ নাই কারো। আমরা এই বয়সে কবিতা লিখতাম। উপন্যাস পড়তাম। সিনেমা দেখে কান্নায় বুক ভাসাতাম। সে আনন্দ কেড়ে নিয়েছে আমাদের তথাকথিত ডিজিটাল মিডিয়া। মানুষের আবেগ আনন্দ উৎসাহ সব এখন পর্দামুখী। সে সুযোগে পর্দার দখল নিয়েছেন এমন কিছু মানুষ যারা ধর্মের ধ জানেন না। এরাই এখন বক্তা। এদের ফলোয়ার চলচ্চিত্র নায়ক নায়িকাদের চাইতেও বেশি। এদের কাজ নিয়মিত মগজ ধোলাই করা।  চাপা পড়ে গেছে সুফিবাদ। ফকির বাউলেরা দরগাহপ্রেমীরা আজ অতঙ্কে। আমি নিশ্চিত না জিতু উগ্রবাদের  খপ্পরে পড়েছিল কিনা। কিন্তু এটা নিশ্চিত পিটিয়ে মাস্টার বা শিক্ষক হত্যা করার মতো বিকৃত মানসিকতা সে কোনো না-কোনোভাবে পেয়ে গিয়েছিল । 

আমি ভাবতেই পারি না প্রকাশ্য দিবালোকে এক ছাত্র তার শিক্ষককে স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে চলেছে আর বাকীরা সবাই নীরব দর্শক! এমন তো না যে ছেলেটি রিভলবার বা পিস্তল দিয়ে গুলি করে পালিয়ে গেছে। মানুষের প্রাণ কি এতো সহজে যায়? সে পরিমাণ আঘাত করার মতো সময় কেন দেওয়া হয়েছিল তাকে? এটা কি আমাদের সমাজ পচনের আরেক ঈঙ্গিত? যেখানে এটা পরিষ্কার আপনি বা যে কেউ আক্রান্ত হলেও কেউ এগিয়ে আসবে না। এটা মনে হয় এখন সবাই সত্য বলে জানেন যে, বিপদে পড়লে সাহায্য পাওয়া অসম্ভব।

এই সাইড লাইন দর্শক হবার ব্যাপারটা আমাদের সমাজে নতুন। আগে মানুষ এমন কিছু দেখলেই ঝাপিয়ে পড়তো। এখন পড়ে না। কারণ সবাই জানে তার জানটি হারালে কেউ এগিয়ে আসবে না। সবাই এটাও মানে কাকে বাঁচানো ফরজ আর কাকে না বাঁচালেও অসুবিধা নাই। উৎপল চলে গেছে। রয়ে গেছে তার জননী। যিনি বলেন, ‘প্রতি রাইতেই আমার ব্যাটা ফোন কইরছে। আমগোরে খবর লিছে। এহুন শুনি ছেলে নাই...।’ কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধ মা গীতা রানী বাক্‌রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। এই আমাদের নিয়তি?

সরকার রাজনীতি বা অন্য কোন কিছুকে দোষারোপ করার আগে ভাবতে হবে সমাজের এই অধঃপতন কেন? কীভাবে এতটা নৃশংস আর হৃদয়হীন হয়ে গেছে আমাদের সন্তানেরা। আজ মাস্টার কাল অন্য কেউ হয়তো একদিন মা বাবাকেও এমন পিটিয়ে মারতেও দ্বিধা করবে না এসব ছাত্রেরা। তারপরও কেউ দায় এড়াতে পারেন না। না বিচার না আইন না সমাজ। সবকিছু যে ঠিক নাই কোথাও যে সাম্প্রদায়িকতা নৃশংসতা আর দানবীয় আচরণ এক হয়ে গেছে এটা এখন অন্ধও বুঝতে পারে। কবে ঘুরে দাঁড়াবে জাতি? না একের পর এক উৎপল দেখতে দেখতেই কালো সময় ঘিরে ধরবে সবকিছু?

সিডনি
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়