নায়করাজ

চলচ্চিত্রাভিনয়ে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি || চিন্ময় মুৎসুদ্দী

রাজ্জাকের মৃত্যুতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাভিনয়ে একটি অধ্যায় সমাপ্ত হলো। দীর্ঘতম সময় তিনি দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। ১৯৬৪ সাল থেকে আমৃত্যু চলচ্চিত্রের সঙ্গেই ছিলেন। প্রথমদিকে কয়েকটি ছবিতে সহকারী পরিচালক ও কয়েকটি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন। অভিনয় জীবনের মোড় ঘুড়ে যায় ‘বেহুলা’ ছবিতে অভিনয়ের পর। এ ছবির ব্যবসায়িক সাফল্যে রাজ্জাকের চাহিদা বেড়ে যায় ঢাকার ছবিতে। জহির রায়হান রাজ্জাককে লক্ষ্মীন্দর চরিত্রে বাছাই করার সময় বলেছিলেন, ‘চরিত্রটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, দেখা যাক নতুন ছেলেটা কী করে।’ কিন্তু চিত্রগ্রহণের সময় রাজ্জাকের সাবলীল অভিনয় দেখে জহির রায়হান অবাকই হয়েছিলেন। এ কথা তিনি একাধিক আলোচনায় উল্লেখ করেছেন। রাজ্জাক এই সুযোগ প্রাপ্তির জন্য সবসময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন জহির রায়হানের প্রতি। তাকে তিনি ‘সিনেমা পিতা’ হিসেবেই শ্রদ্ধা করতেন। ১৯৭০ থেকে প্রায় ২০ বছর সাংবাদিকতার সূত্রে চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার সময় নানাভাবে রাজ্জাকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে চলচ্চিত্র শিল্পের ভালো-মন্দ নিয়ে। বয়সের কারণে ‘নায়ক’ হিসেবে অভিনয় থেকে বিদায় নিলেও পরে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন। যেহেতু আমাদের এখানে চরিত্র অনুযায়ী গল্প তৈরি করে সিনেমা নির্মাণ খুব একটা হয় না। যেটা আমরা হলিউড বা বলিউডের সিনেমায় প্রায় সময়ই দেখি। যে কারণে এখনও অমিতাভ বচ্চন দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে যাচ্ছেন। তাকে কেন্দ্র করে সেখানে চিত্রনাট্য লেখা হয়। এখানে এমনটা চোখে পড়ে না। তারপরও রাজ্জাক বিভিন্নভাবে চলচ্চিত্রের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন। ছবি পরিচালনা করেছেন, প্রযোজনা করেছেন। দুই ছেলেকে চলচ্চিত্রে যুক্ত করেছেন। মেয়ে ময়নাকেও নিজের একটি ছবিতে অভিনয় করিয়েছেন। চলচ্চিত্রকেই তিনি দ্বিতীয় পরিবার হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশক পুরোটাই ছিল অভিনয়ে রাজ্জাক যুগ। জনপ্রিয়তা ও প্রভাবের দিক থেকে শীর্ষে থেকেও কখনো ফেলে আসা নিজের কষ্টের দিনগুলোর কথা গোপন করেননি। খোলামেলা ভাষায় সেসব কথা বলতেন। বিশেষ করে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার পরের কয়েক বছরের দারিদ্রক্লিষ্ট জীবনের কথা নির্দ্বিধায় বলে নিজেকে বড় মাপের মানুষ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বন্ধুবৎসল রাজ্জাকের আবাসস্থল লক্ষ্মীকুঞ্জ ছিল তার বন্ধুদের জন্য সবসময় উন্মুক্ত। তার ব্যস্ততম দিনগুলোতেও লক্ষ্মীকুঞ্জে নিয়মিত আয়োজন করতেন মিলনমেলার। সেখানে যোগ দিতেন চলচ্চিত্র জগতের মহারথিরা। তাকে ‘নায়করাজ’ উপাধি দেওয়া বন্ধু সাংবাদিক আহমদ জামান চৌধুরীর সঙ্গে একবার ‘ঝগড়া’ হলে চলচ্চিত্র পত্রিকাগুলো রাজ্জাককে প্রায় বয়কট করে কেবল আহমদ জামান চৌধুরীর বক্তব্য প্রকাশ করতে থাকে। এই সময় আমি তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি আবেগতাড়িত হয়ে বলেছিলেন, ‘খোকা (আহমদ জামান চৌধুরী) আমার বন্ধু, আমাকে নায়করাজ বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমার ভুল হয়ে থাকলে সে সেভাবেই দেখবে। কিন্তু আমি কষ্ট পাচ্ছি কেউ আমার কথা জানতে চাননি। আমারও তো কিছু কথা আছে।’ দীর্ঘ সেই সাক্ষাৎকার সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। রাজ্জাকের জীবনের সকল প্রাপ্তি চলচ্চিত্র থেকে। চলচ্চিত্রকেও তিনি ভালোবেসেছেন। চলচ্চিত্র থেকে প্রাপ্ত অর্থ চলচ্চিত্র শিল্পে বিনিয়োগ করেছেন। চলচ্চিত্রের জন্য তার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ দুই ছেলে বাপ্পারাজ ও সম্রাট। চলচ্চিত্রাভিনয়ে রাজ্জাক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলেও তার প্রভাব আরো অনেকদিন আমাদের চলচ্চিত্রকে দেবে অনুপ্রেরণা।    

 

লেখক : প্রবীণ চলচ্চিত্র সাংবাদিক রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ আগস্ট ২০১৭/তারা