ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কফি ও কবিতা

কাজী জহিরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ২৬ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
কফি ও কবিতা

পেশাগত কাজে প্রতি বছর মার্চ মাসে আমাকে ইউরোপ ভ্রমণে যেতে হয়। দুটি উইক-অ্যান্ডসহ ৯/১০ দিনের ভ্রমণ। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা এবং হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট, এই তিনটি শহরে আয়কর বিষয়ক বক্তৃতা দেওয়া এবং জাতিসংঘে কর্মরত মার্কিন নাগরিকদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, এই হলো কাজ।

শুরু করি বুদাপেস্ট থেকে। সকালে প্রেজেন্টেশন শেষ করে বিকেলে ভিয়েনার ট্রেনে লাফ দিয়ে উঠে পড়ি। পরদিন সকালে ভিয়েনায় প্রেজেন্টেশন করে সন্ধ্যায় ছুটতে ছুটতে গিয়ে জেনেভার প্লেন ধরি। পরের তিন দিন জেনেভায় পরপর তিনটি প্রেজেন্টেশন এবং তারপর নিউ ইয়র্কের প্লেন। এ বছরও একইভাবে সব এগুচ্ছিল। মার্চ মাসের ১৪ তারিখে আমার ফিরে আসার কথা। কিন্তু কোভিড-১৯ সিচুয়েশনের কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেন যারা দেশের বাইরে আছে তাদের ১৪ তারিখের মধ্যেই দেশে ফিরে আসতে হবে। আমার সফরসঙ্গী ছিলেন ভারতীয় নাগরিক রাও কোটামরাজু, উচ্চমাত্রার বহুমুত্র রোগী। করোনা পরিস্থিতির ভীতিকর সংবাদ আর ট্রাম্পের ঘোষণা শুনে সে প্রায় কেঁদে ফেলেন। তার বাড়ি থেকে মিনিটে মিনিটে ফোন আসছে। তার স্ত্রী সন্তানের কড়া নির্দেশ প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দিয়ে রাও যেন চলে আসে। অগত্যা আমরা কাজ অসমাপ্ত রেখে ১২ মার্চ বৃহস্পতিবার ফিরে আসি। এরই মধ্যে জাতিসংঘের ৮০ শতাংশ কর্মী বাসা থেকে কাজ করা শুরু করে দিয়েছেন। আমার স্টাফরা তখনো অফিসে যাচ্ছে কারণ আমাদের কাজগুলো বাড়ি থেকে না করার কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। পরদিন আমি অফিসে যেতে চাইলে আমার সহকর্মীরা রে রে করে ওঠে। খবরদার আপনি আসবেন না। নানান দেশ ঘুরে এসেছেন, ১৪ দিন গৃহে অন্তরীণ থেকে প্রমাণ করুন যে আপনার দেহে করোনার সংক্রমণ নেই, তারপর অফিসে আসুন। আমাকে আর তা প্রমাণ করতে হলো না। বাধ্যবাধকতাগুলো তুলে নিয়ে আমার অফিসকেও বাসা থেকে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হলো।

কিন্তু আমি অস্থির মানুষ। ক্রমাগত ঘরে বন্দি থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠি। দরোজার ওপাশে মৃত্যু, বেঁচে থাকতে হলে দরোজা বন্ধ রাখতে হবে। কিন্তু আমার যে আকাশ দেখা চাই। আকাশ দেখার জন্য এখন একটি মাত্র কাচের জানালা আছে, সেটি হচ্ছে অনলাইন। ম্যাসেঞ্জারে একটি গ্রুপ খুলি, প্রথমেই তাতে সাড়া দেয় টরন্টোবাসী কবি, আবৃত্তি শিল্পী মৌ মধুবন্তী। এরপর অধ্যাপক ড. আশরাফ আহমেদ, ড. মাহবুব হাসান, কবি ড. দিলারা হাফিজ, ডাক্তার ফারুক আজম, সাংবাদিক আনিস আহমেদ, কূটনীতিক এবং কবি মাহবুব সালেহ, লিজি রহমান, এনাম রাজু, মৃধা আলাউদ্দিন, আবৃত্তি শিল্পী মেহেদী হাসান, শাকিল রিয়াজ, কবি জাহিদুল হক, ফেরদৌস সালাম, আবদুর রব।

আমরা করোনাতঙ্কে ভীত, শিল্পের জ্বরে উত্তপ্ত। রোজ বাংলাদেশ সময় রাত ১১টায় এবং নিউ ইয়র্ক সময় দুপুর একটায় ম্যাসেঞ্জারে গ্রুপ কল করি। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করি, যদি হয়েই যায় কি করবো, যাতে না হয় সেজন্য কি করবো, সর্বশেষ আপডেট কি, পৃথিবীর নানান প্রান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা কেমন আছেন, এসব নিয়ে কথা বলি এবং যেহেতু আমরা কবিতার মানুষ, সংগীতের মানুষ, নিজেদের কবিতা পড়ি, গান করি। মন ভালো রাখার এটি যেন এক অলৌকিক উদ্যান হয়ে ওঠে এবং সারাক্ষণ অপেক্ষা করি কখন আসবে সেই মহেন্দ্রক্ষণ। মাঝে মাঝে আমাদের ছবি দিয়ে ফেসবুকে নিউজ পোস্ট করি। অনেকেই আমাদের সাথে যোগ দিতে চান কিন্তু ম্যাসেঞ্জারে ৮ জনের বেশি একসাথে ঢোকা যায় না।

এক পর্যায়ে আমি যুক্ত করি হলিস লাইব্রেরির ম্যানেজার লেখক আব্দুল্লাহ জাহিদকে। তিনি বলেন, আমরা তো জুমে এই আড্ডাটা করতে পারি। তাহলে অনেক বেশি মানুষ একসাথে যোগ দিতে পারবো। এরই মধ্যে আমি একদিন প্রস্তাব করি, আমরা তো আমাদের এই আড্ডাটি লাইভেও করতে পারি। প্রথমে মৌ, পরে আরো দুয়েকজন হৈ হৈ করে উঠলো। এই সময়ে লাইভে গিয়ে কবিতা পড়লে, আড্ডা দিলে লোকে ছি ছি করবে। আমি বলি জীবন যখন যেমন, সবকিছু মেনে নিয়ে, সাবধানে থেকে একটি স্বাভাবিক জীবন আমাদের যাপন করতে হবে। যার যা কাজ তা করে যেতে হবে। যাই হোক অনেকের আপত্তির কারণে লাইভে যাওয়া হলো না। আরো প্রায় দু'সপ্তাহ আমরা অফ লাইনেই কবিতা পাঠ এবং আড্ডা চালিয়ে গেলাম। তবে একটি কাজ হয়েছে, জাহিদ ভাই জুম সাবস্ক্রাইব করেছেন, এখন আমরা ম্যসেঞ্জারের বদলে জুমে আড্ডা দিই। এক পর্যায়ে, এপ্রিলের ১২ তারিখে সম্ভবত, আমরা জুমের মাধ্যমে লাইভে আসি এবং আমাদের আড্ডার একটি খুব অনানুষ্ঠানিক নাম দেই ‘কফি ও কবিতা’। যেহেতু কফিটা একসাথে বসে পান করা যাচ্ছে না তাই একটি মজার স্লোগান ও দেই—কফি যার যার কবিতা সবার।

একদিন আমি কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনকে আমন্ত্রণ জানাই। তিনি সাগ্রহে যোগ দেন এবং সেই থেকে তিনি রোজ আসছেন। অনিয়মিতভাবে ফরিদ কবির, রহিমা আখতার কল্পনা, মারুফুল ইসলাম, শাহিন রেজা, হোসনে আরা জেমি, কবি আসাদ চৌধুরী, সঙ্ঘমিত্রা ভট্টাচার্য, দিলারা মেসবাহ, রবিশংকর মৈত্রী, আমিরুল আরহাম, জয়ন্ত নাগ, শান্তা নাগ, ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, ড. পূরবী বসু, সোহেল মাহমুদ, সালিম হাসান, কামরুল হাসান, মাহমুদ হাফিজ, আনিসুল হক, ইকবাল হাসানসহ আরো অনেকেই যোগ দিয়েছেন। পশ্চিম বঙ্গ থেকে প্রায় নিয়মিত যোগ দিচ্ছেন পার্থসারথি বসু, অনিয়মিতভাবে আসছেন অয়ন ঘোষ, সঙ্ঘমিত্রা চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

কফি ও কবিতার বাই প্রোডাক্ট হিসেবে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ লাইভ অনুষ্ঠানের জন্ম হয়, যুগলবন্দি। সেখানে আমি এবং অন্য আরেকজন কবি, আবৃত্তি শিল্পী, সংগীত শিল্পী বা সংশ্লিষ্ট কেউ থাকেন। কখনো, দুটি বিষয়ের, কখনো দুজন মানুষের যুগলবন্দি হয়। এ পর্যন্ত যোগ দিয়েছেন কবি আসাদ চৌধুরী, কবি সুবোধ সরকার, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, কবি ফরিদ কবির, শিল্পী ফকির আলমগীর, শিল্পী সুজিত মোস্তফা, শিল্পী দম্পতি আরিফ রানা ও সৈয়দা কুমকুম, শিল্পী জীবন বিশ্বাস এবং গবেষক হাসান মাহমুদ। আবৃত্তি শিল্পীদের মধ্যে এসেছেন মেহেদী হাসান, মাহিদুল ইসলাম, আহকাম উল্লাহ।

দুটি অনুষ্ঠানই দুঃসহ করোনাকালের অনন্য সৃষ্টি বলে আমি মনে করি। কফি ও কবিতায় আমরা জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান ও রফিক আজাদকে নিয়ে আলাদা আলাদা অনুষ্ঠান করেছি, আনিসুল হকের মা উপন্যাস নিয়ে একদিন আলোচনা করেছি। আমাদের সাথে হাজার হাজার দর্শক যুক্ত হয়েছেন, হচ্ছেন, তাদের মন্তব্য, সমর্থন, ভালোবাসা আমাদের উৎসাহ যোগাচ্ছে, সমৃদ্ধও করছে। আমি মনে করি এ দুটি অনুষ্ঠান এই করোনাকালের বড় প্রাপ্তি। করোনায় আমরা সবাই অনেক প্রিয়জন হারিয়েছি। তাদের সবার আত্মার শান্তি কামনা করছি। সব পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। এই দুঃসময় যেন খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায় সেই কামনা করছি।

তবুও বলবো দুঃসময় শুধু কেড়েই নেয় না, কিছু দেয়ও। কফি ও কবিতার মতো একটি নান্দনিক এবং বাংলা কবিতার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে পেরেছি, এই প্রাপ্তি খুব সামান্য হলেও আমরা তা মনে রাখতে চাই।

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৫ জুন ২০২০।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক

 

ঢাকা/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়