দ্বিতীয় ধাপে করোনা নিয়ন্ত্রণে স্লোভেনিয়ায় জোনভিত্তিক পরিকল্পনা
রাকিব হাসান রাফি, স্লোভেনিয়া থেকে || রাইজিংবিডি.কম
পৃথিবীর প্রায় ২১৫ টি দেশ ও অঞ্চলের মতো স্লোভেনিয়াও রেহাই প্রায়নি প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ছোবল থেকে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রথম ধাপে স্লোভেনিয়া ছিল করোনা মোকাবিলায় সফল। পাশের দেশ ইতালিতে যেখানে করোনাভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, সেখানে স্লোভেনিয়াতে করোনার প্রকোপ ছিল অনেকটা মৃদু। এবার দ্বিতীয় ধাপে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে জোনভিত্তিক পরিকল্পনা করছে দেশটির সরকার।
গত ১৫ মে ইউরোপের প্রথম কোনও দেশ হিসেবে করোনা মহামারির অবসানের ঘোষণা দিয়েছিল স্লোভেনিয়া। গত মার্চ মাসের চার তারিখে স্লোভেনিয়াতে প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে শুরু করে এ সময় পর্যন্ত স্লোভেনিয়াতে করোনায় আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ১৪০০ এর কিছু বেশি। কিন্তু গত জুনের শেষ থেকে শুরু করে জুলাই কিংবা আগস্টের দিকে দেশটিতে নতুন করে আবারও করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে সীমান্ত সংযোগ স্বাভাবিক করার পর বলকান রাষ্ট্র বিশেষ করে বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়া এসব দেশ থেকে স্লোভেনিয়াতে মানুষের যাতায়াত বৃদ্ধির কারণে দেশটিতে নতুন করে আবারও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তি থাকে। এছাড়াও গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য স্লোভেনিয়ার স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকে ক্রোয়েশিয়ার বিভিন্ন সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টগুলোতে জড়ো হতে থাকেন। অবকাশ যাপন শেষে তারা যখন আবার স্লোভেনিয়াতে ফেরত আসতে শুরু করেন, তখন তাদের অনেকের শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়।
স্লোভেনিয়ার স্থানীয় গণমাধ্যম এসটিএ বলছে, লকডাউন চলাকালীন সময়ে এখানকার জনসাধারণ যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সচেতনতা পরিলক্ষিত হয়েছিলো, লকডাউন শিথিল পরবর্তী সময়ে তাদের অনেকের মাঝে সেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে খুব একটা সচেতনতা দেখা যায়নি। যেটি দেশটিতে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির আরও একটি কারণ।
ফার্স্ট ওয়েভে গোটা ইউরোপের মধ্যে স্লোভেনিয়া করোনা মোকাবিলায় নিজেদের একটি রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল, অথচ সেকেন্ড ওয়েভে এসে দেশটির চিত্র পুরোপুরি বদলে গেছে। যেখানে প্রথম তিন মাস অর্থাৎ মার্চ থেকে শুরু করে এপ্রিল এবং মে এ তিন মাসে দেশটিতে মোট করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিলো ১৪০০ এর কিছু বেশি সেখানে বিগত দুই দিনেই দেশটিতে নতুন করে ১৪০০ জনের শরীরে কোভিড-১৯ এর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় স্লোভেনিয়াতে নতুন করে ৭৪৫ জন প্রাণঘাতী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, দৈনিক সংক্রমণ বিবেচনায় এ যাবতকাল পর্যন্ত যেটি সর্বোচ্চ। প্রতিনিয়ত দৈনিক সংক্রমণের নতুন রেকর্ড হচ্ছে, অথচ ফার্স্ট ওয়েভে মার্চ থেকে শুরু করে এপ্রিল এবং মে এ তিন মাসে দেশটিতে একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল ৭০ জন। এছাড়াও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় স্লোভেনিয়াতে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।
স্লোভেনিয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১০৬৮৩ জন, এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ১৭৬ জন এবং চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ৫৬৮৯ জন।
দ্বিতীয় ধাপে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ডসহ বেশকিছু দেশ ইতিমধ্যে স্লোভেনিয়াকে রেড জোনের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এখন থেকে স্লোভেনিয়া থেকে যদি কেউ এসব দেশে প্রবেশ করেন তাহলে তাদের সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে করোনা টেস্টের নেগেটিভ সনদ বহন করতে হবে। তাদের ১০ থেকে ১৪ দিনের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। প্রতিবেশি দেশ হাঙ্গেরির সাথে বর্তমানে স্লোভেনিয়ার সীমান্ত সংযোগ পুরোপুরিভাবে বন্ধ রয়েছে। ইতালি এবং অস্ট্রিয়ার ক্ষেত্রে কেবল মাত্র নির্দিষ্ট কয়েকটি চেক পয়েন্ট সব জনসাধারণের যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। বাকি চেক পয়েন্টগুলো কেবলমাত্র অস্ট্রিয়া কিংবা স্লোভেনিয়া অথবা ইতালির নাগরিকদের ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে।
সেকেন্ড ওয়েভে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে স্লোভেনিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র স্লোভেনিয়াকে রেড জোন এবং অরেঞ্জ জোন এ দুইটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। যেসব এলাকায় তুলনামূলকভাবে সংক্রমণের হার বেশি, সেসব এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, অন্যদিকে যেসব এলাকায় তুলনামূলকভাবে সংক্রমণ কিছুটা নিম্নগতির সেসব এলাকাকে অরেঞ্জ জোনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পশ্চিম স্লোভেনিয়াতে অবস্থিত গোরিস্কা এবং প্রিমোরস্কা ও উত্তর-পূর্ব স্লোভেনিয়র কিছু অঞ্চলকে অরেঞ্জ জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে শুরু করে বাকি সব অঞ্চল রেড জোনের আওতাভুক্ত।
আজ শুক্রবার (১৬ অক্টোবর) থেকে এ জোনিং সিস্টেম চালু করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্লোভেনিয়ার বর্তমান অর্থমন্ত্রী জিড্রাভকো পোচিভালশেক বিষয়টি জানিয়েছেন। রেডজোনের অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোতে আংশিকভাবে লকডাউন চালু থাকবে। বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া কেউ এক কমিউনিটি থেকে অন্য কমিউনিটিতে যাতায়াত করতে পারবে না।
রাফি/হাসান/সাইফ
আরো পড়ুন