ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বেইজিংয়ের জানালা (পর্ব-৯)

মোহাম্মদ তৌহিদ, চীন থেকে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৪২, ১৯ ডিসেম্বর ২০২০  
বেইজিংয়ের জানালা (পর্ব-৯)

চীনের প্রচলিত একটি প্রবাদ হলো- উন্নত হতে হলে আগে রাস্তা তৈরি করতে হয়। চীন সরকার এ প্রবাদকে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে কাজে লাগিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ক্রমবর্ধমান ও দ্রুত পরিবর্তনশীল এক মহানগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা তুলে ধরা কিছুটা জটিল। সবকিছুতেই বেশ দ্রুত উন্নয়নমুখী পরিবর্তন হয়। এর সঙ্গে তাল রাখা কঠিন।

২০১০ সাল পরবর্তী ১০ বছরে বেইজিংয়ের ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যম প্রাইভেটকার এবং ভাড়ায় চলা ট্যাক্সির সংখ্যা, গুণগত মান ও সড়কের সংখ্যা ব্যাপক বেড়েছে। গণপরিবহনের রুট বেড়েছে এবং বাড়ছে। মহানগরের সড়কে নতুন নতুন যাত্রীবাহী আরামদায়ক বাস নামানো হচ্ছে। অবশ্যই এসব বাস ও গাড়ি বেশিরভাগই বিদ্যুৎচালিত, অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব। মহানগরীর ভূগর্ভস্থ পথে ছুটে চলা সাবওয়েতে ৭টিরও বেশি নতুন রুট খোলা হয় এ সময়।  আরও অনেকগুলো নতুন রুট চালু হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।  উড়াল সড়ক, টানেল, মহাসড়ক নির্মাণকাজ অব্যাহত রয়েছে। এ উন্নয়নের যেন শেষ নেই। 

বেইজিংয়ে রয়েছে আধুনিক ত্রি-স্তরের ট্রাফিক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা যা ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন দিক থেকে সুপ্রশস্ত মহাসড়কগুলো রাজধানীতে এসে মিলেছে। এতে করে বেইজিং চীনের যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মহানগরীতে বর্তমানে ৩টি সচল বিমানবন্দর রয়েছে। বেইজিং নানইউয়ান এয়ারপোর্ট সামরিক বিমানবন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হলেও তা মূলত সেকেন্ডারি এয়ারপোর্ট হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এটি বেইজিংয়ের প্রধান বিমানবন্দর কোম্পানির অধীনে পরিচালিত হয়। তবে, বেইজিং তাসিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পূর্ণ কার্যকর হলে নানইউয়ান বিমানবন্দরের বেসামরিক কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার কথা রয়েছে।

বেইজিং তাসিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবন্দর। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি যাত্রীসেবা দিতে সক্ষম একমাত্র বিমানবন্দর। বেইজিংয়ের কেন্দ্র থেকে এটি সরাসরি ৬৭ কিলোমিটার দক্ষিণে এর অবস্থান। ২০১২ সাল থেকে এর নির্মাণ শুরু হয়। বৃহদাকার ও অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ বিমানবন্দরের মৌলিক নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৯ সালে। বার্ষিক ৭ কোটি ২০ লাখ যাত্রীসেবা এবং ২০ লাখ মেট্রিকটন কার্গো পরিবহন করবে তাসিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।

সর্বশেষ এক হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন বিশ্বের ৬০টি দেশের ২২২টি বিমানবন্দর থেকে ৯০টিরও বেশি বিমান কোম্পানির ১৭০০ বিমান বেইজিংয়ে ওঠানামা করছে। এসব বিমানে যাতায়াতকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি।

বেইজিংসহ পুরো চীনকে ‘স্মার্ট ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবস্থার’ আওতায় আনার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০১৫ সালে, যখন চীন সরকার ‘মেড ইন চায়না’ কার্যক্রম জোরদারের ঘোষণা দেয়। ত্রয়োদশ পাঁচসালা পরিকল্পনার মধ্যে ‘আধুনিক সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৭ সালে। ২০২০ সাল নাগাদ নিরাপদ, উপযুক্ত, সবুজ ও আধুনিক সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়। এ লক্ষ্যে, মোটরগাড়ি শিল্পের জন্য ‘মধ্যবর্তী ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা’ নেওয়া হয় ২০১৭ সালের এপ্রিলে। এতে মোটরগাড়িকে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক যোগাযোগের’ মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বেইজিংয়ের মোটরগাড়ির পরিমাণ প্রায় ৬০ লাখ। যা পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে ১,৯২,০০০টি বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ১৪৪,০০০ হাজার বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ লাখ ৮০ হাজার। 

পরিসংখ্যান অনুযায়ী বেইজিংয়ে বর্তমান সড়কের দৈর্ঘ্য ২২,২৪২ কিলোমিটার। এর মধ্যে মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ১০১৩ কিলোমিটার। এছাড়া, শহুরে পথের দৈর্ঘ্য ৬৩৬০ কিলোমিটার। মহানগরীর কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ দীর্ঘপথ তৈরি করেছে বেইজিং। 

মহানগরীকে ঘিরে রয়েছে ৭টি ‘রিং রোড’।  সর্বশেষ সপ্তম রিং রোডটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৮ সালের জুলাই মাসে।  এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০০ কিলোমিটার। এই মহাসড়কটি বেইজিংয়ের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী শহরের সংযোগ ঘটিয়েছে। মূলত, ‘বেইজিং-থিয়েনচিন-হ্যপেই সমন্বিত অঞ্চলের’ বাস্তব সংযোগ ঘটিয়েছে সপ্তম রিং রোড। 

বেইজিংয়ের সাবওয়ে (মাটির নিচ দিয়ে চলা ট্রেন) বিশ্বের ব্যস্ততম পরিবহন ব্যবস্থা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাধারণত প্রতিদিন ৯.৯৯৮ মিলিয়ন মানুষ বেইজিংয়ের সাবওয়ে ব্যবহার করে থাকে।  অন্যদিকে ব্যস্ততম দিনগুলোতে দৈনিক যাত্রীর সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ পর্যন্ত পৌঁছায়।  

বেইজিংয়ের সাবওয়ে বিশ্বের অন্যতম আধুনিক সাবওয়ে ব্যবস্থা এবং এটি বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সাবওয়ে ব্যবস্থা। আর, দীর্ঘতম সাবওয়ে/মেট্রো রয়েছে চীনের শাংহাই শহরে। অর্ধ শতাব্দী আগে ১৯৬৯ সালে প্রথম বেইজিংয়ের সাবওয়ে চালু হয়। চীনের মূল ভূখণ্ডের প্রথম সাবওয়ে বেইজিং সাবওয়ে।  

বর্তমানে বেইজিং সাবওয়েতে ২৫টি সচল লাইন রয়েছে। উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে আরও কয়েকটি। ব্যবহারযোগ্য লাইনের দৈর্ঘ্য ৬০৯ কিলোমিটার। সাবওয়েতে ব্যবহৃত ট্রেনের পরিমাণ ৫২১০টি এবং এসব ট্রেন বার্ষিক ৩৭৮ কোটি যাত্রী পরিবহন করে। 

সবচেয়ে পুরাতন হলো ‘বেইজিং স্টেশন’, যা মহানগরের কেন্দ্রে অবস্থিত।  এই রেল স্টেশনটি ১৪ হাজার মানুষ ধারণ করা ক্ষমতা রাখে।  মহানগরীর পূর্ব ও উত্তর দিকের ট্রেনগুলো এখান থেকে যাত্রা করে। 

এরপর ১৯৯৬ সালে তৈরি হয় ‘পশ্চিম রেল স্টেশন’। এটি এশিয়ার বৃহত্তম রেল স্টেশন। ৭২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে এটি তৈরি হয়।  সাড়ে ৫ মিলিয়ন বর্গফুট আয়তনের এই রেল স্টেশনটি ‘বেইজিং স্টেশনের’ চেয়ে ১০ গুণ বড়।  এটি তৈরিতে ২০ হাজার শ্রমিক টানা তিন বছর কাজ করেছিলেন। বেইজিংয়ে আগত বেশিরভাগ ট্রেন এখানেই থামে, বিশেষ করে দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলীয় ট্রেন। শহরের কেন্দ্র থেকে পশ্চিম রেল স্টেশনটির দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। 

এই রেল স্টেশনের সঙ্গে শহরের সাবওয়ে ব্যবস্থার যোগাযোগ আছে। এছাড়া, রেলযাত্রীদের সুবিধার্থে স্টেশন থেকে পর্যাপ্ত ট্যাক্সি ও শহরের বিভিন্ন অঞ্চলগামী বাসের স্টপেজও রয়েছে। 

প্রধান দুটি রেল স্টেশনের পাশাপাশি বেইজিংয়ের দক্ষিণে ইয়োংতিংমেন রেল স্টেশন বা বেইজিং দক্ষিণ রেল স্টেশন এবং সিচ্রিমেন বা বেইজিং উত্তর রেল স্টেশনও রয়েছে।  তবে দীর্ঘ দূরত্বের ও প্রধান রুটের ট্রেনগুলো বেশিরভাগই ‘বেইজিং স্টেশন’ ও ‘বেইজিং ওয়েস্ট স্টেশন’ থেকে ছেড়ে যায়।

লেখক:  বিদেশি বিশেষজ্ঞ, বাংলা বিভাগ, চায়না মিডিয়া গ্রুপ, বেইজিং, চীন।

ঢাকা/সাইফ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়