আমার দেখা টোকিও (পর্ব-৬)
পি.আর. প্ল্যাসিড, জাপান থেকে || রাইজিংবিডি.কম
৬. উয়েনো পার্ক: জাপান আসার পর টোকিওতে প্রথম যে পার্কে ঘুরতে যাই—সেটি হলো উয়েনো পার্ক।
বাংলাদেশ থেকে জাপান আসার সময় আমরা কয়েক বন্ধু একই ফ্লাইটে আসি। পরের দিন থেকে আমরা একজন আরেকজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। এরপর কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো না।
কয়েক বছর পর আবার যখন আমাদের যোগাযোগ হয়, তখন আমাদের টোকিওতে দেখা হয়। মনে পড়ে, আমি এবং আমার আরেক বন্ধু ছাড়া অন্য বন্ধুদের কেউ টোকিওতে ছিলো না। যে কারণে তাদের কাছে এই টোকিও আসাটাও ছিল অন্যরকম। আমার সঙ্গে ওরা দেখা করতে আসার সুযোগে টোকিও শহরটাও ঘুরে দেখার পরিকল্পনা নিয়েই এসেছিল ওরা।
টোকিও এসে ওরা পরেরদিনই উয়েনো পার্কে গিয়েছিলাম। পার্কের ভেতর ঢুকে অবাক হয়েছিলাম পানির ফোয়ারা দেখে। পানি নিচ থেকে অনেক উপরে ওঠে, আবার আছড়ে পরে। একটু পরপর এর আকৃতি পরিবর্তন হতে দেখে খুবই অবাক হয়েছিলাম।
সেদিন আমরা পাঁচ বন্ধু এই পানির ফোয়ারার পাশে বসেই প্রায় আধাবেলা কাটিয়েছি। পানির নাচ উপভোগ করতে, সে সাথে ছবিও তুলেছি দেশে পাঠানোর জন্য।
গত কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখক আনিসুল হক টোকিও এসেছিলেন বিবেকবার্তার আমন্ত্রণে। আসার পরেরদিন তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে ঘুরতে। তিনি ঘুরে দেখার পর জাপানে বস্তি দেখে অবাক হয়েছিলেন। এমনকি সাথে সাথে বস্তিদের মাঝে খাবার বিতরণের দৃশ্য দেখে তা ক্যামেরাবন্দি করলেন।
শুনেছি এই পার্কে এক সময় আমাদের কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদচারণাও হয়েছিল। বাঙালি হিসেবে বিষয়টি শোনার পর আমার কাছে কিছুটা হলেও এই পার্কের একটু ভিন্ন রকমের গুরুত্ব পেয়েছে। এখনও উয়েনো পার্কে ঘুরতে গেলে মনের ভেতর কাজ করে আমাদের বাংলা সাহিত্যের প্রাণ পুরুষের পদচারণার কথা।
এছাড়া জাপানসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে এই পার্কের গুরুত্ব রয়েছে নানা কারণে। টোকিওর তাইতো ওয়ার্ডের উয়েনোতে ১৮৭৩ সনে তৈরি করা হয় এই পার্ক। উয়েনো পার্ক জাপানের প্রথম পাবলিক পার্ক, এটি ওয়েস্টার্ন স্টাইলে করা হয়েছে। এখানে রয়েছে প্রকৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক ন্যাশনাল জাদুঘর, আর্ট গ্যালারি (এই গ্যালারিতে ফ্রান্সসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চিত্রকর্ম আছে)। এছাড়া রয়েছে চিড়িয়াখানা, (ভারত সরকারের উপহার দেওয়া একটি হাতি ছিল এই চিড়িয়াখানায়)। পশু পাখি রয়েছে।
এই পার্কের কাছোই রয়েছে জে আর (জাপান রেলওয়ে) এবং সাবওয়ে রেল স্টেশন। এর নাম উয়েনো স্টেশন। বছরে এখানে প্রায় দশ মিলিয়ন পর্যটকের আগমন ঘটে।
পার্কটি ১,৩৩,০৬,৭৯৭ একর জমির ওপর তৈরি করা হয়েছে। এখানে রয়েছে পদ্ম ফুলে ভরা একটি বড় লেক। এই লেকের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪,৮০০ বর্গমিটার। লেকের পানিতে ভেসে বেড়ায় অসংখ্য দেশি-বিদেশি পাখি। পানিতে রয়েছে নানা ধরনের মাছ।
লেকের ঠিক মাঝখানে একটি ছোট দ্বীপের মতো ভূখন্ডের ওপর নির্মিত হয়েছে বড় টেম্পল। এই ট্যাম্পলে দিনের বেলা জাপানি কালচারে চলে চা উৎসব। লেকের মাঝখান দিয়ে একটি রাস্তাও রয়েছে। এই ট্যাম্পলকে ঘিরে প্রতিদিন বিভিন্ন দোকান বসে। কখনও কখনও মেলাও হয় এখানে।
এই লেকে ব্যাজবল গ্রাউন্ড এবং গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য বহুতল বিশিষ্ট ভবন নির্মাশেষর প্রস্তাব করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে পদ্মফুলের শ্রী বৃদ্ধির জন্য খনন করা হয়। ১৯৬৮ সালে এখান দিয়ে সাবওয়ে রেল লাইন করার জন্য খনন করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
এই পার্কটি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্বাবধানে ছিল। এরপর কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ হয়। সর্বশেষ রাজার বাড়ির দায়িত্বে থাকা মন্ত্রণালয় এর দেখভাল করে। ১৯২৪ সালে সম্রাট হিরোহিতোর বিয়ে উপলক্ষে টোকিওর ইমপেরিয়াল তাইশোকে এই পার্ক হস্তান্তর করা হয়। এজন্য এর অফিসিয়াল নামকরণ করা হয় উয়েনো ওনশিন কোয়েন বা উয়েনো ইমপেরিয়াল গিফট পার্ক (সংক্ষেপে উয়েনো পার্ক)।
পার্কের ভেতর ঘুরে বেড়ানোর যে রাস্তা এবং লেকের ভেতর দিয়ে যে রাস্তা রয়েছে, এর দুইধারে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় এক হাজারেরও বেশি সাকুরা (চেরী ফুল) গাছ রয়েছে। জাপানে অন্যান্য স্থানের চেয়ে এখানেই এত বেশি সাকুরা ফুলের গাছ রয়েছে। শুধু তাই নয়, অন্যান্য গাছসহ সব মিলিয়ে এই পার্কে গাছের সংখ্যা প্রায় ৮,৮০০ টিরও বেশি।
প্রতি বছর জাপানে মার্চের শেষদিকে সাকুরা ফুল ফোটে। এই ফুল এপ্রিলের শুরুর দিকে আবার ঝড়ে যায়। অল্প যে সময়টুকু সাকুরা ফুল ফোটে তখন এক মনোরম দৃশ্যের অবতারনা হয়। ফুল ফোটার সময়ে ফুলকে ঘিরে প্রতি বছর হানামি বা ফুল দেখার উৎসব পালিত হয় পার্কে। উল্লেখ্য এ সময় সারা জাপানেই চলে হানামি উৎসব। এ সময় দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটে। তারা এই উয়েনো পার্কেই আসে উৎসব করতে।
পার্কটিতে ঢুকলে হোমলেসদের বসবাস লক্ষ্য করা যায়। এরা সাধারণত নিজেরা নীল এক ধরনের প্লাস্টিকের শিট দিয়ে তাবুর মতো ঘর তৈরি করে। এর ভেতর রাত্রিযাপন করে। কেউ কেউ আবার কাগজের বোর্ড দিয়ে ঘিরে তার মধ্যে বসবাস করে। বিভিন্ন এনপিও (এনজিও) সংস্থা এদের খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে থাকে। সাধারণত পুলিশ বা অন্য কোনও কর্তৃপক্ষ ওদের বিরক্ত করে না। তবে বিশেষ কোনও ওকেশনের সময় পুলিশ ওদের ঘর ভেঙে পার্ক থেকে বের করে দেয়।
লেখক: জাপান প্রবাসী সাংবাদিক
আরও পড়ুন: আমার দেখা টোকিও (পর্ব-৫)
ঢাকা/সাইফ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন