কৃষি

মাছ ও মিষ্টির অভিনব এক মেলা

ফেরদৌস জামান : গল্পের আসরে দাদা-চাচাদের মুখে প্রায়ই উঠে আসত পোড়াদহের মেলার কথা। তারা অবাক কণ্ঠে মেলার কথা বলতেন। একবার এক চাচার মুখে শুনেছিলাম, তিনি নাকি এই মেলায় গরুগাড়িতে রাখা এত বড় এক মাছ দেখেছিলেন যে, মাছটির লেজ মাটিতে ঝুলে ছিল! কথাটি কতটা সত্য সে বিতর্কে না গিয়ে এটা বলা যায় যে, পোড়াদহের মেলা মাছের জন্য সত্যি বিখ্যাত। মেলাটিও কম বিখ্যাত নয়। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অনবদ্য সৃষ্টি ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে এই মেলার কথা আছে। আমার এবারের ভ্রমণবৃত্তান্তে পাঠককে ঐতিহাসিক সেই মেলার কথা শোনাব। অতীতে গ্রাম বাংলায় মেলার নানাবিধ গুরুত্ব ছিল। বছরের মশলাপাতি, চুন-সুপারি থেকে শুরু করে মাটির হাড়ি-পাতিল, এমনকি আসবাবপত্র সবকিছুই মেলা থেকে কেনা হতো। মানুষ এগুলো কেনার জন্য বছর ধরে মেলার অপেক্ষা করত। বিক্রেতারাও সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতেন। ফলে বেচাকেনা তো জমজমাট হতোই উপরন্তু মেলা হয়ে উঠত এলাকার মানুষের বছরান্তের মিলনমেলা। অন্তত এক দিনের জন্য হলেও মিটে যেত বিবাদ, কমে যেত সামাজিক দূরত্ব ও ভেদাভেদ। মেলা উপলক্ষে কুটুম আসত বাড়িতে, অথবা মেলার সদাই পৌঁছে যেত আত্মীয় বাড়ি। বিনোদনের নানা আয়োজনে ঠাসা থাকত মেলা প্রাঙ্গণ। নাগোরদোলা, বায়োস্কোপ, যাত্রা, সার্কাস সেই বিনোদনে যোগ করত ভিন্ন মাত্রা।

দেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর মধ্যে বগুড়া জেলার পোড়াদহ মেলা প্রাচীন এবং বিখ্যাত। স্থানীয় প্রবীণ ও সচেতন মানুষের দেয়া তথ্য মতে এ বছর ছিল মেলার ১৮২তম আয়োজন। পোড়াদহ মেলার প্রধান আকর্ষণ মাছ, কাঠের আসবাবপত্র ও মিষ্টি জাতীয় খাদ্য। মেলায় যেতে হলে বগুড়া শহরের চেলোপাড়া থেকে ধরতে হয় বাহন।  দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। মেলা উপলক্ষে পথে থাকে অতিরিক্ত যানবাহন। ফলে সরু রাস্তায় লেগে যায় যানজট, পৌঁছতে সময় লাগে অনেক বেশি। যেমন আমাদের লাগল প্রায় দেড় ঘণ্টা। সিএনজিচালিত অটোরিক্সার শেষ গন্তব্য গোলাবাড়ি বাজার। সেখান থেকে হাটতে হলো প্রায় ১ কি.মি. পথ। আর এইটুকু পথ পেরিয়ে মেলায় পৌঁছে আমাদের মনে হলো যুদ্ধে যেন জিতে গেলাম! হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় আশপাশের দু’চার মাইল এলাকায় উৎসবের আমেজ বুঝতে পারলাম। আমরা যখন যাচ্ছিলাম তখন অনেকেই ফিরছিলেন। তাদের অনেকের হাতে দেখলাম ঝুলছে সুতায় বাঁধা মাছ। তুলনামূলক বড় মাছগুলো অনেকে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। একটা ইয়া বড় মাছ দেখে থমকে দাঁড়ালাম। এক লোক কাঁধে নিয়ে যাচ্ছে। ওজন জিজ্ঞেস করতেই বলল, ছাব্বিশ কেজি। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে দাম জিজ্ঞেস করতেই জানলাম, প্রতি কেজি হাজার টাকায় কেনা। ক্রেতা পাশের গ্রামের নতুন জামাই। বেচারা মেলার বড় মাছটি কিনতে পেরে বেশ খুশি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, মেলার সময় এলাকায় জামাইরা বেড়াতে আসেন। এটা অনেকটা মান সন্মানের ব্যাপার। এ সময় শ্বশুড়বাড়িতে জামাই না এলে ওই বাড়ির নাকি নাক কাটা যায়! জামাই আসবে, তারপর জামাই মেলা থেকে সাধ্যমত বড় মাছটি কিনবে। প্রতিবেশীরা নিমন্ত্রণ পাবে- এভাবেই মেলার আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয় সকলে। এটা অনেকটা রেওয়াজের মতো হয়ে গেছে। এরপর শ্যালক-শ্যালিকাদের আবদার মেটানোর ব্যাপার তো আছেই। শ্বশুরবাড়ির লোকজন এগুলো প্রত্যাশা করে। মেলায় শুধু যে জামাইয়েরই পকেট ফাঁকা হবে এমন নয়, উপহার হিসেবে জামাইও শ্বশুরবাড়ি থেকে বিভিন্ন জিনিস পাবেন।

পাশে বাঁধের উপরে দাঁড়িয়ে দেখা যায় মেলার বড় এক অংশ। নানা রং-এর কাপড় ও সামিয়ানায় ঢাকা মেলার বিভিন্ন অংশ। আসলে সেগুলো মেলার একেকটা পট্টি। মাইকে উচ্চ শব্দে প্রচারণা শোনা যাচ্ছে- এক টিকিটে দুই শো! একজন টিকিট কাটলে আরেকজন ফ্রি! মাছপট্টি গিয়ে দেখা গেল এক কেজি থেকে বিশ-পঁচিশ কেজি ওজনের নানা প্রজাতির  মাছ। খোঁজ নিতেই জানা গেল, এবারের মেলায় সব থেকে বড় মাছটা ছিল ৬৩ কেজি ওজনের একটি বাঘাড় মাছ। আয়োজক কমিটির একজনের সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল। হতাশার সুরে বললেন, ‘জেলার অন্যান্য উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী নওগাঁ, নাটোর, গাইবান্ধা ও বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যাপারীরা তাদের পণ্য নিয়ে মেলায় আসে প্রতিবছর। কিন্তু এবার চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেকে আসেননি।’ মেলা আয়োজনের স্বার্থকতা নিয়ে রয়েছে এক মজার বিশ্বাস। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের শেষ বুধবার মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তার আগে সোম ও মঙ্গলবার দুই রাতে পূজাপাঠ হয়। পূজায় দেবতা সন্তষ্ট হলেই ধরে নেয়া হয় মেলা এবার সফল হবে। দেবতা সন্তষ্ট হওয়ার বিষয়টি ধরে নেয়া হয় পূজা শেষে হঠাৎ বান-উরি (দমকা হাওয়া) হলে। কথাগুলো মেলায় দাঁড়িয়েই শুনছিলাম। পাশ থেকে একজন বলল, ‘আদে অল্পিএ্যানা আগেই উদে ওটি বান-উরি’ত এ্যাটা টিন উড়ে পললো’। মিষ্টি পট্টির নির্দিষ্ট এক দোকান থেকে মূহুর্মূহু ঘোষিত হচ্ছে- সেখানে দশ কেজি ওজনের রসগোল্লা পাওয়া যচ্ছে। গিয়ে দেখলাম ঘটনা সত্যি। মেলার সর্ববৃহৎ আকৃতির রসগোল্লা তার দোকানে শোভা পাচ্ছে। সেদিকে হাত বাড়ানোর দুঃসাহস না করে আমরা বরং গুড়ের সিরায় চুবিয়ে তোলা গরম জিলাপী সহযোগে রসনা মেটালাম। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মধ্যে বহুদিন পর চোখে পড়ল বিলুপ্তপ্রায় ঢেঁকি, পাউড়া (ধান শুকানোর পর টেনে এক খানে জরো করার উপকরণ) ও কাপড় কাচার পিঁড়ি।

মেলার উত্তর-পূর্ব কোণায় তরুণ বয়েসী পাকুড় গাছ আছে। জায়গাটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ভেতর থেকে ভেসে আসছে মাঝাড়ি শব্দে ঢোল করতালের শব্দ। গাছের নিচেই মহাদেবের মূর্তি। ভেতরে প্রবেশ করলাম। কথা হলো পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ননিগোপাল পালের সঙ্গে। মেলার ঐতিহাসিক পটভূমি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা একটা সন্যাস মেলা। মূলত পূজা উপলক্ষে মেলা হয়ে থাকে। প্রায় দুইশ বছর আগে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীর দহোতে (নদীর ধারে পাড় ভেঙে সৃষ্টি হওয়া জলাধার) হঠাৎ একদিন মহাদেব আকৃতির এক পোড়া কাষ্টখণ্ড ভেসে ওঠে। উক্ত পোড়া কাঠ থেকে নামকরণ হয় পোড়া কাঠের দহো, অর্থাৎ পোড়াদহ। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় তারপর থেকে স্থানীয়রা সেখানে পূজা করতে শুরু করে।’জানা গেল আগে মেলা প্রাঙ্গণে বড় দুটি বটগাছ ছিল। এর গোড়ায় পূজা আর্চণা হতো। গাছ দুটো মারা গেলে ঠিক সেখানেই স্থাপিত হয় সন্যাস মূর্তি। অধ্যাপক ননিগোপাল বাবুর পিতা মৃত গনেশচন্দ্র পাল ছিলেন মন্দিরের প্রথম সেবায়েত। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল ধর্মের মানুষ মনের আশা বা মানত পূরণে সেখানে কবুতর, ফল, বাতাসা, মিষ্টিসহ অনেক কিছু অর্ঘ্য রেখে যায়। বেলা গড়িয়ে এসেছে। আমাদের ফিরতে হবে। চলে আসার সময় দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ননিগোপাল বাবু বললেন, ‘আমাদের পূজাকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজন, যার শুরু হয়েছিল পূর্বপুরুষদের প্রচেষ্টায়। অথচ বর্তমানে মেলার আয়োজনে আমাদের কোনো অধিকার নেই। শুধু তাই নয়, বছরান্তে মেলা শেষে নিদেনপক্ষে মন্দিরের উন্নয়নকল্পে দু’চার টাকার অর্থ সাহায্য পর্যন্ত মেলে না!’ছবি : লেখকরাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মে ২০১৫/তাপস রায়