ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ঢাকঢোল ও শারদোৎসব

উৎপল দত্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫২, ১ অক্টোবর ২০২২   আপডেট: ১৬:৫৫, ১ অক্টোবর ২০২২
ঢাকঢোল ও শারদোৎসব

ছবি: ইন্টারনেট

ঢাকঢোল পেটাতে আমরা পছন্দ করি। 
প্রতিদিনের সংলাপ, কথা-কাব্য, ও ক্রিয়াকর্মে ঢাকঢোল আমাদের নিত্য অনুষঙ্গ। আমাদের যাপিতজীবন ঢাকঢোল ছাড়া প্রায় বিমাতার কোল। একটু অস্বস্তিকর এবং ম্যাড়ম্যাড়ে। জীবন জাদুহীন ও তরঙ্গরহিত হয়ে যায়। নিস্তরঙ্গ জীবন কেউ চায় না। অভিঘাত না থাকলে বেঁচে আছি কি নেই তাও বোধিকে স্পর্শ করে না। আমরা স্পর্শকাতর, অতি সংবেদনশীল, ফুলের ঘায়ে মুর্চ্ছা যাই তবু ঘাত-প্রতিঘাত ছাড়া জীবন আমাদের কল্পনার বাইরে। আটপৌরে জীবনে স্রোত থাকবে, ঢেউ উঠবে, ঝুপ করে এক ডুব দিয়ে উঠবো, খানিক ভেসে যাবো আবার ডাঙা হাতড়াবো– এরকম জীবন আমাদের কাম্য। না হলে জীবনের গতি, প্রবহমানতা বা স্পন্দন কিছুই থাকে না। স্পন্দনহীন জীবন আসলে জড়– ঘেসো এবং খরকুটো। খরকুটোয় জীবনের উৎসব নেই।

বাঙালির জীবনে উৎসব আছে, হই-হুল্লোড় আছে। মেলা আছে এবং যাবতীয় রঙ আছে। বারো মাস উৎসবমুখর থাকতে বাঙালি পছন্দ করে। এই উৎসবের বৈচিত্র্য ও বিস্তারও অনেক বড়। পান্তাভাত থেকে পদ্মদীঘি পর্যন্ত বাঙালির স্বপ্ন-রঙ ধরা যায়। একশ আটটি বেত্রাঘাত থেকে একশ আটটি নীল পদ্মের মোহ বাঙালির সংস্কৃতির আয়তনে আছে। নিরুৎসব, ব্যধিগ্রস্থ জীবন বাঙালির কাছে– নৈবচ নৈবচ– কখনো নয়।

‘যাক এবার তোর বিয়ের বাদ্যি বাজলো’– আমরা এরকম সংলাপ প্রতিদিনের জীবনে ব্যবহার করি। উৎসব বোঝাতে ‘বাদ্যি’ শব্দটি ব্যবহার করি। বাদ্য বজলো মানেই ঢাকঢোল বাজলো। ঢাক ও ঢোল– দুইয়ে মিলে দ্বন্দ্ব সমাস। অথচ এই দুইয়ের মধ্যে মোটেই কোনো দ্বন্দ্ব নেই। বিরোধ এড়িয়ে উদার চিত্তে আমরা বাংলা ভাষাকে ঋদ্ধ করেছি। সংস্কৃত ভাষার সাথে আরবি, ফারসি, তুর্কি, ইংরেজিসহ বহুবিধ ভাষাকে আমরা গ্রহণ ও আত্মস্ত করেছি। শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ করার প্রশ্নে কোন সংস্কারের কাছে আমরা নতমুখ হয়নি। ফসলি মাঠে নিঃসঙ্গ ফিঙে পাখি হয়ে বসে থাকিনি দিনান্তে একটি পতঙ্গের লোভে। অকাতরে শস্যভান্ডারের মতো আমরা যাবতীয় শব্দকে আমাদের গোলায় তুলেছি। গালভরে আহরণ করেছি।

আমাদের সংস্কৃতির বীজমন্ত্র উপ্ত ও সুপ্ত আছে লোকায়ত জীবনের সংস্কৃতির মধ্যে। লোকায়ত সংস্কৃতির আদলে গৃহীত শব্দকে আমরা আমাদের সংস্কৃতির সাথে সংগতি রেখেই প্রয়োগসিদ্ধ করে নিয়েছি। সংস্কৃত একটি মৃত ভাষা এখন। তবুও আমরা চন্দ্রালোকিত রাত্রি, চাঁদনি রাত অথবা চান-রাত শব্দগুলি ব্যবহার করি। সীতানাথ বসাক এর ‘আদর্শলিপিতে’ ‘ঢ’ বর্ণের ব্যবহার বোঝাতে প্রাসঙ্গিক বাক্যটি ছিলো ‘ঢক্কা রণবাদ্য বিশেষ’। আজ বিশ্বজুড়ে রণবাদ্য বাজলেও আমরা উৎসবে ‘ঢক্কা’ নয় ‘ঢাকঢোল’ বাজাই। ‘তাকডুম তাকডুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল।’ শচিন কত্তার গীতিকবিতার বাক্যটি লাগসই। বাংলাদেশের ঢোল সত্যি আলাদা।

ঢাকঢোল নিয়ে বিস্তর প্রবাদ আছে, প্রবচন আছে। ‘একে তো নাচুনি বুড়ি তার উপর ঢাকের বাড়ি’– এরকম কথাও আমাদের জীবনের নিত্য অনুষঙ্গ এবং অর্থবহ। এই প্রবাদ মোটেই প্রমাদ নয়, মোক্ষম এবং নির্ভুল। ঢাকের বোল নাচন তোল– এরকমই যেন নেপথ্যের আহ্বান। তখন ধেই ধেই নাচের ছন্দ শরীরের ধমনীতে বয়ে যায়। পঞ্চশ এর দশকে (১৯৪৭) লেখক-সাংবাদিক যাযাবর এর রম্যরচনা ‘দৃষ্টিপাত’ প্রকাশিত হয়। অপরিমেয় পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল গ্রন্থটি। এই গ্রন্থের একটি বাক্য প্রবচনের মতো সবার মুখে মুখে ঘুরতো। ‘যাযাবর’ ছদ্মনামে পরিচিত বিনয় মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ বেঁচে থাকলে আজ তিনি কথা পাল্টে ফেলতেন। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বেগে আজ আমরা দিশেহারা। বেগ ও আবেগ- এই দুইয়ের যোগফলে আমাদের জীবন উত্তাল, উন্মথিত– পাগলপারা।

‘আ-বেগ’ শব্দটির আড়ালে যেন ঘাপটি মেরে আছে এর কাছাকাছি একটি বার্তা– আদিষ্ট হয়ে বেগ। আবেগের উন্মেষ মনে, মস্তিষ্কে পরে তা শরীরে বা দেহপল্লবে গতি সঞ্চার করে। আবেগ মস্তিষ্কের সংকেত ও স্নায়ু সংশ্লিষ্ট। তার সামষ্টিক ক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় মস্তিষ্কে। মস্তিষ্কের আদেশেই বেগ দেহমনে ছড়িয়ে পড়ে আর ক্রিয়াশীলতার ধরনে চিহ্নিত ও প্রকাশিত হয় আবেগ।

‘ঢাকগুড়গুড়’ বলেও একটি শব্দ আছে। বাগবিধির মতো শব্দটি ব্যবহার করা হয়। রাখঢাক না করেই বলা যায়, এর অর্থ যে লুকোছাপা করে, মিনমিন করে বা রাখঢাক করে। কী-জানি-কি আড়াল করতে চায়। অকাতরে অনিবার্য শব্দকে আমরা শুধু গ্রহণই করিনি। শব্দকে ব্যঞ্জনায় বহুমাত্রিকতা দিয়েছি। আমাদের সংস্কৃতি যতোটা দাবি করে শব্দের বিস্তার আমরা ততোটা বাড়িয়ে নিয়েছি।

একটি শব্দ বা শব্দগুচ্ছ দৈনন্দিন জীবনে কতোটা এবং কেমন করে ব্যবহৃত হচ্ছে তা থেকে একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর মনোজগত পড়ে ওঠা যায়। তার মনোভঙ্গি আঁচ-অনুমান করা যায়। ঢাকঢোল তেমনি একটি সমাসবদ্ধ শব্দ। আমরা নিজের ঢোল নিজে বাজাই। অন্যকেও অনুরূপ পরামর্শ দেই। ঢাকঢোল পিটিয়ে আমরা অপরের কূট-কেচ্ছা গাই আবার প্রয়োজনে কীর্তন করতেও কুণ্ঠিত হই না। পরশ্রীকাতরতার সাথে প্রশংসা-কীর্তন ও স্তাবকতাও আমাদের চরিত্রে বিমলানন্দে বিরাজমান।

বাঙালির উৎসবে ঢাকঢোল নেই– এমন চিন্তা কল্পনায় ধরা পড়ে না। আক্ষরিক অর্থেই যে ঢাকঢোল হতে হবে তা নয়, বুলি কপচানোর মধ্যে ঢাকঢোল আছে। ঢাকের কাঠি বলেও একটি কথা আছে। ঢাকের কাঠি বা ঢাকঢোল কেড়ে নিলে বাঙালির মনোজগত যে বিপন্ন হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

একটানা শ্রাবণ শেষে, বরিষণের ক্লান্তি শেষে একদা-একদিন শরৎ আসতো। ভেজা বরষার অলস ও আর্দ্র দিন মুছে দিতো শরতের অমল আকাশ। তুলো-মেঘ, খানাখন্দে আটকে-পড়া ব্যাঙ-বসতি-জল আর কাশবন। নদীতীরে, এখানে-ওখানে জলাশয় ঘিরে সাদা রঙের উদ্ভাস। সারা বাংলার মাঠঘাট, লোকালয়-বসতি ঘিরে সাদা ফ্রক-পড়া শুভ্র কিশোরী যেন দোল খায়। আমরা সেকালে অন্তরে জাদু-মন্তরে মুগ্ধ হয়ে শুনতাম তার নৈসর্গিক ডাক– ‘আয় আয়, ছুটে আয়’। আর দূরে কোথাও চেনা-অচেনা শব্দে বেজে উঠতো ঢাক। ওই ঢাকের ডাক আলাদা। ওই ঢাকের তাল-বোল একটা কথাই বলে– শারদোৎসব এসে গেছে। উঠোনে টুপুস করে ঝরে পড়েছে নম্র, নাজুক ও লাজুক শেফালি। সারারাত রূপ ও গন্ধে নিজেকে বিকশিত করেছে সে, শিশিরে ভিজেছে। দিনের আলো ফুটতে-না-ফুটতেই উঠোনের মাটিতে মুখ গুজে দিয়েছে। পুরাণে আছে সে অভিশপ্ত। দিনের আলোয় রূপ ও গন্ধ হারিয়ে সে শুকিয়ে যায়। পড়ন্ত বেলায় ঢাক বাজছে, অন্য প্রহরেও ঢাক বাজছে– শোনা যায় দূরাগত ধ্বনি তার। আসলে ‘ঢাকি সম্প্রদায়ের’ যারা তারা বাদ্যযন্ত্রটি পরখ করে নিচ্ছে। টিউনিং ঠিক হলো কিনা, টেকসই হলো কি না। এদিক-ওদিক হলে চলবে না। শারদোৎসবে ঢাক বাজবে। ধুনচির ধোঁয়া আর ঢাকের বোলে মন মাতোয়ারা হবে। অসুখ পালাবে, অসুর পালাবে। 

শহরে-নগরে, গ্রাম ও গঞ্জে মহান উৎসবের ডাক। ডাক দিয়ে যায় ঢাক। হেমন্তের শূন্য-বিষণ্ণ মাঠ পেরিয়ে অন্য লোকালয়ে বেজে উঠছে ঢাক। আমরা ওই ঢাকের ডাকে সাড়া দিয়ে যাই। প্রযুক্তির পরিবর্তন ও উৎকর্ষ, জলবায়ুর পরিবর্তন, বৈশ্বিক মানসিকতার পরিবর্তন ক্রমশ দৃশ্যমান। বিশ্ব এখন অস্থির ও যুযুধান। এই মুহূর্তে ঋতুর মুখ, মানুষের মুখ, সমাজকাঠামো, আন্তঃসম্পর্ক সব কিছুই অস্পষ্ট। ঘোলাটে ও ধোঁয়াটে। অনেকদিনের চেনা, কাছের মানুষকেও অস্পষ্ট মনে হয়। সংশয় হয়। মনে হয়, ঘষা কাচের মধ্য দিয়ে দেখছি কাছের মানুষকে। ‘কাশবন-কিশোরীও’ তেমনি অস্পষ্ট। আগের মতো ডাগর নয়, আগের প্রাচুর্য নিয়ে এখন আর ফোটে না সে। এক টুকরো অচেনা ছায়া মুড়িয়ে রেখেছে তাকে। তেমনি ঢেকে গেছে ঋতুর মুখ। বর্ষা আহত, শ্রাবণ নিহত, শরৎ ক্ষতবিক্ষত।

এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। গ্রীষ্মের তাপিত দিনের পর প্রকৃতি উজালা করতে যে কালোকেশী মেঘ আসতো সে আর আসে না। ‘ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে’ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বর্ষা-আহ্বান এখন শুধু কাব্যে, প্রাণপ্রকৃতির মধ্যে নেই। আমরা, বিশ্বনাগরিক, তাকে বিদায় করেছি। সভ্যতার অপরিমেয় উৎকর্ষের নামে ঢাকঢোল পিটিয়ে তাকে বিদায় করেছি। ‘ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা’ আর আসে না।

তবে এই ঢাকির দলে বাঙালির ভূমিকা তেমন নেই। উন্নয়নশীল বিশ্ব এটা করেনি। ঢাকঢোল পিটিয়ে কাজটি করেছে এই গ্রহের উন্নত বিশ্ব। আরও প্রাপ্তির জন্য, আরও কয়েক বিঘত সভ্যতা বিনির্মানের জন্য উন্নত বিশ্ব মুখর। বাজার দরকার, পুঁজি দরকার, চমক-ঠমক দরকার। সভ্যতার তরুতে অন্তিমে ফুটেছে অসভ্য ফুল যে দিয়েছে মাকাল ফল। ঢাকঢোল পিটিয়ে উষ্ণায়ন, গ্রিনহাউস গ্যাসের উদগীরন তারা ব্যপক উৎসাহের সাথে করেছে। বাঙালি তার ঢাকঢোল নিয়ে নাগরদোলায় দুলছে একালে । বড় বিভ্রান্ত সে এই কুহেলিকায়। সে যা উচ্চারণ করে তা প্রহেলিকা হয়ে যায়। বাঙালি শুধু একটু উৎসবের জন্য উন্মুখ ছিলো। ইচ্ছার অপঘাত দূরে থাক, প্রাণপ্রকৃতিকে আঘাত করার সুযোগই তার নেই।

অতঃপর এমন চিত্রকল্প বা অতীত দৃশ্যপট বিমূর্ত স্মৃতির মতো ডেকে আনা যায়– একদিন আমি-আপনি-আপনারা তার হাত ধরে ভোরের পথে হেঁটে গেছি। শরতের শিশির আর মৃত ঘাসেরা পায়ে লেপটে হয়তো এখনও মমির মতো সাক্ষী হয়ে আছে– স্মৃতি-সাক্ষী। একদিন ভোরবেলা সে একঝুড়ি স্থলপদ্ম হাতে তুলে দিয়ে অন্য হাতে চোখ রগড়ে নিচ্ছিল। কারণ, তখনও তাকে নিদ্রার নিশি ছাড়েনি। তখনও তার চোখে ভোরবেলার পাথর-ঘুম লেগে আছে। তবু সে উঠে এসেছিলো সেইদিন– কারণ, আলো ফোটার আগেই সে শুনেছিল ঢাকের শব্দ– উৎসবের ধ্বনি।

শারদোৎসবের ডাক।

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়