প্রবাস

আঞ্চলিক ভাষার সংস্কৃতি জীবনের মতোই বহমান

দিনকয়েক আগে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথাটি শুনলাম। ‘বাংলা ভাষা শান্তিনিকেতন থেকে বাংলা দেখতে রওনা দিয়ে পুরান ঢাকায় ধোলাইখালের পানি খেয়ে পেট খারাপ করে। নোয়াখালী গিয়ে মাথা খারাপ হয়। অতঃপর সিলেট গিয়ে জ্ঞান হারায়। নাছোড়বান্দা বাংলা ভাষা চট্টগ্রাম দেখতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে।’

আঞ্চলিক ভাষার এই আলাপচারিতা আমাদের সংস্কৃতির গর্বিত প্রকাশ। চট্টগ্রামসহ বরিশাল, সিলেট, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ইত্যাদি অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাও বাংলা। এই আঞ্চলিকতার মধ্যে এতদাঞ্চলের ভাষা-সংস্কৃতির স্বকীয়তা স্পষ্টতই দৃশ্যমান। আঞ্চলিক ভাষার এই সংস্কৃতি জীবনের মতোই বহমান।  

চট্টগ্রামের ভাষার এই শক্তিমত্তায় দৌলত কাজী বা আলাওলের কোনো প্রভাব আছে কিনা আমার জানা নাই। তবে ভাষা যখন ‘ল্যাংগুয়েজ অফ রিয়াল লাইফ’ বা জীবন বাস্তবতার ভাষা অথবা ‘মিন্স অব লাইফ’ বা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সাথে সম্পর্কিত হয়, তখন তার নিজস্ব শক্তিমত্তা জারি থাকে। শ্রম-সম্পর্কের ভাষায় মানুষ তার কম্যুনিটি গড়ে তোলে। তাই শ্রম-সম্পর্কের ভাষা তথা মায়ের ভাষা আঞ্চলিক হলেও, মরতে পারে না। বরং শান্তিনিকেতনের ভাষাকে চট্টগ্রাম গিয়ে আত্মাহূতি দিতে হয়। এবং কোক-স্টুডিওকেও আঞ্চলিকতার সাংস্কৃতিক শক্তি ও জনপ্রিয়তাকে স্বীকার করে বিনিয়োগে বাধ্য হতে হয়।

সব ভাষারই একটা প্রকাশ্য এবং একটা নিভৃতচারী চরিত্র আছে। প্রকাশ্যে ভাষা আমাদের ভাবের আদান প্রদান ঘটায়। কিন্তু ভাষার নিভৃতচারী চরিত্র মারাত্মক। সেখানে ভাষা সংস্কৃতির বাহক। চট্টগ্রামের ভাষার কথা বাদ দিলাম। ভিন-দেশীদের কথায় আসি। সুইডেন আর ডেনমার্কের লোকজন ইংরেজি ভাষা জানে, কিন্তু ইংরেজি ব্যবহার করে নন-স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা হিসাবে। চীন, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়ায়ও মানুষ ইংরেজিতে কথা বলে। এ সবই ‘শিল্পোন্নত’ দেশ। ইংরেজি বৈশ্বিক ভিন্নভাষার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা। লেন-দেনের হিসাব কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেয়ার ভাষা।  ইংরেজি সেখানে ইংরেজ বা ইউরোপিয় সংস্কৃতির বাহক না। অপরদিকে, ওয়েস্ট ইণ্ডিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড-এর বাসিন্দারা সবাই ইংরেজিতে কথা বলে। তবুও তারা কেউই ইংরেজ না।  তাদের প্রত্যেকের ধ্বনিগত তথা সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা আছে।

ভারতবর্ষে একসময় ফার্সি আদালত, তথা রাজকার্য সম্পাদনের ভাষা ছিল। এলিট শ্রেণির অনেকেই এই ভাষা জানতেন। (যেমন রাজা রামমোহন রায়)। আফগানিস্থান বা তরস্ক থেকে আসা শাসকদের আমলে ফার্সি ভাষা ছিল লিংগুয়া ফ্রাংকা। খাওয়ায়া-দাওয়া, পোষাক-আশাক, নাচ-গান থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের অনেক স্থাপনাতে (যেমন তাজমহল) তাই পারস্য সংস্কৃতির প্রভাব এখনো চোখে পড়ে। আদালত ও রাজদরবারের ভাষাও ছিল ফার্সি। কালক্রমে ফার্সি ভাষার সাথে মানুষের জীবন-জীবিকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। 

ইংরেজ শাসকরা ফার্সিকে বিলুপ্ত করে ইংরেজি চালু করে। এক সময় ফার্সি ভাষা জানা যাদের জীবন-জীবিকার অবলম্বন ছিল তারা জীবিকার অবলম্বন হারাতে থাকেন। একই সাথে যারা ইংরেজি শেখা শুরু করেন, তারা পুরস্কৃত হতে থাকেন। অনেকে ইংরেজি ভাষার হাত ধরে জমিদারিও লাভ করেন। এই কারণে ইংরেজি ভাষা আমাদের জন্য ছিল সংস্কৃতির বাহক এবং ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের ভাষা।

লক্ষণীয় যে মুসলমান শাসন কালপর্ব  ইংরেজ শাসন কালের প্রায় তিন গুন হলেও ফার্সি বা ইরানের ভাষাকে আমাদের সংস্কৃতি থেকে বিলুপ্ত করা যায়। এবং দুইশ বছরের ইংরেজ শাসনে আমরা অনেকেই এখনও মননে ও চিন্তায় ইংরেজ এবং একই সাথে পশ্চিমের গোলাম। বন্দুক আর কামানের গোলা দিয়ে মানুষের জীবনকে মুছে ফেলা যায়। কিন্তু ভাষা বন্দুক বা কামানের চেয়েও অনেক শক্তিশালী অস্ত্র। ভাষার বন্দুকে সংস্কৃতির গোলা ভরে গুলিবিদ্ধ করা জনগোষ্ঠিকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েও অর্থনৈতিক ভাবে পরাধীন করে রাখা যায়। ইংরেজি ভাষা আমাদের জন্য তেমন এক ভাষা। আমাদের দেশের স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাব্যবস্থাও তেমন গুলিবিদ্ধ কিনা তা হয়ত ভাবার সময় এখনই।

ধনিতত্ত্ব ও ভাষার বৈচিত্র গুরত্ব দিয়ে ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয় ২১ ফেব্রয়ারিকে। মায়ের ভাষায় আমরা শেখা শুরু করি। মায়ের কাছ থেকে শোনা শব্দ আমাদের মানসে যে শব্দছবি তৈরি করে, সেই শব্দছবির সঙ্গে মিলিয়ে আমরা অন্য ভাষা শিখি এবং জীবন বাস্তবতায় প্রবেশ করি। 'পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি, দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পারি' এই কবিতা যে শব্দছবি আমাদের মনে আঁকে আর 'Mary had a little lamb' যে শব্দছবি আমাদের মনে আঁকে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। শীত আমাদের দেশে নাই বললেই চলে। ভেড়া পালন, ভেড়ার পশম থেকে উল তৈরি করা আমাদের জীবন জিবীকা বা সংস্কৃতির অংশ না। কিন্তু তা ইউরোপের জীবন জিবীকার অংশ ছিল এবং আছে। আবার লক্ষণীয় যে, আমরা ইউরোপের নগরী, রাস্তাঘাটকে আদর্শ মনে করি এবং আমাদের মত নদীমাতৃক দেশে নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আদর্শ চলাচল ব্যবস্থা হিসাবে ভাবতে পারি না!

দেখা যাচ্ছে, শব্দছবি ভাষার আভিধানিক অর্থের বাইরের ব্যাঞ্জনা। এই ব্যাঞ্জনা ঘিরেই সংস্কৃতি তার পেখম মেলে। মায়ের ভাষায় শেখা ঘুম-পাড়ানিয়া গান, ছড়া, গল্প, কবিতা, শ্লোক, বাগধারা, ধাঁধা ইত্যাদির মাধ্যমে আমাদের কচি মানসে যে শব্দছবি গড়ে ওঠে, সেই শব্দছবি আমাদের অবচেতন মনে সজীব থাকে। সেই শব্দছবির সাথে মিলিয়ে আমরা নতুন নতুন ভাষা শিখি। মায়ের ভাষায় শেখা শব্দছবির সজীবতা ও শক্তিমত্তা ছাড়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা অর্জন প্রায় অসম্ভব। 

দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, আমাদের ঔপনিবেশী প্রভুগণ ইংরেজি ভাষার সাথে যে সাংস্কৃতিক ল্যাংগুজোয়াল আমাদের কাঁধে তুলে দিয়ে গেছে, তা অসাধারণ সাফল্যের সাথে আজও আমাদের চিন্তা চেতনাকে প্রভাবিত করে। অবসরে আমাদের যাদের পেছনে ফিরে তাকানোর সময় আছে, তারা হয়ত দেখতে পাবো, আমরা যারা আমলা, তারা মূলত ইংরেজ সংস্কৃতির সাহেবী মানসিকতার আমলা ছিলাম। যদিও এর ব্যতিক্রম আছেন আনেকেই।

লেখক: ইনফরমেশন সিস্টেমস অফিসার, ওআইসিটি, জাতিসংঘ