বাংলাদেশি গবেষক ড. আলতাব হোসেনের চীনে সাফল্যের গল্প
নিজস্ব প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম
ড. মো. আলতাব হোসেন
‘মানুষের জন্ম হয় সফলতার জন্য, ব্যর্থতার জন্য নয়’ দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরোর এই উক্তি বাংলাদেশি গবেষক মো. আলতাব হোসেনের ক্ষেত্রে যেনো যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে।
সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ইলেক্ট্রনিক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অব চায়নায় কর্মরত এই গবেষক ‘স্মার্ট চায়না শিক্ষক’ নামে চায়না ভাষা শিক্ষার ইন্টারনেটভিত্তিক প্রোগ্রাম তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
ইন্টারনেটভিত্তিক তাঁর এই প্রোগ্রাম চীনে অনুষ্ঠিত চেংদু-ছংছিং বৈদেশিক শিক্ষার্থী অর্থনৈতিক বৃত্ত (Chengdu-Chongqing Economic Circle Competition for International students) প্রতিযোগিতায় ৬০টি দেশকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অর্জন করেছে।
এর আগে ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক সিস্টার সিটি আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় ইনোভেশন প্রতিযোগিতায়ও তাঁর নির্মিত ওয়েব নির্ভর চীনা ভাষা শিক্ষার সফটওয়্যার (cnpinyin.com) প্রথম পুরস্কার পায়। চীনের মাটিতে ড. আলতাব হোসেন যেনো এক টুকরো সফল বাংলাদেশ।
তবে সাফল্যের এই যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। শত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়া এই মানুষটি কখনও ভাবতেও পারেননি একদিন চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন এবং তাঁর উদ্ভাবনী সফটওয়্যার চীনে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করবে।
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার চেংঠী হাজরাডাঙ্গা ইউনিয়নের চেংঠী গ্রামে বাড়ি ড. আলতাব হোসেনের। মাদ্রাসা শিক্ষক মো. আতাউর রহমানের চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি।
সংসারের অভাব অনটনের মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে নিয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় মনোযোগী তিনি। মেধা তালিকায় প্রথম সারিতে থাকতেন সবসময়। তবে আর দশটি শিশুর চেয়ে খানিকটা ব্যতিক্রম ছিলো তাঁর শৈশব-কৈশর। খেলাধূলার অবকাশ খুব কমই পেয়েছেন। বরং খেলাধূলার সময়টি কেটেছে গরু চরিয়ে বা ফসলের মাঠে। ভুট্টা আর বাদাম ক্ষেতের পরিচর্যা করে। স্থানীয় হাটে নিজেদের জমির শাক-সবজি বিক্রি করে।
এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করেন ড. আলতাব হোসেন। ২০০৬ সালে ভর্তি হন দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। টেলিকমিউনিকেশন অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সুযোগ পান সেখানে। ২০০৮ সালে চীনের একটি প্রতিনিধি দল হাবিপ্রবিতে যায়। সেখানে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম থেকে তাকে চীনে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হয়।
সুযোগ হাতছাড়া করেননি ড. আলতাব। সে বছরই ব্যাচেলর ডিগ্রি শেষ করতে শেন ইয়াং ইউনিভার্সিটি অব কেমিক্যাল টেকনোলজি-তে ভর্তি হন।
তারপর ইউনিভার্সিটি অব ইলেক্ট্রনিক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অব চায়না’য় মাস্টার্স শেষ করে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পিএইচডি করেন। বর্তমানে তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক হিসেবে কর্মরত।
কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশি ব্র্যান্ড ওয়ালটন গ্রুপ-এর গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকৌশলী এবং চায়না অফিসের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
চায়না বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সময় তিন বার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ কমিউনিটির প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এছাড়াও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র পরিষদ আন্তর্জাতিক সংঙ্ঘের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দায়িত্ব পালনকালে তিনি চীনসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সামনে পরিপূর্ণভাবে বাংলাদেশকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁর প্রতিনিধিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কালচার প্রোগ্রামে বাংলাদেশ দল প্রথম স্থান অধিকার করে। পিএইচডি ডিগ্রি করার সময় তিনি টানা তিন বার আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় শিক্ষা শাখায় ও উত্তম দক্ষতা শাখায় পুরস্কৃত হন।
এছাড়াও সেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ কনসুলেট অফিসের বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্য যোগাযোগে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন।
তাঁর ভাষ্যে, ‘আমরা সবাই বিদেশের মাটিতে দেশের প্রতিনিধি। আমাদের প্রত্যেকটি কাজ ও আচরণের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি এখানে প্রকাশ পাবে। সুতরাং আমাদের সবার মেধা, পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে সাফল্যমণ্ডিত অর্জন দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।’
চীনে অবস্থানরত বাংলাদেশি সফল গবেষক ড. আলতাব হোসেনের সঙ্গে সম্প্রতি মুঠোফোনে কথা হয়।
তিনি বলেন, ‘‘দুঃখ-কষ্ট জীবনেরই অংশ। খারাপ সময় ছাড়া ভালো সময় কখনও আসবে না। নিজের কাজ সবসময় ভালোভাবে চালিয়ে যাওয়া উচিত। সাফল্যের শেষ নেই, তাই এখনও নিজেকে সফল দাবি করি না। যদিও এ পর্যায়ে আসতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ছয় সদস্যের পরিবার আমাদের। সাংসারিক সমস্ত খরচ, চার ভাই-বোনের পড়াশোনা- সবমিলিয়ে বাবাকে হিমসিম খেতে হতো। অভাব অনটন ছিলো আপন জনের মতো, পিছু ছাড়ত না।
‘পড়াশোনার ফাঁকে খুব কম সময় পেয়েছি খেলাধূলার জন্য। অবসর সময় ক্ষেতের শাক-সবজি তুলতাম। আমাদের গ্রামে সন্ধ্যায় বাজার বসে। বিকেলে তোলা শাক-সবজি ও গাভীর দুধ নিয়ে বাজারে বিক্রি করে পড়াশোনার খরচ চালাতে হয়েছে।’’
দেশের গর্ব- জ্ঞানী ও বিনয়ী ড. আলতাব হোসেন আরও বলেন, ‘‘এত কিছুর পরেও সবসময় ক্লাসে প্রথম বা দ্বিতীয় থাকতাম। পরিবার সবসময় আমাকে সাপোর্ট করেছে। আপন জনেদের ভালোবাসায় এগিয়ে যেতে পেরেছি। এরপর এইচএসসির রেজাল্ট হলো আশানুরূপ। হাজী দানেশে পড়ার সময় ভার্সিটিতে চায়না থেকে একটা দল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম করে। এক বন্ধুসহ আমি চায়নায় পড়াশোনার অফার পাই। পরিবার আমাকে চায়না পাঠায়। নিজের মেধা, অধ্যাবসায় ও প্রচেষ্টার জোরে আজ আমি চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক।
‘এ পর্যন্ত আসার জন্য আমার পরিবার, শিক্ষক, ও ওয়ালটন পরিবারকে ধন্যবাদ জানাই। আমি খুব কাছ থেকে ওয়ালটনের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা ও মালিকদের দেখেছি। তাদের উন্নত মানসিকতা, চিন্তাভাবনা ছিলো আমার আদর্শ।
‘বিদেশে থাকলেও দেশের জন্য সবসময় মন পোড়ে। এজন্য সময় পেলেই আমি দেশে যাই। করোনার কারণে অনেক দিন হলো দেশে যেতে পারছি না। পরিস্থিতি ভালো হলে অবশ্যই দেশে যাব। দেশ যে কত প্রিয় স্থান বিদেশের মাটিতেই কেবল তা পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধী হয়। তাই দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে ড. আলতাব হোসেন বলেন, ‘স্মার্ট চায়না শিক্ষক প্লাটফর্মের প্রোগ্রামে বাংলা সংস্করণ যোগ করতে চাই। যাতে বাংলাদেশিরা সহজে চায়না ভাষা শিখতে পারেন। স্মার্ট চায়না শিক্ষক আরও আপডেটসহ বিভিন্ন প্রোগ্রাম যোগ করে বিশ্বের সবার হাতে পৌঁছে দিতে চাই। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে আরও বেশি মর্যাদার আসনে বসাতে চাই। আমার চলমান গবেষণা, চায়নার কাজের অভিজ্ঞতা ও গঠনমূলক কাজগুলো বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে চাই।’
ভবিষ্যতে চীন ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও ভালো সাফল্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন ড. আলতাব হোসেন।
চীন/সনি
আরো পড়ুন