প্রবাস

রক্তে কেনা মাতৃভাষার চর্চা হোক সর্বত্র

মাতৃভাষায় মনের ভাব আবেগ-উচ্ছ্বাস প্রকাশে অধিকারের জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার নজির কেবল বাংলাদেশেরই আছে। বাংলাই সেই গৌরবান্বিত ভাষা। ভাষার ইতিহাস কারও অজানা নয়। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে যখন দু’চোখ মেলি ঠিক তখন আমাদের দৃষ্টির সীমানায় মানুষ ছাড়াও ধরা দেয়, বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি তথা বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি জগৎ।

শুনতে পাই মানুষ ও প্রকৃতি জগতের বিচিত্র ভাষা। আসলে ভাষা মানুষের অস্তিত্বে যেমন বিরাজমান, তেমনি বিরাজমান প্রকৃতির অস্তিত্বেও। তাই তো সবাই নিজের মতো করে কথা বলে বিচিত্র ভঙ্গিমায়, নানা ইশারায়।  বলা হয়, ভাষা আছে বলেই এতো প্রাণচঞ্চল ও আনন্দময় এই পৃথিবী । 

ভাষা সর্বত্র বিশ্বময় যোগাযোগের সেতু। মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি, আরবি, কোরিয়ান, জাপানিজ ইত্যাদি ভাষা শিক্ষা এবং পারদর্শিতা হাজারো সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে বাংলাদেশিদের। দিন দিন বিশ্বের সাথে যোগাযোগের পথ প্রসারিত হচ্ছে। যা জীবন ও জীবিকার কাজে সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। পৃথিবী নামক গ্রহে প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আমাদের প্রবাসীরাই মাতৃভাষার পাশাপাশি কয়েকটি ভাষা পারদর্শি হয়ে থাকেন তারা। ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের লোকেরা স্বীকার করতে বাধ্য হতো যে বাঙালি মেধাবী জাতি। তবে তৃপ্তি নেই যে শব্দচয়নে যদি না থাকে বাংলা। বিদেশের মাটিতে চলার পথে হঠাৎ কোথাও থেকে যদি একটি বাংলা শব্দ ভেসে আসে তখন কলিজাটা অনেক বড় হয়ে যায়। মাতৃভাষার প্রতি প্রবাসীদের আবেগ জড়ানো অন্যরকম একটি টান। 

চলছে ভাষার মাস, রাত পোহালেই ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখ। আমরা স্মরণ করবো যাদের রক্তে কেনা আমারা মাতৃভাষা বাংলা পেয়েছি তাদেরকে। বিশ্বজুড়ে একটাই সুর ধ্বনিত হবে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’। তার পরের দিন থেকে আমরা ভুলে যাই বাংলা ভাষার কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা ও শুদ্ধ প্রয়োগ। আমি একটু বলতে চাই, মাতৃভাষার ভালোবাসা এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ যদি দেখতে চাই তাহলে দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে তাকাতে হবে।

কোরিয়ার জাতীয় ভাষা হ্যাঙ্গুল। প্রতি বছর ৯ অক্টোবর হ্যাঙ্গুল ডে (কোরিয়ান ভাষার দিন) পালন করা হয়। কোরিয়ার ভাষা তৈরি করেছেন কিং সেজং।  কোরিয়ানরা কেবল একটি ভাষাতেই তারা কথা বলেন এবং লেখেন। বিশ্বের বেশিরভাগ রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী অনুসারে তারা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় আপনি সারা দেশে একটি মাত্র ভাষা পাবেন। পার্থক্যটি হলো স্পিকিং অ্যাকসেন্ট বা ডায়ালেক্ট কিছু আলাদা। কোরিয়ান লোকেরা তাদের ডাকে 사투리 (সাথুরি)। রাজা সেজং নিজে হ্যাঙ্গুয়েলের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘একজন জ্ঞানী ব্যক্তি সকাল শেষ হওয়ার আগেই হ্যাঙ্গুলের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে এবং একজন বোকা লোক মাত্র দশ দিনের মধ্যে এই ভাষা এটি শিখতে পারে।’

কোরিয়ানরা এই দিনে সেজং রাজার কথা স্মরণে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। এ আয়োজনের মধ্যে তারা সিমাবদ্ধ নয়। তাদের সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, শিল্প-কলকারখানা থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করে থাকেন।  ইংরেজি ভাষার ব্যবহার একদম নেই বললেই চলে।  তারা ইংরেজি জানলেও খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করেন না। আপনি যদি তাদের মোবাইল নম্বর জানতে চান তাও তারা তাদের ভাষাতেই বলবে, যা আমরা ইংরেজি ছাড়া বলি না। সাধারণত আমাদের  কেউ ফোন করলে আমরা ফোনটা ধরেই বলি hello ‘হ্যালো’ তবে কোরিয়ানরা কখনো এই শব্দটা ব্যবহার করতে দেখি নাই। ফোনটা ধরেই তাদের ভাষায় 여보세요 (ইয়ভোসেইউ) বলে থাকেন। 

এখানে ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশন বা ওষুধের ব্যবস্থাপত্রটিও কোরিয়ান ভাষায়। আর ওষুধের গায়ে ভাষাটিও তাদের নিজস্ব। তাদের ভাষার সফটওয়্যার দিয়েই তারা কম্পিউটার ব্যবহার করে থাকেন। ভিনদেশী নয় নিজের ভাষাকে সহজ এবং ছোট করে বলতে কোরিয়ানরা বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এক কথায় মাতৃভাষার ভাষার প্রতি ভালোবাসা তার প্রয়োগের অনন্য দৃষ্টান্ত দক্ষিণ কোরিয়া।

বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ থেকে শুধু মাত্র কোরিয়ান ভাষাদক্ষ ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ঠাঁই হয় এদেশে। ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে বিশেষ চুক্তিতে কোরিয়ান ভাষা শিখার মাধ্যমে তের হাজারেরও বেশি বাংলাদেশির বসবাস এই কোরিয়াতে। 

বিশ্বের যেখানেই বাংলা ভাষাভাষীরা আছেন সেখানেই আছে আমাদের গৌরবের শহীদ মিনার। তবে স্থায়ী হোক আর অস্থায়ী হোক, বিদেশের মাটিতে বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশিদের গৌরবের মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকাটাই সম্মানের। রাজধানী সিউলের অদূরে আনসান শহরে কোরিয়ার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক স্থায়ী শহীদ মিনার। এই মিনারে বাঙালিসহ অন্যান্য ভিনদেশি ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়।  প্রতি বছরই কোরিয়ায় অবস্থানরত প্রবাসীরাসহ বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। 

তবে আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে আরেকটি সমস্যা এখন প্রকট৷ সেটা হল বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে এক অদ্ভুত ভাষা তৈরি৷ আর ইরেজি উচ্চারণে বাংলা শব্দ উচ্চারণের প্রবণতা দেখা যায়৷ আর এই প্রবণতা টেলিভিশন, এফএম রেডিও থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রকট আকার ধারণ করছে৷

আমাদের দেশে একশর বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে৷ এর মধ্যে কয়েকটির নাম বাংলায়৷ বাকি সবগুলোর নাম ইংরেজিতে৷ এই নামগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই যে এগুলো আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়৷ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে আইন করে বলে দেওয়া আছে নেপালি ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় শিক্ষা প্রতষ্ঠানের নাম থাকতে পারবে না৷ থাকলে সরকারের অনুমোদন পাবে না৷

পরীক্ষায় যে ছেলে/মেয়েটি ইংরেজিতে ‘এ’ প্লাস পায় সে নাকি বাংলায় ফেল করে। যদি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দিকে তাকাই একই। বাংলা চলচ্চিত্রে ইংরেজি নাম। গানের কথাও একই অবস্থা এটা আমাদের সংস্কৃতির জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ডের নামটিও ইংরেজিতেই সমধিক পরিচিত। চলচ্চিত্রে ইংরেজি নাম বাতিল করার পাশাপাশি সেন্সর বোর্ডের নামও পরিবর্তন করে বাংলায় করা উচিৎ বলে মনে করছেন চলচ্চিত্রবোদ্ধারা। আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে এখন বিদেশের অপসংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে তাই ভাষাগত পরিবর্তনও দেখা দিয়েছে।

তাছাড়াও কিছু মানুষ দেখা যায় বক্তৃতায়, টকশো কিংবা ইন্টারভিউতে অর্ধেক ইংরেজিতে, অর্ধেক বাংলায় বলে। মনে হয় যেন তাদের মাতৃভাষাটা ইংরেজি, অনেক কষ্ট করে বাংলা বলছেন। 

ইচ্ছার বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলাভাষা ব্যবহারের আইন আছে৷ সংবিধানেও বলা হয়েছে রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা৷ অথচ এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা যায়নি৷ বিশ্লেষকরা এক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করছেন৷ সমস্যা পরিভাষার নয়, ইচ্ছাশক্তির।

আমাদের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত হওয়া উচিত। পারিবারিক এবং সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়  জোরালো উদ্যোগে আমাদের  সেই ১৯৫২’র আবেগ, দেশপ্রেম, আত্মমর্যাদাবোধ আর শহীদের রক্তে রাঙা ২১  ফেব্রুয়ারির প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ অক্ষুণ্ন রাখা সম্ভব। তাই মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে কবির ভাষায় বলা যায়, ‘মধুর চেয়েও আছে মধুর, সে যে আমার মাতৃভাষা/ মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।’

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রেষ্ঠ উপায়।