বেইজিংয়ের জানালা (পর্ব-১)
মোহাম্মদ তৌহিদ || রাইজিংবিডি.কম
ফরবিডেন সিটি, বেইজিং
বেইজিংয়ে আসার পর অনেক জায়গা ঘুরেছি। বেইজিং নামটির সঙ্গে আধুনিক ও প্রাচীন কিছু ভবনের ছবি একসঙ্গে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে তিন হাজার বছর বয়সী এই মহানগরীতে কয়েক হাজার ঐতিহাসিক ভবন রয়েছে। শহরের রূপ প্রতিদিনই একটু একটু করে পরিবর্তন হচ্ছে। এখানে এমনই কিছু আইকনিক ভবনের কথা তুলে ধরা হলো, যা একাধারে ঐতিহাসিক ও আধুনিক বেইজিংয়ের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
সিসিটিভি সদর দপ্তর: সিসিটিভি সদর দপ্তর বেইজিংয়ের ছাওইয়াং জেলায় অবস্থিত। এটি বেইজিং বাণিজ্যিক এলাকা অর্থাত্ সিবিডির অন্যতম আকর্ষণ। চায়না ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের খুব কাছাকাছি এই আকর্ষণীয় ভবনটি। ভবনে তিনটি বিশেষ অংশ রয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সিসিটিভির প্রধান ভবন, উত্তর-পশ্চিম দিকে টেলিভিশনের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে প্রযুক্তিকেন্দ্র।
সিসিটিভি সদর দপ্তরের আয়তন ১.৮৭ লাখ বর্গমিটার। গোটা স্থাপনার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ বর্গমিটার জমি। মূলত এখানে দুটি ভবন রয়েছে। একটি ৫২ তলা, যা ২৩৪ মিটার উঁচু; অন্যটি ৪৪ তলা, যা ১৯৪ মিটার উঁচু। ২০০৪ সালের ২১ অক্টোবর শুরু হয় ভবন তৈরির কাজ, শেষ হয় ২০১২ সালের ১৬ মে মাসে।
২০০৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ‘টাইমস’ ম্যাগাজিন সিসিটিভি সদর দপ্তরকে ২০০৭ সালে বিশ্বের দশটি অসাধারণ স্থাপত্যের অন্যতম হিসেবে নির্বাচন করে।
ন্যাশনাল সেন্টার অফ পারফর্মিং আর্টস: ন্যাশনাল সেন্টার অফ পারফর্মিং আর্টস অর্থাৎ চীনের রাষ্ট্রীয় থিয়েটার বেইজিংয়ের কেন্দ্রে থিয়েন-আন-মেন মহাচত্বরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত। এটি এশিয়ার বৃহত্তম থিয়েটার, চীনের রাষ্ট্রীয় অভিনয় শিল্পের প্রধান হল, দেশ বিদেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বৃহত্তম মঞ্চ এবং চীনা সংস্কৃতির উদ্ভাবন শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
রাষ্ট্রীয় থিয়েটার নির্মাণের সিদ্ধান্ত ১৯৫৮ সালে নেওয়া হলেও, এটি চালু হয়েছে ২০০৭ সালের ২২ ডিসেম্বর। বিভিন্ন কারণে সময় লাগে ৪৯ বছর! এই থিয়েটার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩ বিলিয়ন ইউয়ান। ফ্রান্সের স্থপতি পল অ্যান্দ্রু এর ডিজাইন করেন। থিয়েটারের আয়তন ১.১ লাখ বর্গমিটার। সর্বমোট ১.৬ লাখ বর্গমিটার জমিতে থিয়েটারটি তৈরি করা হয়েছে। এতে থিয়েটার, কনসার্ট হল, নাটকের মঞ্চ, প্রদর্শনী এলাকা, শিল্প বিনিময় কেন্দ্র এবং অডিও ভিডিও দোকান রয়েছে।
থিয়েন-আন-মেন ভবন: থিয়েন-আন-মেন চত্বর চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। থিয়েন-আন-মেন ভবনটিও এখানে অবস্থিত। এখানে রয়েছে চীনের জাতীয় বীরদের স্মরণে স্মৃতি মিনার, প্রেসিডেন্ট মাও চ্যে তুংয়ের স্মৃতি ভবন, যা গণ-মহাভবনের বিপরিত দিকে অবস্থতি। এর আয়তন ৪৮০০ বর্গমিটার। শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যশিল্প এবং বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে থিয়েন-আন-মেন বিশ্ববিখ্যাত।
থিয়েন-আন-মেন ছিল চীনের ইতিহাসের মিং এবং ছিং রাজবংশে বেইজিং রাজপ্রাসাদের প্রধান গেট। ১৪১৭ খ্রিষ্টাব্দে মিং রাজবংশ আমলে এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৬৫১ সালে এর নাম ‘থিয়েন-আন-মেন’ রাখা হয়। থিয়েন-আন-মেন ভবনের দৈর্ঘ্য ৬৬ মিটার ও চওড়ায় ৩৭ মিটার।
১৯২৫ সালের ১০ অক্টোবর বেইজিংয়ের রাজপ্রাসাদ জাদুঘর আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। এ সময় থিয়েন-আন-মেন টাওয়ারও উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর এখানেই গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। থিয়েন-আন-মেন ভবনের ছবি চীনের জাতীয় প্রতীকের মধ্যে স্থান পেয়েছে। এ ভবন এখন গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতীক। ১৯৬১ সালে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ থিয়েন-আন-মেনকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি সংরক্ষণের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
বেইজিং রাজপ্রাসাদ বা নিষিদ্ধ নগর : বেইজিং রাজপ্রাসাদকে ইংরেজিতে বলা হয় ফরবিডেন সিটি। এটি চীনের ইতিহাসের মিং ও ছিং রাজবংশের প্রাসাদ। অতীতে একে নিষিদ্ধ নগরও বলা হত। বেইজিংয়ের কেন্দ্রে থিয়েন-আন-মেন চত্বরের বিপরীতে এর অবস্থান। নিষিদ্ধ নগর চীনের প্রাচীন প্রাসাদ স্থাপত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। এটি বর্তমান পৃথিবীতে সংরক্ষিত সবচেয়ে বড় ও সম্পূর্ণ প্রাচীনকালের কাঠের তৈরি স্থাপত্যকর্ম। ১৯৮৭ সালে বেইজিং রাজপ্রাসাদ ‘বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায়’ অন্তর্ভুক্ত হয়।
সিসিটিভির সদর দপ্তর
রাজপ্রাসাদের বিরাট আকার, সুন্দর নির্মাণশৈলী, সুমহান স্থাপত্যকর্ম ও বিলাসী আসবাবপত্র পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায়। প্রাসাদের আয়তন ১৮০ একর বা ৭৩ হেক্টর। উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে দৈর্ঘ্য প্রায় এক হাজার মিটার, পূর্ব-পশ্চিমে প্রস্থ প্রায় আটশ মিটার। প্রাসাদের চার দিকে দশ মিটারেরও বেশি উঁচু দেয়াল আছে। এর বাইরে দিয়ে প্রাসাদ ঘেরাও করে ৫০ মিটার চওড়া খাল রয়েছে।
বেইজিং রাজপ্রাসাদে অজস্র মূল্যবান পুরাকীর্তি সংরক্ষিত হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজপ্রাসাদে ১০ লাখেরও বেশি মূল্যবান পুরাকীর্তি আছে। সংরক্ষিত পুরাকীর্তির এই পরিমাণ গোটা চীনের মোট পুরাকীর্তির ছয় ভাগের এক অংশ। এসব পুরাকীর্তির মধ্যে অনেকগুলোই হলো অমূল্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ।
গণ-মহাভবন: বেইজিংয়ের থিয়েন-আন-মেন মহাচত্বরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত গণ-মহাভবনটি চীনের রাষ্ট্রীয় নেতারা ও জনসাধারণের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতার কেন্দ্র এবং চীনের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নিদর্শন। গণ-মহাভবন ১৯৫৯ সালে তৈরি হয়। এর মোট আয়তন ১,৭০,০০০ বর্গমিটারেরও বেশি। ভবনটি দেখতে বেশ চমৎকার। হলুদ ও সবুজ টালি দেওয়া ছাদ, উঁচু ও বড় বারান্দার থামগুলো ভবনটির শক্তিশালী রূপ তৈরি করেছে। গণ-মহাভবনে একশ’র বেশি হলঘর ও সভাকক্ষ রয়েছে। প্রতিটি হলঘর ও সভাকক্ষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। গণ-মহাভবনের স্থাপত্যরীতিতে শুধু চীনের ঐতিহ্যিক নকশাই নয়, বিদেশি স্থাপত্যরীতিও প্রদর্শিত হয়েছে। গোটা ভবনের ভেতর ও বাহিরের রূপ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো গণ-মহাভবন গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার দশম বার্ষিকীতে রাজধানীর দশটি প্রধান স্থাপত্যের মধ্যে অন্যতম হিসেবে নির্ধারিত হয়। এটি চীনা প্রকৌশলীদের নিজস্ব নকশা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি হয়েছিল। ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে ভবন তৈরি শুরু হয়, কাজ শেষ হয় পরের বছর সেপ্টেম্বর মাসে। সময় লাগে মাত্র দশ মাস! ৬১ বছর আগে এত অল্প সময়ে বিরাট এ ভবন তৈরি করা চীন ও বিশ্বের স্থাপত্য ইতিহাসের একটি অনন্য রেকর্ড।
বার্ডস নেস্ট : বার্ডস নেস্ট চীনের জাতীয় স্টেডিয়াম। এটি বেইজিং অলিম্পিক উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিক গেমসের প্রধান স্টেডিয়াম ছিল এটি। ২১ হেক্টর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনা। স্টেডিয়ামে ৯১ হাজার আসন রয়েছে। এখানে অলিম্পিক গেমস, প্যারা-অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠান, দৌড়-ঝাঁপ-নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা ও চূড়ান্ত ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। অলিম্পিক গেমসের পর থেকে এটি বেইজিং মহানগরের খেলাধুলা ও ক্রীড়া উপভোগের বৃহত্তম পেশাদার স্টেডিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বার্ডস নেস্ট স্টেডিয়াম চীনের ক্রীড়া স্থাপত্য ও অলিম্পিক গেমসের আইকনিক স্থাপনা। এর নকশা পরিকল্পনা করেন সুইজারল্যান্ডের জ্যাকুইস হারগোস ও পিয়ার দ্য মিউরোন।
স্টেডিয়ামের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে এবং ২০০৮ সালের মার্চে তা শেষ হয়। এই স্থাপনা তৈরিতে খরচ হয় ২.২ বিলিয়ন ইউয়ান। বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক গেমস ২০২২-এর জন্য বার্ডস নেস্ট স্টেডিয়ামে কিছু সংস্কার করা হবে।
চায়না ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার টাওয়ার-থ্রি: চায়না ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার টাওয়ার-থ্রি ২০০৭ সালে তৈরি হয়। সে সময় এটি ছিল বেইজিংয়ের সর্বোচ্চ ভবন। এর উচ্চতা ৩৩০ মিটার ও এর ৮০ তলা রয়েছে। টাওয়ারটি বেইজিংয়ের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক এলাকা-সিবিডিতে অবস্থিত। টাওয়ার তৈরি হলে এর প্রথম দুইটি ভবনের সঙ্গে মিলিয়ে আয়তন দাঁড়ায় ১১ লাখ বর্গমিটার। ভবন তিনটি বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র।
চায়না ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার টাওয়ার-থ্রি তৈরি হয় ৫.৪ লাখ বর্গমিটার জমিতে। এখানে চায়না ওয়ার্ল্ড ট্রেড হোটেল, উন্নত অফিস এলাকা, আন্তর্জাতিক নামকরা ব্র্যান্ডের শপিং মল ও সিনেমা হলের পাশাপাশি আরও আছে একটি ২৩৪০ বর্গমিটার আয়তনের বড় ভোজ কক্ষ।
চায়না ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার টাওয়ার-থ্রি এর উচ্চতা ৩৩০ মিটার, মাটির ওপর ৭৪ তলা ও মাটির নিচে ৪টি তলা রয়েছে। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০৫ সালের ১৬ জুন। রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় ভবন এটি।r
লেখক: বিদেশি বিশেষজ্ঞ, বাংলা বিভাগ, চায়না মিডিয়া গ্রুপ, বেইজিং, চীন।
ঢাকা/সাইফ
আরো পড়ুন