প্রবাস

ব্রেইজ

নাতালিয়ার গল্প বলি। নাতালিয়া আমার সহকর্মী ডানার বোন। ডানার বয়স ২৯ আর নাতালিয়ার ২৭। দুই বোনই সুন্দরী, কিছুটা নাদুস-নুদুস টাইপের মেয়ে আর খুব আহ্লাদি। কথা বলে নাকি সুরে। ঢং জেনারেশনের ট্রু প্রতিনিধি। যখন-তখন যেখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলা নাতালিয়ার একটি প্রধান কাজ। ওকে সেলফি জেনারেশনের অন্যতম প্রতিনিধিও বলা যায়।

ওদের বাসায় দাওয়াত। রমজান মাসে খ্রিস্টানের বাসায় দাওয়াত? প্রথমে এই রকম একটা ধাক্কা খেলেও হাসি হাসি মুখে বলি, কবুল। তবে সাড়ে আটটার আগে কেউ কিছু খেতে পারবে না। তোমরা খাবে আর আমি দেখব এটা হবে না। ডানা রাজি। ওদের বাসা এস্টোরিয়ায়। ইস্ট নদীর পাড়ে নয়নাভিরাম এস্টোরিয়া পার্ক। পার্কের পেছনেই একটি আড়াই কামড়ার অ‌্যাপার্টমেন্টে থাকে ওরা। ভাড়া বাসা। দুই বোন আর ওদের মা সোফিয়া। সোফিয়াও অসম্ভব সুন্দরী। মসৃণ ত্বক, ডাই করা লম্বা, কালো চুল। এভারেজের চেয়ে একটু খাটো। তবে স্লিম ফিগারের কারণে খাটোটা তেমন চোখে পড়ে না। সোফিয়ার বয়স ৪৫। দুই বছর আগে ব্রেক আপ হয়ে গেছে। তিন মা-মেয়ে এখন একসাথে থাকে।

ডানার বয় ফ্রেন্ড আছে। মাঝে মাঝে এসে থাকে এখানে। ওর নিজেরও বাসা আছে। ডানা ভাবছে যেকোনো দিন ও পেড্রোর বাসায় গিয়ে উঠবে। কথাটা মা আর বোনকে কিভাবে বলবে তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছে। নাতালিয়ারও বয়ফ্রেন্ড আছে, হোসে, তবে ওকে নিয়েই সমস্যা। সেই গল্প বলার জন্যই লিখতে বসেছি।

তিন স্পেনিশ নারীর অ‌্যাপার্টমেন্টটি ঝকঝকে তকতকে করে সাজানো। যেখানে যা থাকা দরকার সেখানে ঠিক তা-ই আছে। সোফিয়া মেডিক‌্যাল অ‌্যাসিস্ট্যান্ট। কাজ করে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে। নাতালিয়া আজ এখানে তো কাল ওখানে, রোজই কাজ ধরে আর ছাড়ে। এখন সে কাজ করে সিভিএস ফার্মেসিতে।

ওদের লিভিং রুম থেকে এস্টোরিয়া পার্ক দেখা যায়। জায়গাটি আমার চেনা। বছর তিনেক আগে আমিও এই পার্কের কাছেই একটি ছোট্ট অ‌্যাপার্টমেন্টে থাকতাম। গাছপালাগুলো গ্রীস্মের হাওয়ায় অনেক পাতা ছেড়েছে। আমি উড়ন্ত পত্র-পল্লবের ফাঁক দিয়ে ইস্ট নদীর ঢেউ দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করি। ডানা ব্যস্ত টেবিল সাজাতে। আজ ৮টা ৩১ মিনিটে ইফতারি, ডানাকে আমি আগেই জানিয়ে রেখেছি। এও বলে রেখেছি যে ৮টা ৩১ হলেই আমি তাড়াহুড়ো করে খেতে শুরু করবো। তোমার মা আর বোনকে বলে রেখো এটাই মুসলমানদের নিয়ম। আমাকে যেন আবার হাভাতে না ভাবে।

শব্দটা নাতালিয়ার বেডরুম থেকেই আসছে। কাঠের ফ্লোরের ওপর জোরে জোরে পায়ের গোড়ালি দিয়ে আঘাত করার শব্দ। আমি জানালা থেকে মুখ ফেরাই। ডানা তাকায় আমার মুখের দিকে। আমি কোনো প্রশ্ন করি না কিন্তু আমার চোখ প্রশ্ন করে। ডানার চোখ তা পড়ে ফেলে। আমাদের পরিবারে একটি বড় ধরনের ক্রাইসিস হয়েছে। আমি কি চলে যাব? আমি ভদ্রতা করি। ডানা বলে, না না, যেতে হবে না। আমি খুব লজ্জিত যে আমার মা আর বোন এখনো এখানে আসছে না। আমি বলি, অসুবিধা নেই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মা-মেয়ে গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে আসে। দুজনের পরনেই খুব খোলামেলা পোশাক। হাঁটার ছন্দে দুলছে ওদের প্রদর্শিত সৌন্দর্য। আমরা সবাই ডাইনিং টেবিলে বসি। আটটা বাজে। এখনো ইফতারির ৩১ মিনিট বাকি। হঠাৎ নাতালিয়া ভেঁ করে কাঁদতে শুরু করে। ওর চোখের জলে বুরিতো ভেজে, পায়েলা ভেজে, এম্পানাদা ভেজে, গুয়াকোমালি ভেজে। কাঁদতে কাঁদতেই গোটা দুই/তিনেক সেলফি তোলে নাতালিয়া। নিশ্চয় এক্ষুনি ফেসবুকে পোস্টিং দেবে। আর সাথে সাথেই ওর বয়ফ্রেন্ড ওকে ফোন করবে। আমি মোটেও অপ্রস্তুত বোধ করি না। ডানা করে। এক পর্যায়ে ওদের বোতলের ছিপি খুলে যায়। ওরা আমাকে জাজ সাহেব বানিয়ে সবিস্তারে বড় ধরনের ক্রাইসিসটি খুলে বলতে শুরু করে।

নাতালিয়ার বয়ফ্রেন্ডকে সোফিয়া কিছুতেই মেনে নিচ্ছে না। হোসের দোষ একটাই, ওর দাঁত সুন্দর না, এবড়ো-থেবড়ো। নিশ্চয়ই এবড়ো-থেবড়ো দাঁতের বাচা-কাচ্চা হবে ওদের। বাচ্চাদের ব্রেইজ পরাতে হবে। ব্রেইজের টাকাতো ইনস্যুরেন্স দেবে না। এত টাকা মেয়ে কোথায় পাবে? না, না, কিছুতেই মেয়েকে এমন ঝামেলায় পড়তে দেয়া যাবে না। বিষয়টি খুব সিরিয়াস। ডানাও মায়ের সাথে যোগ দেয়। নাতালিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করে। হঠাৎ করেই তিনজন একসাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। ঘরটি হঠাৎ মৌনতার অস্বস্তিতে ডুব দেয়। আমার কাছে মনে হয় হঠাৎ থিয়েটার হলের বিদ্যুৎ চলে গেছে। পরক্ষণেই লক্ষ করি, তিন জোড়া চোখই আমার মুখের ওপর। অর্থাৎ যুক্তিতর্ক শেষ এখন জাজ সাহেবের রায় শোনার জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। আমি সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত গলায় বলি, আপনার প্রথম বয়ফ্রেন্ডের ব্রেইজের টাকা কে দিয়েছিল? সোফিয়া খানিকটা নড়ে-চড়ে বসে। কেউ দেয়নি। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়েছিল। বলেই যেন কি অপরাধ হয়ে গেল, মুখে এমন একটি অভিব্যক্তির ঢেউ তোলে সোফিয়া। ওর গভীর কালো চোখ দুটিতে অস্বস্তির ম্রিয়মান দৃষ্টি। দুই মেয়ে একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে, ‘হু ওয়াজ দ্যাট?’ এরপর আবার নীরবতা। কয়েক সেকেন্ড। এবার কথা বলে ডানা। মা, আমার যখন জন্ম হয় তখন তোমার বয়স ষোল, টিন মাম। বাবার আগে তোমার আরেকজন ছিল? কখনো বলোনি কেন? ছোট মেয়েও সাথে যোগ করে, ‘কেন?’ লিসেন বেবিজ, চিৎকার করো না। তোমাদের বাবা সব জানতো। ওরা বন্ধু ছিল। ব্রেইজের টাকার জন্য কার্লোসকে অনেক কষ্ট করতে হয়। ওর বাবা-মা ছিল না। স্কুলের পরে সুপারমার্কেটের স্টোর রুমে কাজ করতো সে। তাতেও সব টাকা জোগাড় হয় নি, আমার যা সঞ্চয় ছিল তাও দিয়েছি। পরে তোমাদের কথা চিন্তা করে, মানে বাচ্চা-কাচ্চার কথা চিন্তা করে ওকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেই।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক, জাতিসংঘে কর্মরত ঢাকা/সাইফ