ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

দেহের যুদ্ধ

কাজী জহিরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩২, ৯ মে ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দেহের যুদ্ধ

নতুন করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ নিয়ে এতো আতঙ্ক কেন? ভাইরাসজনিত অসুখ তো আমাদের আগেও হয়েছে। সেরেও গেছে। এবার এতো মৃত্যু, এতো আতঙ্কের কারণ কী? সাধারণত সর্দি, জ্বর, কাশি ভাইরাসজনিত অসুখ, প্রতি বছরই হয়।  আবার ভালো হয়ে যায়।

তবে এসব অসুখেও যে মৃত্যু ঘটে না তাও নয়, বরং পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে আঁতকেই উঠতে হয়। সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর সাধারণ ফ্লুতে মারা যায় ২ লক্ষ ৯০ হাজার থেকে ৬ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ।  আমেরিকাতে এই সংখ্যা ৩৬ হাজার (সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)।  তবে আক্রান্তের সংখ্যার তুলনায় তা খুবই কম। সাধারণত পৃথিবীর কুড়ি শতাংশ মানুষই (১.৪ বিলিয়ন) বিভিন্ন মাত্রার ফ্লুতে আক্রান্ত হয় প্রতি বছর। ভাইরাসজনিত ভয়ঙ্কর অসুখগুলো হচ্ছে এইডস, গুটিবসন্ত, ইবোলা প্রভৃতি।

ভাইরাস হচ্ছে প্রতিপক্ষ সৈন্যদল। আমাদের প্রত্যেকের দেহে একটি শক্তিশালী ডিফেন্স ফোর্স আছে।  ওদের কাজ অন্য দেশের সাথে যুদ্ধ করা নয়, বরং নিজের ওপর আক্রমণ এলে তা প্রতিহত করা।  বাইরে থেকে যখন কিছু ভাইরাস আমাদের দেহে ঢুকে পড়ে, তখন আমাদের দেহের প্রতিরোধ ফোর্স তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। বহিরাগত সৈন্যদল চেষ্টা করে প্রতিরোধ কোষগুলোকে পরাজিত করে তাদের দলে ভেড়াতে আর প্রতিরোধ কোষগুলো চেষ্টা করে বহিরাগতদের হত্যা করতে এবং পরাজিত করতে।  পরাজিত সৈন্যদলের যারা বেঁচে থাকে তারা হয় যুদ্ধবন্দি।  যুদ্ধবন্দিরা দেহের প্রতিরোধ ফোর্সের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং প্রতিরোধ ফোর্সের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। এভাবেই আমাদের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয়। এরপর একই প্রকৃতির ভাইরাস দেহে ঢুকলে তাদেরকে শনাক্ত করা সহজ হয় এবং আত্মসমর্পণ করে যারা দেহের ডিফেন্স ফোর্সে যোগ দিল তারাই ওদেরকে হত্যা করে। 

যদি উল্টোটা ঘটে? প্রতিরোধ ফোর্স পরাজিত হয়? তাহলে প্রতিরোধ ফোর্স আত্মসমর্পণ করে এবং ভাইরাসের দলে যোগ দেয় এবং ক্রমশ ভাইরাসেরা প্রতিরোধ ফোর্সকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে রোগীর মৃত্যু ঘটায়।

চেনা ভাইরাস যখন আমাদের দেহে ঢোকে তখন তাদের গতিবিধি জানা থাকে বলে সহজেই তাদেরকে পরাজিত করা যায়।  অচেনা ভাইরাস ঢুকলেই বিপদ।  একজন মার্কিন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শামীমা আহমেদ সেদিন জানালেন, করোনাভাইরাস যেহেতু নতুন এবং অচেনা, দেহের প্রতিরোধ ফোর্স তার গতিবিধি বুঝতে পারে না। ফলে ডিফেন্স ফোর্সের জেনারেল সিদ্ধান্ত নেন এলোপাথাড়ি (ব্লাইন্ড ফোল্ড) গুলি ছোঁড়ার।  এতে করে নিজ দলের অনেক সৈন্যও ক্রসফায়ারে পড়ে মারা যায়, ফলে দেহের টোটাল ইমিউন সিস্টেম আরো দুর্বল হয়ে যায়।

করোনাভাইরাস যেহেতু নতুন এবং অচেনা, তারা যখন দেহের ভেতরে ঢুকে পড়ে তখন দেহের ডিফেন্স ফোর্স ব্লাইন্ড ফোল্ডেড ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে।  এতে করে শত্রু কিছু মরে বটে তবে নিজ দলের সৈন্যও প্রচুর মারা পড়ে। যদি ভাইরাল লোড কম হয়, অর্থাৎ শত্রুপক্ষের সৈন্যসংখ্যা কম হয়, তাহলে ভয়টা কম, আর যদি শত্রুপক্ষের সৈন্যসংখ্যা অত্যাধিক হয় তাহলেই বিপদ।  দুইপক্ষের ক্ষয় ক্ষতির পরেও যদি শত্রুপক্ষের প্রচুর সৈন্য জীবিত এবং সুস্থ থাকে তাহলে অবস্থাটা কি হবে তা নিশ্চয়ই আমরা সবাই বুঝতে পারছি।  মানবদেহের পরাজয় নিশ্চিত।

দুইজন মানুষ একই সঙ্গে একইভাবে আক্রান্ত হলো।  ধরা যাক ভাইরাল লোড দুজনেরই সমান। কিছুদিনের মধ্যে একজন সুস্থ হয়ে গেল, অন্যজনের অবস্থার অবনতি ঘটল এবং রোগী মারা গেল। এর কারণ কি? কারণ কিন্তু খুব সোজা, দুজন মানুষের দেহ দুটি স্বাধীন দেশ।  দুই দেশের সৈন্য সংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, প্রশিক্ষণ ভিন্ন। ধরা যাক দুজনের দেহেই ১০ হাজার করে ভাইরাস ঢুকেছে। প্রথমজনের ডিফেন্স ফোর্সের মোট সৈন্য ২০ হাজার, তাদের আছে দ্রোন, মিজাইলসহ নানান আধুনিক অস্ত্র, আছে নৌ, বিমান ও পদাতিক বাহিনী। দ্বিতীয়জনের ডিফেন্স ফোর্সের সৈন্যসংখ্যা মাত্র ৫ হাজার এবং শুধুমাত্র ইনফেন্ট্রি ফোর্স। তাদের অস্ত্রশস্ত্রও পুরনো। স্বভাবতই দ্বিতীয়জনের ডিফেন্স ফোর্স পরাজিত হবে, যদি না কোনো মিরাকল ঘটে যায়। ব্লিজার্ট বা ডেজার্ট স্ট্রর্মে যদি শত্রুসৈন্য ঘায়েল হয়ে যায় তাহলেই কেবল দ্বিতীয় জনের জয়ী হবার সম্ভাবনা আছে। এমন ঘটনা বহু যুদ্ধে ঘটেছে এবং তা দেহের ভেতরেও ঘটে।

আমাদের তো সংক্রমণ এড়িয়ে চলতে হবেই। যদি সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকেও ভাইরাল লোড যেন বেশি না হয় সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে। দেখা গেছে যারা মেডিক্যাল পেশায় কাজ করেন তারা সংক্রমিত হলে ভাইরাল লোডের পরিমাণ বেশি হয়।  আপনি/আমি যত কম জনসমক্ষে যাবো, বিশেষ করে মেডিক্যাল ফ্যাসিলিটি, গ্রোসারি শপ বা যেসব জায়গায় প্রচুর লোকের আসা-যাওয়া, ততই ভালো।  এতে করে সংক্রমণ হলেও ভাইরাল লোড কম হবে এবং যুদ্ধে আমাদের ডিফেন্স ফোর্সের জয়ী হবার সম্ভাবনা বেশি থাকবে।

খবর পেলাম ঢাকায় শপিং মল খুলে দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিছু কিছু পণ্যের ব্যবসায়ীরা সারা বছর অপেক্ষা করেন ঈদের সময় ব্যবসা করবেন বলে। তারা নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে আছেন, সরকারকে চাপ দিচ্ছেন মার্কেট খুলে দিতে। এই সময়ে সরকারকে কঠোর এবং কিছুটা নির্মমও হতে হবে।  মনে রাখতে হবে সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই।  জনগণকেও এ সময়ে অধিক সচেতন হতে হবে, যদি মার্কেট খোলাও হয়, কেউ যাবেন না সেখানে। ড্রাইভার, পিয়ন, কাজের লোক বা ব্যক্তিগত সহকারীকে পাঠাবেন না আপনার জন্য শপিং করতে। কার কতটুকু ভাইরাল লোডের সাথে যুদ্ধ করার সামর্থ আছে আমরা জানি না। কাজেই যতটা সম্ভব সংক্রমণ এড়িয়ে চলাই এখন উত্তম।

হলিসউড, নিউ ইয়র্ক, ৪ মে ২০২০।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক

 

/সাইফ/

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়