বেইজিংয়ের জানালা (পর্ব-২)
মোহাম্মদ তৌহিদ || রাইজিংবিডি.কম
বেইজিংয়ে আসার পর অনেক জায়গা ঘুরেছি। গত পর্বে চীনের কিছু আইকনিক ভবনের কথা তুলে ধরেছিলাম। আজকের পর্বে থাকছে সামার প্যালেসের কিছু দর্শনীয় স্থানের কথা।
গ্রীষ্মপ্রাসাদ
চীনের বিখ্যাত চারটি বাগানের একটি হলো সামার প্যালেস বা গ্রীষ্মপ্রাসাদ। চীনা ভাষায় বলা হয় ই হ্য ইউয়ান। একদিকে বাগান ও কৃত্রিম হ্রদ, অন্যদিকে পাহাড় ও রাজকীয় প্রাসাদ, অপূর্ব এ সমন্বয়ের ঐতিহাসিক নাম- ‘দ্য সামার প্যালেস’।
রাজধানী বেইজিংয়ের হাইতিয়েন জেলায় বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে এই ঐতিহাসিক উদ্যান। এখানকার লংজিভিটি হিল বা দীর্ঘায়ু পাহাড় এবং উত্তাল জলরাশির ‘খুনমিং হ্রদ’ হলো মূল আকর্ষণ। গ্রীষ্মপ্রাসাদের পাহাড় ও হ্রদসমেত এর আয়তন ৩.০৮ বর্গকিলোমিটার। যার চার ভাগের তিন ভাগই হ্রদ। বিভিন্ন ভবন নির্মাণে ৭০ হাজার বর্গমিটার স্থান ব্যবহৃত হয়েছে। হ্রদের প্রান্তে পাহাড়ের সামনের অংশে রাজকীয় প্রাসাদের অবস্থান। এর পেছনের অংশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হাতছানি। গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সম্পদ রয়েছে। বিশেষ করে হ্রদ, বাগান, প্রাচীন বাড়িঘর ও বিভিন্ন নির্মাণশৈলীর কারণে চীনের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রথম শ্রেণির সংরক্ষিত অঞ্চল এটি।
১৭৫০ সালে প্রথম এই প্রাসাদ তৈরি করা হয়। তখন এর নাম ছিল ছিং-ই ইউয়ান। ১৮৬০ সালে অ্যাংলো-ফরাসি সেনাদের হামলায় বিধ্বস্ত হয় প্রাসাদটি। ছিং রাজবংশের সরকার ১৮৮৬ সালে ফের এর নির্মাণকাজ শুরু করেন। দুই বছর পর নামকরণ করা হয় ই হ্য ইউয়ান। যার অর্থ- সুস্বাস্থ্য ও সমন্বয়ের বাগান। তৎকালীন সম্রাজ্ঞী তওয়াগের ছিসির গ্রীষ্মকালীন অবকাশযাপন কেন্দ্র ছিল এই বাগান-প্রাসাদ। ১৯০০ সালে আবারও বিদেশি আগ্রাসনে বিধ্বস্ত হয় গ্রীষ্মপ্রাসাদ। সে ক্ষতি সারানো হয় ১৯০২ সালে। এরপর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর কয়েক দফা মৌলিক সংস্কার করা হয়। চীন থেকে বিভিন্ন রাজবংশের শাসনামলে পর্যায়ক্রমে এই প্রাসাদ, হ্রদ এবং বাগান গড়ে ওঠে। বিভিন্ন যুদ্ধ, আগ্রাসন বিদ্রোহ ও ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই স্থাপনা একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এরপর আবারও পুনর্নির্মিত হয়। ১৯১৪ সালে ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটি জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ইউনেস্কো প্রাসাদ-উদ্যানটিকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের’ অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। ইউনেস্কো এই স্থাপনা সম্পর্কে বলে- গ্রীষ্মপ্রাসাদ চীনা ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনের অনন্য নিদর্শন।
ওয়েনছাং টাওয়ার
এ স্থানটি গ্রীষ্মপ্রাসাদের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এটি প্রাসাদের পূর্ব গেট থেকে শুরু হয়ে খুনমিং লেকের উত্তর-পূর্ব উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে সম্রাজ্ঞী তাওয়াগের ছিসি এবং সম্রাট কুয়াংসু কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করতেন ও রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো দেখভাল করতেন। ওয়েনছাং টাওয়ারটি প্রথম তৈরি হয় ১৭৫০ সালে, তৎকালীন সম্রাট ছিয়ানলোংয়ের ১৫তম শাসনবর্ষে। ১৮৬০ সালে অ্যাংলো-ফরাসি হামলায় তা নষ্ট হলে ১৮৬০ সালে সম্রাট কুয়াংসু পুনরায় তা তৈরি করেন।
খুনমিং হ্রদ
গ্রীষ্মপ্রাসাদের সবচেয়ে বেশি এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘খুনমিং হ্রদ’। এর সৌন্দর্যও বহুমাত্রিক। শীতকালে বরফাবৃত খেলার মাঠ, গ্রীষ্মকালে উত্তাল তরঙ্গ আছড়ে পড়ে হ্রদের পাথুরে কিনারে। বড় বড় নৌকায় করে পর্যটকরা ঘুরে বেড়ান লেকে। হ্রদের চারপাশ দিয়ে পায়ে চলা পথ আছে, যার দৈর্ঘ্য ১০ কিলোমিটার। এই হ্রদেও বেশকিছু ঐতিহাসিক দর্শনীয় উপাদান রয়েছে। যেমন, ১৭তম ধনুক সেতু, উজ্জ্বল দৃশ্যের প্যাভিলিয়ন, পশ্চিম বাঁধ, মূল্যবান অষ্টকোণ প্যাভিলিয়ন, দক্ষিণ হ্রদ দ্বীপ, তামার ষাঁড়, খুনলুন পাথর ইত্যাদি। প্রতিটি স্থাপনার রয়েছে বৈচিত্র্যময় ইতিহাস। যেমন, ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ধনুকের মতো বাঁকা সেতুটি সম্রাট ছিয়ানলোংয়ের আমলে তৈরি হয়। সেতুর দুই পাশ দিয়ে পাথরের থামগুলোতে পাঁচশ’রও বেশি সিংহ মূর্তি খোদাই করা আছে। মূল্যবান অষ্টকোণ প্যাভিলিয়ন, থেকে এই সেতু সোজা চলে গেছে হ্রদের মধ্যে ‘দক্ষিণ হ্রদ দ্বীপে’। এই দ্বীপেও রয়েছে অনেকগুলো দর্শনীয় ঐতিহাসিক উপাদান। হ্রদের পাশে তামার ষাঁড়টিও বেশ আকর্ষণীয়। সম্রাট ছিয়ানলোং তার আমলে এসব তৈরি করেছিলেন।
লংজিভিটি হিল
বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনার অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে ‘লংজিভিটি হিল’ বা ‘দীর্ঘায়ু পাহাড়ের’ সম্মুখভাগে। বলা যেতে পারে এটাই সবচেয়ে চমৎকার এলাকা। এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলো হলো: দীর্ঘায়ু পাহাড় ও খুনমিং হ্রদ, বুদ্ধের ঘ্রাণ-মঞ্চ, পাওইয়ুন তামার প্যাভিলিয়ন, পঞ্চ স্থানের প্যাভিলিয়ন, জ্ঞানসমুদ্র মন্দির ইত্যাদি। এর মধ্যে দীর্ঘায়ু পাহাড় বা লংজিভিটি হিলের প্রতি মানুষের একটা আকর্ষণ দেখা যায়। ৫৮.৫৯ মিটার উঁচু দীর্ঘায়ু পাহাড় মূলত ইয়ান পর্বতমালার একটি প্রশাখা।
দীর্ঘ করিডোর
‘দীর্ঘ করিডোর এলাকার’ মূলত দুটি অংশ আছে। ওরিওল পাখির (কালো ও হলুদ পালকবিশিষ্ট পাখি) ডাক শোনার করিডোর এবং দীর্ঘ করিডোর। সম্রাট ছিয়ানলোং তার মায়ের জন্য ওরিওল পাখির ডাক শোনার করিডোরটি তৈরি করেন। এখানে সম্রাটের মা অপেরা উপভোগ করতেন। অপেরার জন্য দুই তলা মঞ্চ তৈরি করা হয় সেখানে। প্রাচীনকালে সুন্দর কণ্ঠকে পাখির ডাকের সঙ্গে তুলনা করা হতো। তাই এ হলের নাম হয়েছে ওরিওল পাখির ডাক শোনার করিডোর। এটিও অ্যাংলো-ফরাসি আক্রমণে ধ্বংস হয় এবং পরবর্তী ১৮৬০ সালে সম্রাট কুয়াংসু তা পুনর্নির্মাণ করেন।
১৭৫০ সালে সম্রাট ছিয়ানলোংয়ের তৈরি দীর্ঘ করিডোরটিও ১৮৮৬ সালে পুনরায় তৈরি করেন সম্রাট কুয়াংসু। এটি পূর্ব দিকের ‘চন্দ্র আহ্বান গেট’ থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমের ‘শিচাং প্যাভিলিয়ন’ পর্যন্ত বিস্তৃত; মোট দৈর্ঘ্য ৭২৮ মিটার।
লেখক: বিদেশি বিশেষজ্ঞ, বাংলা বিভাগ, চায়না মিডিয়া গ্রুপ, বেইজিং, চীন।
আরও পড়ুন : বেইজিংয়ের জানালা (পর্ব-১)
ঢাকা/সাইফ
আরো পড়ুন