ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মেসি রোনালদো নেইমাররা কাতারে কী খাবেন 

সামীউর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৪, ২১ নভেম্বর ২০২২   আপডেট: ১২:৫৪, ২১ নভেম্বর ২০২২
মেসি রোনালদো নেইমাররা কাতারে কী খাবেন 

বিশ্বকাপ মানে বিশ্বের বাঘা সব ফুটবলারদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর মঞ্চ। ঠিক একইভাবে বিশ্বকাপ মাঠের বাইরেও কিছু মানুষের কাছে বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। কারণ খেলোয়াড়দের খাবার, যাত্রা পথের পরিবহন, অনুশীলন সুবিধা সবই হতে হবে নিখুঁত। আসলে অনেক সময় মাঠের বাইরের এই ছোটখাট বিষয়গুলো গড়ে দেয় ব্যবধান। 

ভেবে দেখুন তো, পেটের গোলমালে ফাইনালেই নামতে পারছেন না রোনালদো, মেসি কিংবা নেইমার! এমনটা কি মেনে নেয়া যায়? এ কারণে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া বেশিরভাগ দলের খেলোয়াড়দের আগেই স্বাগতিক দেশে পৌঁছে যান অংশগ্রহণকারী দেশের কর্মকর্তারা। খাবার তো বটেই, অনেক সময় চলাচলের জন্য গাড়িও নিজেদের দেশ থেকে নিয়ে যাবার নজির আছে।

২০১৪ সালে বিশ্বকাপ জেতা জার্মানি ব্রাজিলে তাদের বেসক্যাম্প করেছিল ক্যাম্পো বাহিয়াতে। এক জার্মান কোম্পানি সেখানে রিসোর্ট বানাচ্ছে জানতে পেরে জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন সব কিছু তাদের চাহিদামত তৈরি করে নিয়েছিল। সেখানে ম্যাকডোনাল্ডের মতো নকশায় ক্যাফে আর সোনালি চুলের সুন্দরী ওয়েইট্রেসরাও নাকি ছিল! সেই বিশ্বকাপে জার্মান দলের প্রধান পাচক ছিলেন হোল্ডার স্ট্রমবুর্গ। তিনি খেলোয়াড়দের পাতে তুলে দিতেন প্রচুর সবজি, পুষ্টিকর শষ্যদানা আর ফলমূল। মানুয়েল নয়্যার ভালোবাসতেন সি-ফুড সালাদ, কারো পছন্দ ছিল টমেটো স্যুপ, কারও আবার টাটকা সালাদে পনির। এবারও নিশ্চয় জার্মান দল সঙ্গে নিয়ে আসবেন এমন কোনো পাচক, যে খেয়াল রাখবে দলের সবার পছন্দ-অপছন্দ। 

খেলাধুলায় বিজ্ঞান আর গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত এখন ব্যবহার হচ্ছে প্রতিটি পর্যায়ে। স্পেনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল বের করেছেন, ফুটবল মাঠের পজিশন অনুযায়ী খাবারের তালিকাটা হওয়া দরকার ভিন্ন। কারণ একেক জায়গায় শরীরের চাহিদা একেক রকম। মাঝমাঠের খেলোয়াড়দের খেলার ধরন এবং প্রতিপক্ষ ভেদে ১২-১৩ কিলোমিটার দৌড়াতে হয় একটা ম্যাচে। আবার ফরোয়ার্ডরা দৌড়ায় গড়ে ৯ কিলোমিটার। তবে তাদের দৌড়গুলো সব ছোট ছোট স্প্রিন্টের সমষ্টি, তাদের ফরোয়ার্ডদের খাবারে কার্বোহাইড্রেট ও গ্লুকোজের পরিমাণ থাকবে বাড়তি। ম্যাচের সময় সাইডলাইনে এনার্জি বার প্রস্তুত থাকে ফরোয়ার্ডদের জন্য, যাতে চট করে এক কামড়ে তারা বেশ খানিকটা রসদের যোগান দিয়ে দিতে পারেন শরীরকে।

ম্যাচের আগে ও পরের খাবারে থাকে ভিন্নতা। বিশ্বকাপজয়ী জার্মান দলের হেঁশেল সামলানো স্ট্রমবুর্গ তার সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন বই, যেখানে ঠাঁই পেয়েছে বিশ্বকাপজয়ীদের পছন্দের সব খাবারের রেসিপি। স্ট্রমবার্গ জানিয়েছেন- গরুর মাংস, মাছ, মিষ্টি কুমড়া, গাজর, অ্যাভোকাডো, বিট এসবই বেশি থাকত তার রান্নায়। স্যুপ, সালাদ, সবজি মূল পদ আর ডেজার্টের বাহারি বুফেই সাজিয়ে রাখতেন তিনি। 

রাশিয়া বিশ্বকাপে দুই টন খাবার দেশ থেকে নিয়ে এসেছিল মেক্সিকো ফুটবল দল। ভুট্টা, সীমের দানা; এই দুটো হচ্ছে মেক্সিকান খাবারের মূল উপাদান, সঙ্গে মরিচের ঝাল সস। সবই নিয়ে আসা হয়েছিল মেক্সিকো থেকে, শুধু গরুর মাংস বাদে। কারণ মেক্সিকোতে গরু মোটাতাজা করতে এক ধরনের ওষুধ প্রায়ই খামারিরা গো-খাদ্যে মেশান যাতে নিষিদ্ধ মাদকের অস্তিত্ব আছে। ২০১১ সালে মেক্সিকোর ৫ খেলোয়াড়ের নমুনাও পাওয়া গিয়েছিল সেই ক্লেনাবিউটারেলের অস্তিত্ব, পরে জানা যায় মাংস থেকেই শরীরে ঢুকেছিল এই নিষিদ্ধ বস্তু। তাই মাংসটা মেক্সিকানরা নিয়েছিল ডেনিশ এক প্রতিষ্ঠান থেকে। 

রাশিয়া বিশ্বকাপে মেক্সিকো দলের সঙ্গে কাজ করেছিলেন পুষ্টিবিদ বিয়েট্রিজ বিয়োলসা। তিনি জানান, প্রত্যেক খেলোয়াড়ের জন্য ছিল আলাদা ডায়েট চার্ট। যারা পুরো ম্যাচ খেলেছেন, যারা বদলী নেমেছেন আর যারা বেঞ্চে বসে ছিলেন, প্রত্যেকের খাবার ছিল আলাদা।

ফুটবল নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা করে সবচেয়ে কম সাফল্য বোধহয় পেয়েছে ইংল্যান্ড! এবারে শোনা যাক ইংল্যান্ড ফুটবল দলের খাবারের তালিকার কথা, যা ব্রিটিশ পুষ্টিবিদ জেমস কলিনস করে দিয়েছিলেন রাশিয়া বিশ্বকাপের জন্য। দিনে ৫ বেলা খাবার। প্রোটিনের জন্য টার্কি মুরগির মাংস, গরুর মাংস, স্যামন মাছ আর ম্যাকারেল মাছ। সঙ্গে ভাত অথবা পাস্তা। ডেজার্টে রাইস পুডিং আর গুরুত্বপূর্ণ সব ম্যাচের আগে স্ক্র্যাম্বলড এগ-এর সঙ্গে বেকড বিন অন টোস্ট।

কাতার বিশ্বকাপে ফিরছে নেদারল্যান্ডস, অরেঞ্জরা খেলতে পারেনি রাশিয়াতে। কাতারে এসে তারা থাকবে দোহার সেইন্ট রিজেস হোটেলে। হোটেলের অ্যাস্টর স্টেকহাউজটা চালু হয়েছে নতুন করে, বিকেলের চা পানের আদর্শ জায়গা হতে পারে সারাব লাউঞ্জ। রাতের খাবারের জন্য স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের খাবারের জন্য বিখ্যাত মিশেলিন স্টার রেস্তোরাঁ ‘বিবো’ এই হোটেলেই, ইতালিয়ান খাবারের জন্য আছে স্কালিনি আর মেক্সিকান স্ট্রিট অ্যান্ড ফিউশন মেনুর জন্য লা বোদেগা নেগারা।

আর্জেন্টাইন সাহিত্যিক এবং স্প্যানিশ ভাষায় সাহিত্য রচয়িতাদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী লেখক হোর্হে লুই বোর্হেস নিজের দেশের মানুষ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘আর্জেন্টাইনরা আসলে ইতালিয়ান্ন যারা কথা বলে স্প্যানিশে, নিজেকে ভাবে ফরাসি কিন্তু মনে মনে হতে চায় ইংরেজ।’ 

আর্জেন্টিনার ফুটবলাররাও তাই কোন খাবারটা খাবেন সেটা বোধহয় আঁচ করা মুশকিল। সেজন্যেই বোধহয় হোটেলে নয়, আর্জেন্টিনা দল তাদের বেসক্যাম্প বানিয়েছে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলকে! অবশ্য এটা মূল কারণ নয়, আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বলেছে যে তারা মাঠের সঙ্গে থাকার জায়গা চায়। সেজন্যই এই বন্দোবস্ত। লিওনেল মেসি মেনে চলেন ভূমধ্যসাগরীয় খাবার তালিকা। এই খাবার তালিকায় থাকে জলপাই তেল, তাজা সামুদ্রিক মাছ, পনির, আস্ত শষ্যদানা, নানান রকম বাদাম ও বীজ, তাজা ফল আর সবজি। ইতালিয়ান পুষ্টিবিদ গিলিয়ানো পোজার ২০১৪ সালে মেসির খাবার-তালিকা ঠিক করে দেন। এরপর থেকে মেসি এই তালিকা মেনে চলছেন। 

এক সাক্ষাৎকারে মেসি জানিয়েছেন, ‘একটা সময় আমি আজেবাজে খাবার অনেক খেতাম। কার্বোনেটেড পানীয়, চকলেট এসব। এজন্যই আমি ম্যাচের মাঝে বমি করতাম। এখন আমি অনেক যত্নশীল খাবারের বেলায়। আমি এখন মাছ, মাংস আর সালাদ বেশি বেশি খাই।’ 
আর্জেন্টিনার গরুর মাংসের স্টেক জগৎবিখ্যাত। অ্যালবেসিলেস্তেরা নিঃসন্দেহে হোস্টেলের পাচকের বদলে সঙ্গে করে এমন কাউকে আনবেন যে অন্তত আর্জেন্টাইন স্টেকটা রান্না করতে পারে!

ব্রাজিল দল থাকছে দোহার ওয়েস্টিন হোটেলে। সেখানে আছে মনকাড়া সব রেস্তোরাঁ। থাই খাবারের রেস্তোরাঁ, স্টেকহাউজ হান্টারজ গ্রিল আর নানান রকম খাবারে সকালে অনুশীলনের পর উদরপূর্তির জন্য ‘বাবলেশিয়াস ব্রাঞ্চ’। 

জ্যাভিয়ের রুশো ছিলেন ২০১৮ সালের বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স ফুটবল দলের প্রধান পাচক। বার্সেলোনায় ‘পারফরমেন্স শেফ’-দের একটি সম্মেলনে এসে তিনি জানিয়েছেন ফরাসি দলের খাবারের আয়োজন ছিল খুবই মৌলিক- তিন বেলা খাবার, তিন ধরনের খাবার। এই ছিল ব্যবস্থা। শক্তির জন্য শর্করা, পেশিশক্তির জন্য আমিষ আর স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য ফলমূল। ফরাসি দল কাতারে থাকছে আল মেসিয়া রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা। এখানে আছে পারস্য দেশীয় খাবারের রেস্তোরাঁ পারসিয়ান, সেই সঙ্গে আছে ইতালিয়ান ফাইন ডাইনিং স্পট ভেরিতাস।

ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো যেমন ফিটনেস সচেতন, তেমনি খাবারও খান বেছে। অল্প অল্প করে ছয় বেলা খাবার খান সিআরসেভেন। সকালে হ্যাম, পনির আর টকদই। একটু বেলা বাড়লে অ্যাভোকাডো আর টোস্ট। দুপুরের খাবারও দুইবারে খান রোনালদো, একবার মুরগির মাংসের সালাদ আর পরের বার মাছের সঙ্গে সালাদ, ডিম আর জলপাই।

রাতের খাবারও সন্ধ্যায় দুইবারে খেয়ে নেন রোনালদো, বেশিরভাগ সময়ই থাকে সামুদ্রিক মাছ আর নয়তো স্টেক। পরিশোধিত চিনি বা চিনি মেশানো পানীয় এবং অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় থেকে দূরেই থাকেন এই পর্তুগিজ তারকা। বিশ্বকাপ খেলতে এসে পর্তুগাল থাকবে আল সামরিয়া অটোগ্রাফ কালেকশন হোটেলে, এখানেই আছে দারুণ এক লেবানিজ রেস্তোরাঁ। সামুদ্রিক মাছ, জলপাই তেল আর তাজা সালাদ পাতে পেতে তাই কোনো সমস্যা হবে না রোনালদোর!

বিশ্বকাপে খেলতে আসা খেলোয়াড়দের থাকতে হবে কড়া ডায়েটে। তবে কখনো যদি ‘চিট মিল’-এর সুযোগ আসে তাহলে খেলোয়াড়রা হয়তো চেখে দেখতে পারেন কাতারের ঐতিহ্যবাহী খাবার কাবসা। ভেড়া বা মুরগির মাংসের সঙ্গে চাল ও নানান মশলা মিশিয়ে লম্বা সময় ধরে ঢিমে আঁচে রান্না করা এই খাবারটি মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার।

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়