প্রবাস

চিকিৎসকদের ‘সেফটি ফার্স্ট’

পৃথিবী এখন সাড়ে সাতশ কোটি মানুষকে নিয়ে একটি করোনার কারাগার। বিশ্বে এক যোগে এত সহজে অতিদ্রুত মানুষ মরতে পারে তা কোভিড-১৯ দেখিয়ে দিচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রতিটি মুহূর্তে চোখ রাখলেই দেখতে পাই আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ভয়াবহ একটি সময় অতিক্রম করছে মানুষ।

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে সমাজের সব পেশার লোকই করোনা মোকাবিলায় কাজ করছে।  করোনা মোকাবিলায় সামনের সারিতে আছেন চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী। এসব পেশাজীবীর মধ্যে বেশ কয়েকজন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের সুরক্ষার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।

তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে।  আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে করোনা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।

দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইতালি, বাংলাদেশসহ বিশ্বে অনেক দেশেই এমন পরিস্থিতির মধ্যেও দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনায় সংক্রমিত হয়ে অনেক চিকিৎসক মারা গেছেন।

সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো.  মঈন তিনিও দেশের এই ক্রান্তিকালে দূরে ঠেলে দেয়নি করোনা আক্রান্ত রোগীদের।  নিজেকে আত্মোৎসর্গ করেছেন দেশের জন্য।  যার ফল ৫ এপ্রিল হয়েছেন করোনা আক্রান্ত।  তার কয়েকদিন পরেই চলে যান ফেরার দেশে।  ডা. মঈন-এর মতো বিশ্বে যারা দেশের মানুষকে করোনো থেকে সুস্থ করতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন এমন ব্যক্তিদের স্যালুট।

১৯ এপ্রিল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের পাঁচ চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।  হাসপাতাল সূত্র জানায়, আক্রান্ত ৫ জনের মধ্যে দুজন মেডিসিন বিভাগ, একজন শিশু বিভাগ, একজন অবেদনবিদ্যা বিভাগ ও একজন বহির্বিভাগের চিকিৎসক। এছাড়াও খুলনা মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসকের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

চিকিৎসকদের পিপিই আর ব্যবস্থাপনা ত্রুটির কারণে রোগ ছড়াচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকির বিষয়টি সারা বিশ্বে এখন আলোচিত হচ্ছে।  হাসপাতাল দ্রুত তৈরি করা সম্ভব হলেও স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করা সম্ভব নয়।

একটু ভেবে দেখুন তো চিকিৎসকদের ভূমিকার কথা। একটু ঠান্ডাজনিত সমস্যা হলেও আমরা তাদের শরণাপন্ন হই। আর করোনা খুবই ছোঁয়াচে প্রকৃতির। সেখানে এত সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।  আমরা সাধারণত অসুস্থ হলে আমাদের বাবা-মা মাথায় হাত বুলিয়ে একটু সেবা-সান্ত্বনা পেয়ে থাকি যা আমাদের ওষুধের চেয়ে বেশি কার্যকর মনে হয়। এই মরণব্যাধি করোনাতে আক্রান্ত হলে তার সবচেয়ে প্রিয় মা-বাবা থেকে শুরু করে কাউকে কাছে পায় না। সে সময় তার সেবাকারী সবচেয়ে আপন এবং কাছের মানুষটি হচ্ছে চিকিৎসক। বিশ্বের সকল চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম আর ত্যাগ স্বীকার করে দায়িত্ব পালন যাচ্ছেন। তাই চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ডাক্তারদের পিপিই প্রদানের কোনো ধরনের ঘটতি থাকতে পারবে না।  কারণ, একজন ডাক্তার সংক্রমিত হলে অন্যরাও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কিছুদিন আগেও বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলতে গিয়ে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বেশ কজন ডাক্তার তাদের এবং তাদের পরিবারের সুরক্ষা নিয়ে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।  ঢাকার মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের একজন চিকিৎসক, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রণোদনার দরকার নেই, আমাদের দরকার সুরক্ষার। মরে গেলে প্রণোদনা দিয়ে কী করবো।’

বিবিসির একটি প্রতিবেদনে ডাক্তার এবং মেডিকেল ছাত্রদের সংগঠন বিডিএফ বলছে অনলাইনে তাদের এক চলতি জরীপে অংশ নেওয়া সদস্যদের ৯৫ শতাংশই তাদের সুরক্ষা নিয়ে শঙ্কার কথা বলেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, কিছু ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীরা হাসপাতালের বাইরে তাদের বাড়িতে কিংবা সমাজের অন্য কোথাও থেকে সংক্রমিত হচ্ছেন।  অনেক স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হয়েছেন বিশ্রামহীন টানা অধিকসংখ্যক রোগীকে সেবা দিয়ে যাওয়ায়।

করোনাভাইরাসে দেশে স্বাস্থ্য সরঞ্জামের সংকটে উদ্বিগ্ন আছেন চিকিৎসকেরা। বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার বাংলাদেশি প্রবাসীরা। একদল তরুণের সমন্বয় উদ্যোগে ‘কোরিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি’র ব্যানারে প্রবাসীদের সহযোগিতায় একটি ফান্ড তৈরি করে। সেই ফান্ডের ৪০ শতাংশ অর্থ থেকে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জন্য সাতশ সেট পিপিই বিনামূল্যে বণ্টনের জন্য ঢাকা মেডিসিন ক্লাবের কাছে হস্তান্তর করে। বাকি অর্থ দিয়ে গরিব- অসহায়দের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করবে কোরিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

প্রবাসীদের পাশাপাশি দেশের সকল সেবাধর্মী সংগঠন বা বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।  যা করোনা প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখবে এবং দেশের সব নাগরিক করোনার সংক্রমণ থেকে মুক্ত হতে পারবে।  চিকিৎসা সেবাকে মানসম্মত রেখে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, হংকং, ম্যাকাও, ভিয়েতনাম, রাশিয়া, তাইওয়ান, জার্মানি, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো করোনা মোকাবিলায় দেখিয়েছে দারুণ সাফল্যও।  করোনা প্রতিরোধে ফ্রণ্টলাইন যোদ্ধা চিকিৎসকদের ‘সেফটি ফার্স্ট’ হতে হবে তাহলে আমাদের দেশেও করোনার সংক্রমণ থেকে মুক্ত হতে পারবে। সাইফ/নাসিম